প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৫ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৩০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৪শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

দেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নিয়ে মত-ভিন্নমত

editor
প্রকাশিত জানুয়ারি ২৫, ২০২৫, ১২:৫০ অপরাহ্ণ
দেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা নিয়ে মত-ভিন্নমত

Manual8 Ad Code

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

দেশে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা উপযোগী কি না, এ নিয়ে আলোচনা চলছে। ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের গঠিত একাধিক সংস্কার কমিটি বিভিন্ন খাতে সংস্কার আনতে কাজ করছে। এর মধ্যে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন দেশকে চারটি প্রদেশে ভাগ করার সুপারিশ করতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। বিষয়টির বাস্তবায়ন হলে প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকার নিয়ে ফেডারেল রাষ্ট্রকাঠামো তথা যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থা গঠিত হবে। গত ২০ বছরে নির্বাচনি ইশতেহারসহ নানা সভা-সেমিনারে রাজনীতিবিদসহ বিশেষজ্ঞরা এ বিষয়ে মত দিয়েছেন। আবার দেশের আয়তন, জাতি ও ভাষাগত বড় পার্থক্য না থাকায় অনেকেই এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেছেন।

এ বিষয়ে নির্বাচন সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমি এটার সঙ্গে একমত নই। কারণ এটা ব্যয়বহুল হবে। আমাদের দেশটা ছোট আর এত বৈচিত্র্য নেই। এটি বহু সমস্যা তৈরি করবে। এমনিতে আমাদের দেশে নির্বাচিত প্রতিনিধি নিয়ে সমস্যা। আরও নির্বাচনি প্রতিনিধি সৃষ্টি মানে আরও সমস্যা সৃষ্টি করা।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. দিল রওশন আরা জান্নাত বলেন, ‘এটি একটি অবাস্তব পরিকল্পনা। এত ছোট একটা দেশে কোন ক্রাইটেরিয়াতে দেশটা ভাগ হবে? ভাগ করতে হলে একটা ক্রাইটেরিয়া লাগে। আমাদের দেশ তো একসঙ্গে লাগানো। এখানে তো দূরত্বের কিছু নেই। মানুষের মধ্যেও বিভেদ নেই। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী বা উপজাতির সংখ্যা এক ভাগের নিচে।’

তিনি বলেন, ‘বিকেন্দ্রীকরণের জন্য প্রদেশ করার দরকার পড়ে না। স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করলে এমনিতেই করা যায়। আমাদের যে কাঠামো সেখানে যদি উপজেলা পরিষদকে শক্তিশালী করি, ইউনিয়নকে শক্তিশালী করি, অটোমেটিকালি বিকেন্দ্রীকরণ হয়ে যায়। প্রদেশ করার বিষয়টি অদূরদর্শী পরিকল্পনা।’

Manual3 Ad Code

বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায়ও। দলটির নেতারাও এটাকে অবাস্তব হিসেবে দেখছেন। প্রদেশ করলে আঞ্চলিক গোষ্ঠীর উদ্ভব হতে পারে, যা কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে অনেক সময় নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হতে পারে। পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে এ রকম উদাহরণ রয়েছে।

Manual2 Ad Code

যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকারব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সংবিধান অনুযায়ী বণ্টন করা থাকে। যুক্তরাজ্যের লেখক ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আলবার্ট ভেন ডাইসির মতে, ‘যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এমন এক কাঠামো, যেখানে জাতীয় সরকারের সঙ্গে প্রাদেশিক সরকারের অধিকারের সামঞ্জস্যপূর্ণ সমন্বয় সাধন সম্ভব হয়।’ এই ক্ষমতার বণ্টনটা এমনভাবে হয়, প্রত্যেকেই নিজ এলাকায় স্বতন্ত্রভাবে কাজ করতে পারে। সেখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কেন্দ্রের হাতে ন্যস্ত থাকে। বাকি বিষয়গুলো স্ব স্ব প্রাদেশিক সরকারের কাছে থাকে।’

পৃথিবীর ৭টি বৃহৎ ফেডারেল কাঠামোর রাষ্ট্র হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, কানাডা, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও আর্জেন্টিনা। এই দেশগুলোতে ফেডারেল ধরনের সরকারব্যবস্থা চালু রয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে সুলতানী আমল, মোগল, ব্রিটিশ আমলেও এ ধরনের প্রাদেশিক সিস্টেম চালু ছিল। বর্তমান ভারতে ২৮ রাজ্য ও ৮টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল রয়েছে। যেখানে জনসংখ্যা ১৪৬ কোটির বেশি। আয়তন ৩২ লাখ ৮৭ হাজার ২৬৩ বর্গকিলোমিটার। অন্যদিকে বাংলাদেশের চেয়ে কম আয়তন ও জনসংখ্যার দেশ নেপালেও সাতটি প্রদেশ রয়েছে। আমাদের দেশের শাসনকাঠামো বা প্রশাসনিক স্তর নিচের দিক থেকে ওপরের দিকে ইউনিয়ন, পৌরসভা, উপজেলা, জেলা পরিষদ, সিটি করপোরেশন- এসব ভাগে বিভক্ত। আর ৬৪ জেলা ৮ বিভাগের আওতাধীন। এতে উন্নয়নের সুষম বণ্টন হয় না বলে মনে করেন অনেকে। অধিকাংশ কার্যক্রম রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক। ফলে রাজধানীতে জনসংখ্যার চাপ বাড়ছে। প্রতি বর্গকিলোমিটারে গড়ে ৪৪ হাজার ৫০০ লোকের বসবাস।

Manual6 Ad Code

প্রাদেশিক সরকারের পক্ষে জোরালো অবস্থান ব্যক্ত করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক রবিউল ইসলাম। বিভিন্ন দেশের সংবিধান অধ্যয়ন এবং উচ্চতর ডিগ্রি ও গবেষণার সূত্রে বিষয়টি সম্পর্কে তিনি বিশদ অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তিনি বলেন, ‘অনেকে মনে করেন বাংলাদেশ একটা ছোট স্টেট (রাষ্ট্র) আর ভারত একটা বড় স্টেট (রাষ্ট্র)। ছোট স্টেটে ফেডারেল স্ট্রাকচার থাকতে পারে না। এটা একটা প্রাথমিক ধারণা। আসলে সুইজারল্যান্ডের মতো ছোট দেশ, যেখানে লোকসংখ্যা অল্প, সেখানেও ভাগ (ক্যানটন) আছে। একটা রাষ্ট্র মানুষকে শাসন করে, তার ভূমিকে নয়। জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। ফেডারেল স্ট্রাকচারে ভাগ না করলে কখনো সুশাসন দেওয়া যাবে না। আজকে না করলেও আগামী ২০ বছর পরে হলেও এটা করতে হবে। এটা লাগবেই।’

তিনি বলেন, ‘ফেডারেল স্ট্রাকচার এক জিনিস, বিকেন্দ্রীকরণ আরেক জিনিস। বর্তমান কাঠামোতে দায়িত্বের বিকেন্দ্রীকরণ আছে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। আমরা ২০০০ সাল থেকে দেখে আসছি যারা ক্ষমতায় যায় তারা একচেটিয়া যায়। এর অন্যতম কারণ পলিটিক্যাল ফেয়ার কম্পিটিশন হয় না। যদি ফেডারেল গভর্নমেন্ট থাকত, তাহলে নর্থ বেঙ্গলের জন্য আলাদা অনেক স্ট্রং পলিটিক্যাল পার্টি হতো। সেই পলিটিক্যাল পার্টির সঙ্গে সেন্ট্রাল পার্টির ফাইট করে জিততে হতো। এটা সেন্ট্রাল লেভেলে পার্টিকে স্ট্রং করত, জবাবদিহির জায়গা বাড়ত। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করলে জবাবদিহি তৈরি হতো। দায়িত্বের বিকেন্দ্রীকরণ করলে জবাবদিহির জায়গা থাকে না। সেন্ট্রালের (কেন্দ্রের) হাতে সব ক্ষমতা থাকলে সেখানে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় না।’

দেশের বর্তমান ব্যবস্থায় সম্পদের সুষম বণ্টন হয় না উল্লেখ করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন জাকের পার্টির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও অর্থনীতির অধ্যাপক সায়েম আমির ফয়সাল। ২০২২ সালের ১৪ জুন এক বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘দেশের সব মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সমানভাবে নিশ্চিত করতে হলে প্রাদেশিক সরকার চালু করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে ৩৩ হাজার কোটি টাকা গত অর্থবছরে বরাদ্দ হলেও সমানভাবে কি দেশের ৬৪ জেলায় বণ্টন হয়েছে? আমার জেলা ফরিদপুরে ব্যয় করা হয়নি, এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি। ফরিদপুরে সমবণ্টন হলে ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হতো, তাহলে ১০-১৫টি আইসিইউ বেড করা যেত, হাসপাতালের মানোন্নয়ন করা যেত। কিন্তু সেটা হয়নি।’

জাতীয় পার্টির সাবেক চেয়ারম্যান প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ একসময় এ নিয়ে একটা রূপরেখা দিয়েছিলেন। তার দল জাতীয় পার্টির বেশ কয়েকটি নির্বাচনি ইশতেহারেও প্রদেশ করার কথা বলা হয়েছে। দলের সর্বশেষ ইশতেহারে উত্তরবঙ্গ প্রদেশ, বরেন্দ্র প্রদেশ, জাহাঙ্গীরনগর প্রদেশ, জাহানাবাদ প্রদেশ, জালালাবাদ প্রদেশ, চন্দ্রদ্বীপ প্রদেশ, ময়নামতি প্রদেশ, চট্টলা প্রদেশের কথা বলা হয়েছে। সরকার কাঠামো হবে দুই স্তরবিশিষ্ট। কেন্দ্রীয় সরকারকে বলা হবে ফেডারেল সরকার। থাকবে ৩০০ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য। আর প্রদেশ চালাবে প্রাদেশিক সরকার। থাকবে প্রাদেশিক সংসদ সদস্য। প্রতিটি উপজেলা কিংবা থানাকে প্রাদেশিক সরকারের আসন হিসেবে বিবেচনা করা হবে। ঢাকা থেকে কমপক্ষে ৫০ শতাংশ সদর দপ্তর প্রাদেশিক রাজধানীতে স্থানান্তর করা হবে বলে ইশতেহারে উল্লেখ করা হয়েছিল।

Manual6 Ad Code

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বাংলাদেশকে ন্যূনতম পাঁচটি প্রদেশে ভাগ করে একটি ফেডারেল কাঠামোর রাষ্ট্র করার পক্ষে অভিমত দিয়েছেন। নিজের একটি নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলে দুটি করে চারটি প্রদেশ ও বৃহত্তর ঢাকাকে নিয়ে আরেকটি প্রদেশ করা যেতে পারে। কেন্দ্রের হাতে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, সীমান্ত ও সমুদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা, যোগাযোগ ও বৈদেশিক সাহায্য-সহযোগিতার মতো বিষয়গুলো থাকবে। বাকি বিষয়গুলোতে কেন্দ্রের তত্ত্বাবধান থাকলেও প্রদেশগুলো ব্যবস্থাপনায় থাকবে।

এ ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণ করেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ। তার মতে, বাংলাদেশকে প্রদেশে বিভক্ত করা হলে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হবে। এ জন্য প্রাদেশিক সরকার ও কেন্দ্রের জন্য আলাদা সুযোগ-সুবিধার প্রয়োজন হবে। এসব না করে বর্তমান কাঠামোকে শক্তিশালী করে জনগণকে সুশাসন উপহার দেওয়া যাবে।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual2 Ad Code