প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২১শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৬ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১লা রজব, ১৪৪৭ হিজরি

গুমোট পরিস্থিতি, কোন পথে দেশ

editor
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ১, ২০২৫, ০৯:০০ পূর্বাহ্ণ
গুমোট পরিস্থিতি, কোন পথে দেশ

Manual2 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

Manual8 Ad Code

দেশে এখন কী হচ্ছে- এ নিয়ে নানা আলোচনা ও কানাঘুষা চলছে সর্বত্র। সচেতন জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা একজন আরেকজনের সঙ্গে দেখা হলেই জানতে চাইছেন; দেশে হচ্ছেটা কী। এমন পরিস্থিতিতে নানা ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব ঘুরপাক খাচ্ছে। ডালপালা মেলছে নানা গুজব। নির্বাচন আদৌ হবে কি না, এমন প্রশ্নও উঠছে। দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক সমাবেশে বলেছেন, দেশে একটা চক্রান্ত চলছে। একটি গোষ্ঠী নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করছে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান এবং অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মো. আসাদুজ্জামানও চক্রান্তের কথা বলেছেন। অথচ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিয়েছেন। নির্বাচন কমিশনও রোডম্যাপ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু তার পরও নির্বাচন হওয়া নিয়ে সংশয় দূর হচ্ছে না।

বরং প্রতিদিন ঘটছে নতুন নতুন ঘটনা। একটি ঘটনা শেষ হতে না হতেই অন্যটি সামনে আসছে। গত সপ্তাহে বিভিন্ন দাবিতে রাজধানী ছিল উত্তপ্ত। বিশেষ করে প্রকৌশলের শিক্ষার্থীরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা ঘেরাও করতে গেলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বেধে যায়। এ নিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে হওয়া শুরু হয়। সরকার মবতন্ত্রের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা বলছে। অথচ মবের বিরুদ্ধে অ্যাকশনে গেলে আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সমালোচনা করা হয়। অনেকের মতে, এ কারণেই সংকট ক্রমেই বাড়ছে। সরকার কিছুটা উভয়সংকটে পড়ছে। তবে মবতন্ত্র অব্যাহত থাকলে আগামী নির্বাচন বানচাল হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি নির্বাচন না হলে আশঙ্কা রয়েছে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হওয়ার।

গত শুক্রবার রাতে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরের ওপর হামলার ঘটনা ঘটে। নুর একটি দলের চেয়ারম্যান হওয়া সত্ত্বেও কেন জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে মিছিল নিয়ে গেলেন, সেটি নিয়ে কেউ কেউ প্রশ্ন তুলছেন। তেমনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক পিটুনি নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ নুরের শরীরে আঘাতের মাত্রা অনেক বেশি। সরকারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এ নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া যেমন হয়েছে। তেমন অনেকে এমনটিও বলছেন যে গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পূর্ণ হয়ে গেছে। রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধের বিষয়টি এখন সরকারের হাতেই ছেড়ে দেওয়া উচিত। কিন্তু একের পর এক দাবিতে পরিস্থিতি ঘোলাটে হলে আওয়ামী লীগ সুযোগ নিতে পারে- এমন কথা বিএনপির পক্ষ থেকে বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই বলা শুরু করেছে। এ ছাড়া জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশসহ ইসলামপন্থি কয়েকটি দলের তৎপরতার দিকে ইঙ্গিত করে বিএনপি মহাসচিবসহ অনেকে বলছেন, একটি উগ্রবাদী গোষ্ঠী বিভিন্ন ধরনের উগ্রবাদের কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চায়। পর্যবেক্ষকরা বলছেন, দেশে উগ্রবাদের উত্থানের সঙ্গে ভূ-রাজনৈতিক ও বাংলাদেশ প্রশ্নে আন্তর্জাতিক নানা হিসাব-নিকাশ জড়িত।

এর আগে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে মঞ্চ ৭১-এর আলোচনা সভা থেকে লতিফ সিদ্দিকীকে কিছু লোকের আইনের হাতে সোপর্দ করা নিয়েও পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনা রয়েছে। অনেকেই ওই দিনের ঘটনাকে মবতন্ত্র বলছেন। প্রশ্ন উঠেছে- এসব ঘটনা কেন হঠাৎ করে ঘটছে, নাকি তা পরিকল্পিত- এ নিয়ে রাজনীতিবিদদের পাশাপাশি জনমনেও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। পরিস্থিতি পর্যালোচনায় আজ রবিবার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির নেতাদের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করবেন। সার্বিকভাবে দেশের সাম্প্রতিক ঘটনা ও ইস্যু নিয়ে গুমোট পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে বলে বিশ্লেষকরা বলছেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. মাহবুবউল্লাহ মনে করেন, দেশে যখন এ ধরনের ঘটনা ঘটে, তখন রাজনীতিবিদরা এবং অন্যান্য মহল সেটিকে ষড়যন্ত্র হিসেবে চিহ্নিত করেন। ষড়যন্ত্রের কথা বলে সেটিকে উসকে দেওয়া ঠিক না। সবার সুমতি হতে হবে। একে অপরের প্রতি যদি সন্দেহ-অবিশ্বাস থাকে, তাহলে উচিত হবে পরস্পর কথা বলা। এ ক্ষেত্রে বিএনপির দায়িত্ব বেশি, বড় দল হিসেবে। বিএনপি যেহেতু নির্বাচন চাইছে এবং তারা মনে করছে নির্বাচন হলে দেশের অবস্থা ভালোর দিকে যাবে। সেটিই যদি সত্যি হয়, বিএনপির উচিত নির্বাচন যাতে বানচাল না হয়, সে জন্য ধীরস্থিরভাবে কাজ করা। অন্যদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। যোগাযোগ রাখতে হবে। তাদের আস্থায় নিতে হবে। তাদের ভরসা দেওয়া যে এমন কিছু আমরা করব না, যা রাজনীতির জন্য বা সাংগঠনিক কার্যক্রমের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী বলেন, প্রধান উপদেষ্টা যখন নির্বাচনের সময় ঘোষণা করলেন, তখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে কোনো সমঝোতা হয়নি। সংস্কারেও অগ্রগতি হয়নি। বিচার দৃশ্যমান হয়নি। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়া হবে কি না, বলা হচ্ছে দুই বছর পর ভিত্তি দেওয়া হবে; সেটি তো জনগণ মেনে নেবে না। সেই অবস্থায় নির্বাচনের তারিখ দেওয়া হয়েছে। তাহলে তো ঘোলাটে হবে পরিস্থিতি।

তিনি বলেন, ‘কোন সরকার এই নির্বাচন করবে, কেয়ারটেকার সরকার ফেরত আসবে কি না, সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে এই সংবিধানের অধীনে নির্বাচন দেওয়ার এখতিয়ার আছে কি না, এসব বিষয়ও পরিষ্কার করা হয়নি। এগুলো পরিষ্কার না করার মধ্যে নুরদের ওপর যৌথ বাহিনী হঠাৎ করে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এটি আমার কাছে ষড়যন্ত্র মনে হচ্ছে। পরিস্থিতি এমনিতে ঘোলাটে, আরও ঘোলাটে করা হচ্ছে। এভাবে মারাত্মকভাবে মারে? আমার কাছে ষড়যন্ত্র মনে হচ্ছে।’

Manual2 Ad Code

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতন হয়। এরপর দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। তখন থেকেই প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা নির্বাচনের বিষয়ে সুস্পষ্ট রোডম্যাপের দাবি জানিয়ে আসছিলেন। সরকার জুলাই গণহত্যার বিচার, সংস্কারে জোর দেয়। তবে নির্বাচনের ডেটলাইন নিয়ে আগামী বছরের জুনের কথা জানানো হয়। সর্বশেষ ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে নির্বাচন আয়োজনের বিষয়টি ঘোষণা দেন প্রধান উপদেষ্টা। বিএনপি এই সময়কে স্বাগত জানালেও জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামপন্থি দলগুলো নিম্নকক্ষে পিআর পদ্ধতিতে ভোটের পক্ষে সরব। নির্বাচন কমিশনের সমালোচনাও করছেন তারা। এতে দেশের রাজনীতিতে একধরনের বিভেদ তৈরি হচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে শঙ্কার পাশাপাশি জনমনে উদ্বেগ তেরি হচ্ছে।

Manual8 Ad Code

রোডম্যাপ ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘কোন পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, তা এখনো ঠিক হয়নি। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষিত রোডম্যাপ গতানুগতিক এবং কিছুটা বিভ্রান্তিমূলক। আর গত শুক্রবার ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির চরমোনাই পীর সৈয়দ রেজাউল করীম হুঁশিয়ারি দিয়েছেন- সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি (পিআর) ছাড়া আসন্ন জাতীয় নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তির মাধ্যমে নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া এসব রাজনৈতিক দলের বিরোধে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই উত্তপ্ত হচ্ছে। ভিন্নমত তৈরি হওয়ায় জুলাই সনদ ইস্যু এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। চূড়ান্ত খসড়া তৈরি হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর বৈঠকের অপেক্ষায় এখনো ঝুলে আছে। শনিবার (৩০ আগস্ট) প্রেস ক্লাবে এক আলোচনাসভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেছেন, কয়েকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচনি প্রক্রিয়া বানচাল করার চেষ্টা করছে। বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তুলে দেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা চলছে। এ ছাড়া রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থার উত্থান নিয়েও বিভিন্ন সময় উদ্বেগের কথা জানিয়েছিলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

পরিস্থিতি পর্যালোচনায় বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা দেখা যাচ্ছে। প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে শাহবাগ ছেড়ে হঠাৎ যমুনা ঘেরাও করতে যাওয়াটাও প্রশ্ন তুলেছে। পুলিশ বাধা দিলে সেখানে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। রমনা জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার মাসুদ আলমের এক ছাত্রের মুখ চেপে ধরার ছবি আলোচনায় আসে। যদিও তার আগে সেই ছাত্রকে এক পুলিশ সদস্যের হেলমেটে আঘাত করতে দেখা গেছে। এরপর ডিআরইউতে আলোচনা সভার আয়োজন করে মঞ্চ ৭১। এই সভায় কয়েকজন ব্যক্তি আয়োজকদের নাজেহাল করেন। পরে পুলিশের হাতে তাদের তুলে দেওয়া হয়। এ নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত আসে। অনেকে এটিকে মবতন্ত্র অ্যাখ্যা দিয়েছেন। কেউ কেউ আবার শেখ হাসিনার সময়ে ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকাসহ অন্যদের সঙ্গে এ ধরনের পরিস্থিতিও সামনে আনেন।

Manual2 Ad Code

গত শুক্রবার পল্টনে বিজয়নগরে জাতীয় পার্টি নিষিদ্ধের দাবিতে মিছিল করে গণঅধিকার পরিষদ। সেই মিছিলটি জাতীয় পার্টির কার্যালয়ের সামনে গেলে দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। এরপর গণঅধিকার পরিষদের নেতা-কর্মীরা তাদের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেন। সেখানে নুরুল হক নুরকে ব্যাপক পিটুনি দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের বিরুদ্ধে মব সৃষ্টির অভিযোগ আনা হয়। একটি রাজনৈতিক দলের প্রধানকে এভাবে পিটুনিতে নানা আলোচনা-সমালোচনা তৈরি হয়েছে। এটিকে ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত মনে করছেন কেউ কেউ। তবে সরকার, পুলিশ, সেনাবাহিনী মব ভায়োলেন্স নিয়ন্ত্রণে জিরো টলারেন্সের কথা জানায়।

পর্যবেক্ষকদের অভিমত, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে মব তৈরি করে ফায়দা হাসিলের চেষ্টাও হয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর হওয়ারও দাবি ছিল বিভিন্ন মহল থেকে। ব্যবস্থা নিলে সমালোচনা, আবার না নিলে সরকার দুর্বল বলেও সমালোচনা করা হয়। নুরুল হক নুরকে মারধরের প্রতিবাদে দলটির নেতা-কর্মীরা গতকাল বিক্ষোভ করেছেন দেশের বিভিন্ন স্থানে। অন্তর্বর্তী সরকার এ ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের কথা বলেছে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের কুশপুতুল দাহ করা হয়।

বিশ্লেষকদের আশঙ্কা, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অস্থিরতা-অনৈক্য বাড়তে থাকলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। ফলে দেশ নতুন করে সংকটে পড়তে পারে।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual3 Ad Code