প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৫ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৩০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৪শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

পুলিশের সংস্কার কোন পথে

editor
প্রকাশিত নভেম্বর ২৪, ২০২৪, ০১:৪৭ অপরাহ্ণ
পুলিশের সংস্কার কোন পথে

Manual4 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

কোনও কিছু হারিয়ে যাওয়া বা সিঁদেল চুরি থেকে শুরু করে বড় ধরনের অপরাধের ঘটনা উদঘাটনসহ দেশের অভ্যন্তরীণ আইন- শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করা পুলিশ বাহিনীর মুখ্য কাজ। কিন্তু বিগত সরকারগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে— আইনশৃঙ্খলা রক্ষার নামে তারা এই বাহিনীকে গুম, খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ রাজনৈতিক নিপীড়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। যে কারণে দীর্ঘদিন থেকেই এ বাহিনীকে গণমুখী করতে যুগোপযোগী ও আধুনিকায়ন করার জন্য সংস্কারের বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসছে। ইউএনডিপি’র সহযোগিতায় ২০০৭ সালে একবার এ বাহিনীকে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়ে বেশকিছু কাজও হয়েছিল। কিন্তু পরে সেটা আর আলোর মুখ দেখেনি। কিন্তু গত জুলাই ও আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর বিপর্যস্ত হয়ে পড়া পুলিশ বাহিনীর সংস্কারে কমিশন গঠন করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।

 

‘কেমন পুলিশ চাই’, এ বিষয়ে জানার জন্য গত ৩১ অক্টোবর ‘জনমত জরিপ বিজ্ঞপ্তি’ জারি করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত পুলিশ সংস্কার কমিশন। সেই বিজ্ঞপ্তিতে পুলিশ সংস্কার কমিশনের পক্ষ থেকে ওয়েবসাইটে একটি প্রশ্নমালা দিয়ে গত ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত জনমত যাচাই করা হয়। এ জনমত জরিপে কী ধরনের মতামত পাওয়া গেছে সেটা জানা না গেলেও গত ১৮ নভেম্বর সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন সাংবাদিকদের বলেছেন, ইতোমধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে সুপারিশ করে একটি খসড়া প্রতিবেদন তারা তৈরি করেছেন। বিভিন্ন অংশিজনের সঙ্গে আলোচনা শেষে এটাকে চূড়ান্ত করা হবে বলে জানান কমিশনের প্রধান। অপরদিকে, ‘স্বাধীন জাতীয় পুলিশ কমিশন গঠন’সহ পুলিশ সদর দফতর থেকেও সংস্কার কমিশনের কাছে অন্তত অর্ধ্বশত প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে। যেসব প্রস্তাবনা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে প্রাথমিকভাবে আলোচনাও হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

 

‘কেমন পুলিশ চাই’— এ প্রশ্নমালায় প্রথমেই জানতে চাওয়া হয়েছে, পুলিশকে ‘জনবান্ধব, জবাবদিহিমূলক, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত, দক্ষ ও আধুনিক, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, নিরপেক্ষ ও আইনের শাসনে অনুগত’ চায় কিনা জনগণ? দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল, কোন কোন ক্ষেত্রে সংস্কার খুব জরুরি মনে করেন? একাধিক জবাব দিয়ে টিক চিহ্ন দিতে বলা হয়। জবাবের জায়গায় বলা হয়, ‘বিদ্যমান পুলিশ আইন ও বিধিবিধান পরিবর্তন করে যুগোপযুগী করা উচিত। পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে ব্যবহার করা বন্ধ করতে হবে। পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে জেলা পর্যায়ে কার্যকর একটি আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত। পুলিশের বলপূর্বক গুম করা, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনকে দ্রুত জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। পুলিশের কাজকর্মের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে সবার জন্য উন্মুক্ত, স্থায়ী ‘অভিযোগ কমিশন’ স্থাপন জরুরি। সাইবার ক্রাইমসহ বিভিন্ন নিত্য নতুন অপরাধ শনাক্তকরণ ও দমনে পুলিশকে বিভিন্ন উন্নত প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। অধস্তন পর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের বেতনভাতা ও অন্যান্য সুযোগসুবিধাদি যুক্তিসঙ্গতভাবে বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে পুলিশের দুর্নীতি বন্ধের কার্যকর প্রশাসনিক ও বিধিগত ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়োজন। এরপরও কারও কোনও বক্তব্য থাকলে দুই বাক্যে জানাতে বলা হয়।

 

 

 

তৃতীয় প্রশ্নটি ছিল, গত সরকারের সময়ে গায়েবি ও ভুয়া মামলা নিয়ে। এসব মামলা দিয়ে বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকার বিরোধী দলমত দমন করে আইনের অপব্যবহারের অপসংস্কৃতি চালু করেছিল। আইনের অপব্যবহার রোধে মামলা রুজুর ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর সংশ্লিষ্ট ধারাটির সংস্কার চান কিনা? তাহলে ‘হ্যাঁ’ কিংবা ‘না’-তে টিক চিহ্ন দিতে বলা হয়। এর উত্তর ’হ্যাঁ’ হলে কেমন সংস্কার চান? এমন সম্পূরক প্রশ্ন করা হয়।

 

Manual1 Ad Code

প্রশ্ন মালায় আরও বলা হয়, পুলিশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল মোকাবিলা ও বিরোধী দলমত দমনে মাত্রারিক্ত বলপ্রয়োগসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। মানবাধিকার সুরক্ষায় চাওয়া মতামতে বলা হয়, আর্ন্তজাতিক মানবাধিকার সনদের নির্দেশাবলি যথাযথ অনুসরণ, মানবাধিকার বিষয়ে পুলিশকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অপরাধকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করা এবং বার্ষিক কর্মমূল্যায়ন প্রতিবেদনে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যের মানবাধিকার বিষয়ে অর্জিত স্কোর ‘পুরস্কার বা তিরস্কারে’ অর্ন্তভুক্ত করা। এর বাইরেও বক্তব্য থাকলে দিতে বলা হয়।

Manual3 Ad Code

 

শান্তিপূর্ণভাবে রাস্তাঘাটে যান চলাচলে বিঘ্ন না ঘটিয়ে সভা-সমাবেশ আয়োজন, ৫৪ ধারা, পুলিশ হেফাজতে বা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের ১৬৭ ধারার সংস্কার, পরোয়ানা কিংবা সার্চ ওয়ারেন্ট না থাকা, ইউনিফর্ম ছাড়া গৃহতল্লাশি, কখনও আটক ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে স্বীকার না করা, সাংবিধানিক কাঠামোর আওতায় একটি স্বাধীন ‘পুলিশ ন্যায়পাল’ প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ১৭টি প্রশ্নের মাধ্যমে মতামত চাওয়া হয়।

 

 

Manual6 Ad Code

কী আছে পুলিশ সদর দফতরের প্রস্তাবনায়

 

পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, সরকারের পাশাপাশি পুলিশ বাহিনীর সংস্কার নিয়ে পুলিশ সদর দফতরও একটি অভ্যন্তরীণ সংস্কার কমিটি গঠন করে। পুলিশ সদর দফতরের সেই কমিটির পক্ষ থেকে বাহিনীর সংস্কারে কমিশনের কাছে দেওয়া উল্লেখযোগ্য প্রস্তাবনাগুলোর মধ্যে রয়েছে— আইনি কাঠামো সংস্কার করে স্বাধীন জাতীয় পুলিশ কমিশন গঠনের প্রস্তাব করা হয়। পুলিশের পেশাদারি দক্ষতা বাড়ানো ছাড়াও বৈষম্যহীনভাবে সততা ও দক্ষতা— এই ৩ যোগ্যতাকে প্রাধান্য দিয়ে প্রশাসনিক ও মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনাকে নিয়োগ, পদায়ন, পদোন্নতি, প্রণোদনা ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্বচ্ছ, আধুনিক ও যুগোপযোগী করার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। পুলিশের কল্যাণে ৯টি উদ্যোগ নিতে প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা হয়।

 

সব শেষে প্রস্তাবনার মন্তব্যের ঘরে বলা হয়, যেকোনও সংগঠনের কর্মরত সদস্যদের সার্বিক কল্যাণের সঙ্গে তার শারীরিক, মানসিক সক্ষমতা ও পেশাদারি কর্মস্পৃহা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বাংলাদেশ পুলিশের স্বল্প সংখ্যক সদস্য এদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জানমালের নিরাপত্তায় দিনরাত তৎপর রয়েছে। এক্ষেত্রে জনবলের স্বল্পতার কারণে বিভিন্ন সরকারি দফতরে প্রচলিত আট ঘণ্টা ডিউটির ন্যায় ডিউটি পালন করা বাস্তবতার নিরিখে সম্ভব হয়ে ওঠে না। প্রায়ই পুলিশ সদস্যদের আট ঘণ্টার বেশি দায়িত্ব পালন করতে হয়। অতিরিক্ত ডিউটি, নিরাপত্তা ঝুঁকি, শারীরিক, মানসিক চাপ, স্বল্প পরিসরে আবাসন ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি সমস্যা নিরসন এখন সময়ের প্রত্যাশা হয়ে দাঁড়িয়েছে— যা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাজারবাগে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যদের মাঝে জোরালোভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এসব বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতা একান্তভাবে কাম্য।

Manual1 Ad Code

 

পুলিশ সদর দফতরের গঠিত অভ্যন্তরীণ সংস্কার কমিটির সদস্যসচিব ও অতিরিক্ত ডিআইজি (ইন্সপেকশন) মো. জালাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরীর কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা নিয়ে জাতীয় যে সংস্কার কমিশনটা আছে তারা কাজ করছে। আর আমরা পুলিশ তো অন্যতম অংশীজন। সংস্কার কমিশনের সঙ্গে আমাদের প্রাথমিকভাবে বৈঠক হয়েছে। আমরা বিষয়গুলো শেয়ার করেছি। আমাদের প্রত্যাশাগুলো তাদের জানিয়েছি। সব মিলিয়ে সংস্কারের কাজ চলমান আছে। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া। আবারও হয়তো আমাদের সঙ্গে তারা বসতে পারে। অন্যান্য অংশীজনের (স্টেকহোল্ডার) সঙ্গেও হয়তো তারা বসবে। বসতে চায়। এক কথায় জনগণের স্বার্থ যাতে ক্ষুণ্ন না হয়, সেভাবেই সংস্কারের প্রত্যাশা আমাদের এবং সবার।’

 

পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন গত ১৮ নভেম্বর সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘গত অক্টোবর মাসের ৬ তারিখ থেকে কমিশনের কাজ শুরু হয়েছে। মোটামুটি কাজ মাঝামাঝি পর্যায়ে রয়েছে। এ পর্যায়ে প্রাথমিক আলোচনা শেষে একটা খসড়াও তৈরি করা হয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে কী ধরনের বিষয়গুলো যাবে— সেগুলো নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে স্বল্প সময়ে বাস্তবায়নযোগ্য কিছু বিষয় আছে। কিছু বিষয় সংস্কারে দীর্ঘ সময় লাগবে। কিছু ক্ষেত্রে অর্থের বিষয় জড়িত। কোনও কোনও ক্ষেত্রে সরকারের আইন ও বিধি-বিধান পাল্টাতে হবে। খসড়া প্রতিবেদনের সুপারিশে সে বিষয়গুলো রয়েছে। বিশেষ করে পলিশ ভেরিফিকেশনে রাজনৈতিক পরিচয় না দেখার বিষয়ে কমিশনের সব পক্ষই একমত হয়েছে বলে তিনি জানান।

 

পুলিশ কমিশনের সদস্য ও মানবাধিকার কর্মী এ এস এম নাসির উদ্দিন এলান বলেন, তারা অনেকগুলো বৈঠক করেছেন। তবে কোনও কিছু চূড়ান্ত না হওয়ায় এ বিষয়ে তিনি বিস্তারিত কিছু বলতে চাননি।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual5 Ad Code