প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৪ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৩শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের মাঝে এত চাপ কীসের

editor
প্রকাশিত জানুয়ারি ২০, ২০২৫, ১১:০৫ পূর্বাহ্ণ
মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের মাঝে এত চাপ কীসের

Manual2 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

‘আমার বন্ধুদের সঙ্গে আমি বাইরে যাবো, মা যেতে দেবেন না। সবাই তো বাইরে যায়, কোচিংয়ের পরে কফি শপে বসে, আমি না বসলে ওরা আমাকে বুলিং করে। তখন বাসায় ফিরে মায়ের সঙ্গে বেঁধে যায়— আমি জিদ করে এমন অনেক কিছু করি, যা করা উচিত নয়। সেটা পরে বুঝতে পারি। আবার মায়েরও বুঝতে হবে, আমি বড় হচ্ছি।’ কথাগুলো বলছিল ১৭ বছর বয়সী এক কিশোর। জীবনের ছোট ছোট ‘না-পাওয়া’ নিয়ে কথা বলার এক ফাঁকে সে জানায়, ‘আমার এক বন্ধু আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে দুইবার। ওর সাহস অনেক।’

Manual3 Ad Code

জরিপ বলছে, মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি। আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপের তথ্যমতে, দেশে ২০২৪ সালে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পর্যায়ে ৩১০ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন— যার মধ্যে ৪৬ দশমিক ১ শতাংশই মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থী। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালের আত্মহত্যার তথ্য বিগত বছরগুলোর সঙ্গে তুলনা করেছে তারা। সেখানে দেখা যায়, ২০২২ সালে দেশে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আত্মহত্যাকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৫৩২ জন। ২০২৩ সালে ছিল ৫১৩ জন। সদ্য বিদায়ী ২০২৪ সালে আত্মহত্যাকারী মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩১০ জন। তাদের মধ্যে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রয়েছেন। সমাজবিশ্লেষকরা বলছেন, এ সময়টা বয়ঃসন্ধিকাল। কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে নানা ধরনের পরিবর্তন ঘটে। যারা সেই পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে যৌক্তিক আচরণ শিখতে পারেন না, তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।

কী ধরনের চাপের মুখোমুখি হতে হয় এই বয়সী সন্তানদের। এই চাপ কি এখন নতুন, নাকি আগেও সমাজে এ ধরনের চাপ বিদ্যমান ছিল— এই আলাপে অভিভাবক ও সন্তানদেরও অংশ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন তারা।

আমাদের প্যারেন্টিংয়ের জায়গায় কোনও সমস্যা তৈরি হচ্ছে কিনা, প্রশ্নে ‘শৈশব’ এর উদ্যোক্তা ফারহানা মান্নান বলেন, ‘এক ধরনের কমিউনিকেশনের গ্যাপ সন্তান ও অভিভাবকের মধ্যে তৈরি হয়েছে। একেকটা বয়সের শিশু কেমন হবে, অভিভাবকেরা হয়তো মোটা দাগে সেটা বোঝেন, কিন্তু সেই জার্নির জন্য কী ধরনের প্রস্ততি নিতে হবে, সেই আলাপ-আলোচনায় গ্যাপ আছে। ধরুন, মাধ্যমিকে যে বয়সটায় সন্তান কাটায়, সেসময় তার সঙ্গে অনেককিছু ঘটে, যা সে হয়তো বলতে পারে না। অভিভাবকের রি-অ্যাকশন এড়াতে চায় বলেই বলে না। কিন্তু এটা উভয়পক্ষকেই বুঝতে হবে যে, অভিভাবকদের রিঅ্যাকশন যেমন স্বাভাবিক, সন্তান যে সবকিচূ বলবে না, সেটাও স্বাভাবিক। কিন্তু এই পরিস্থিতিটা নিয়ে উভয়কেই কথা বলতে হবে। যাতে কমন একটা জায়গা তাদের মধ্যে থাকে।’

তিনি বলেন, ‘‘আমরা প্যারেন্টিংয়ের ক্ষেত্রে সব সময় সন্তানের ‘বন্ধু’ ও ‘বন্ধুসুলভ সম্পর্ক’ এসব শব্দ বলে থাকি। তাই বলে কি, বন্ধুকে আমরা সব বলি? আসলে উভয়পক্ষই পরস্পরকে সবকিছু বলবে না। এটা বুঝে নিয়ে সন্তানের কনফিউশনের জায়গাগুলোতে সে যেন অভিভাবককে আশ্রয়স্থল মনে করতে পারে, সেই পরিবেশ তৈরি করাটা জরুরি। সন্তানকে সবক্ষেত্রে জয়ী হতে হবে, সবকিছুর কেন্দ্রে থাকার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে, সবকিছুতে সেরা হবে— এ ধরনের চাপ থেকে সন্তানকে মুক্ত রাখা খুব দরকার।’’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরিন অনেক ধরনের চাপের উল্লেখ করতে গিয়ে বলেন, ‘বয়ঃসন্ধিকালে শিক্ষার্থীরা মানসিক সংকটে থাকে, আগেও ছিল। কিন্তু এখন এত ব্যক্তিকেন্দ্রিক জীবন হয়ে গেছে যে, সে তার মাঝে তৈরি হওয়া হতাশা, কনফিউশন কোথাও গিয়ে শেয়ার করতে পারে না। আগে সে খেলার মাঠে খেলা ও সাথীদের মধ্য দিয়ে অনেককিছু থেকে রিলিফ পেতো। এখন তার সঙ্গী কম্পিউটার। একজন শিক্ষার্থী এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে যেন পারে— সে কারণে স্কুল ও কলেজে সাইকোলজিস্ট, কাউন্সিলর থাকার কথা বলা হয়, যেটা আমাদের দেশে নেই। আমরা মনে করি, ওরা ছোট, ওদের এসব কী দরকার। কিন্তু মানুষ সংকট কীভাবে কাটিয়ে উঠবে, কারও সঙ্গে সেটা শেয়ার করা দরকার।’

Manual7 Ad Code

বর্তমান সময়ে পরিবারের সঙ্গে দ্বন্দ্বটা বেশি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আগে অভিভাবক-সন্তান রোমান্টিসাইজ সম্পর্ক ভেবেছি। এখনকার ক্রাইসিস হচ্ছে অভিভাবকের সঙ্গে বোঝাপড়া না হওয়া।’

Manual2 Ad Code

আঁচল ফাউন্ডেশনের সভাপতি তানসেন রোজকে মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে চাপের ধরন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ‘বয়ঃসন্ধিকালে নানা ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সে সময় সমাজের সঙ্গে বোঝাপড়ায় সমস্যা হয়। এসময় আবেগের জায়গাগুলো সামলাতে পারে না। পরিবারে মান-অভিমান হয়, অভিভাবকের সঙ্গে জেনারেশন গ্যাপ তৈরি হয়।’

তানসেন রোজ বলেন, ‘‘এই বয়সী শিশু-কিশোরের মাঝে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নেগেটিভ প্রভাব আছে। অনেক সময় গণমাধ্যমে আত্মহত্যার সংবাদ প্রকাশের বিষয়টি তারা ‘সাহসের ব্যাপার’ বলে চিহ্নিত করেও ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে।’’

মনোরোগ বিশ্লেষক আতিকুল ইসলাম চাপের প্রধান কারণ ‘প্যারেন্টাল প্রেসার’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘অভিভাবকদের এক্সপেকটেশন সন্তানের মাঝে সংক্রমিত করার প্রবণতা আছে। শিশুদের ভবিষ্যতের ওপর নিজেদের ভবিষ্যৎ চাপিয়ে দেন অভিভাবকেরা। সেই চাপ সহ্য করা তার জন্য কঠিন হচ্ছে কিনা, সেটা বিবেচনায় না নিয়ে মনে করেন— যা করছেন সন্তানের ভালোর জন্য করছেন।’ তার কাছে বয়ঃসন্ধিকালের যে কেসগুলো আসে, সেগুলোর বেশিরভাগই অভিভাবকের সঙ্গে বোঝাপড়ার সমস্যা থেকে তৈরি বলে তিনি জানান।

Manual7 Ad Code

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual8 Ad Code