প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২১শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৬ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১লা রজব, ১৪৪৭ হিজরি

ঐক্যে ফাটল কেন?

editor
প্রকাশিত ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২৫, ১২:২১ অপরাহ্ণ
ঐক্যে ফাটল কেন?

Manual5 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

নানা ইস্যুতে ফাটল ধরেছে অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া বিভিন্ন পক্ষের মধ্যে। অথচ আন্দোলনের সময়ে তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন জাতীয় ঐক্য তৈরি হয়েছিল। শেখ হাসিনার ভাষায়, ডান-বামের ঐক্য হয়েছিল। তবে জাতীয়, স্থানীয় ও ছাত্র সংসদ নির্বাচন, সংস্কার, নতুন রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠা এবং আন্দোলনের ভূমিকার প্রশ্নে তাদের মধ্যে এই মুহূর্তে বিরোধ বাড়ছে।

 

প্রতিদিনই পাল্টাপাল্টি মন্তব্য করছেন নেতারা। এ ছাড়া ছাত্রসংগঠনের দ্বন্দ্ব সংঘাতেও রূপ পাচ্ছে। তবে নজিরবিহীন ঐক্যের পর মাত্র ছয় মাসের মধ্যে কীভাবে তাতে ফাটল ধরল, তা নিয়ে নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কেউ বলছেন, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব; আবার কারও মতে, বিভিন্ন ইস্যুতে বিভিন্ন দল মতামত দেবে এটাই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। কেউ কেউ আবার এতে বড় রাজনৈতিক দলের নেতাদের দায়ও দেখছেন।

 

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরীর মতে, ‘আমাদের দেশের সবাই পলিটিকস করতে চায় এবং সবকিছু করতে চায়। দেশের জন্য নয়, জনগণের জন্য নয়, শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য।’ তিনি বলেন, ‘ক্ষমতাপিপাসু সবাই, ক্ষমতায় যেতে চায়। ক্ষমতায় গিয়ে দেশের জন্য কী করবে তার চেয়ে নিজেদের কথাটাই বেশির ভাগ চিন্তা করে।’

Manual8 Ad Code

 

সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম মনে করেন, বহুদলীয় গণতন্ত্রে বহুমত থাকবে। কিন্তু সেগুলো নিরসন হবে জনগণ দ্বারা। এটা হবে নিয়মের ভিত্তিতে। এটাই গণতান্ত্রিক ধারা।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন বলেন, ‘এই ঐক্যে ফাটলের পেছনে বড়দের দায় রয়েছে। বড় রাজনৈতিক দলের নেতাদের কঠিনভাবে কথা বলা ঠিক হয়নি। ছাত্রদের ক্রেডিট তাদেরকে দিতে হবে। আন্দোলনে তারাই আহত, নিহত হয়েছে। সক্রিয় ভূমিকা ছিল তাদের। আমরা সবাই সাপোর্ট দিয়েছি।’ ফের ঐক্যের সম্ভাবনা আছে কি না এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘বড় ধরনের কোনো কিছু হলে আবারও ঐক্য দেখতে পারি। এটাই মানুষের স্বভাব।’

Manual8 Ad Code

 

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন গণবিস্ফোরণে রূপ নেয়। বিশেষ করে যখন শিক্ষার্থীদের গুলি করে হত্যা করা হয়, তখনই অভিভাবকরা রাজপথে নেমে আসেন। দীর্ঘদিনের অনিয়ম-ক্ষোভের কারণে রাজনৈতিক দলগুলোও এতে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন করে। তা ছাড়া তিনটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের কারণে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন ১০ বছর ধরে চলমান ছিল। আর ভোট দিতে না পারায় সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ছিল ক্ষোভ। এই ক্ষোভের সঙ্গে কোটাবিরোধী আন্দোলনে ছাত্রসমাজ ঝাঁপিয়ে পড়ায় নজিরবিহীন গণ-অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতন ঘটে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন নিয়ে গঠন করা হয় অন্তর্বর্তী সরকার।

 

দেখা যায়, পরবর্তী দু-তিন মাস আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে ঐক্য ছিল। অভ্যুত্থানে হাসিনা পতনের মাসপূর্তিতে ‘শহিদী মার্চে’ও এই চিত্র দেখা যায়। ৫ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে অনুষ্ঠিত সেই কর্মসূচিতেও ছাত্র-জনতার ঢল নামে আগের মতো। এরপর ঐক্য দেখা যায় ফেনীর বন্যায়। চট্টগ্রামে মুসলিম আইনজীবীকে হত্যায় দেশ উত্তাল হলে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার আশঙ্কায় ঐক্য ধরে রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে সভা করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস।

 

এরই মধ্যে শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে সাক্ষাৎকার দেওয়ার পর রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ দাবি করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বঙ্গভবনের সামনে বিভিন্ন সংগঠন কর্মসূচি পালন করে। এ নিয়ে ভিন্নমত জানায় বিএনপি। এই ইস্যুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় করেন। কিন্তু বিএনপির বিরোধিতায় এই আলাপ বন্ধ হয় পরবর্তী সময়ে। বিএনপির না চাওয়ার কারণে জুলাই ঘোষণা নিয়ে পিছু হাঁটতে হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটিকে। অনেকের ধারণা, এসব ইস্যু নিয়ে মূলত বিএনপির সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের দূরত্ব বেড়েছে।

Manual6 Ad Code

 

অন্যদিকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক দল গঠন নিয়েও অন্যদের মধ্যে রয়েছে অস্বস্তি। সরকারে থেকে দল গঠন করলে মেনে নেওয়া হবে না বলে মন্তব্য করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এই ইস্যুতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিএনপি মহাসচিবের সমালোচনা করে স্ট্যাটাস দেন তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। বিএনপির অন্য নেতাদের পক্ষ থেকেও মন্তব্য আসে ছাত্রদের নতুন দল নিয়ে। সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নেও সরকারের সঙ্গে বিএনপির ভিন্নমত রয়েছে। সম্প্রতি স্থানীয় নির্বাচন জাতীয় সংসদের আগে না পরে, সে বিষয় নিয়ে পাল্টাপাল্টি মন্তব্য আসছে। স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনের কথা বলেছেন। অন্যদিকে এই নির্বাচনের দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের নয় বলে মনে করে বিএনপি।

 

অন্যদিকে বিএনপির সঙ্গে সরকারের যেসব নিয়ে ভিন্নমত, তা নিয়ে জামায়াতে ইসলামী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির প্রায় একই মত। ফলে বিএনপি-জামায়াত নেতাদের বক্তব্যে বিষয়টি প্রকাশ পাচ্ছে। আনুপাতিক হারে নির্বাচন নিয়ে বড় দুই দলের ভিন্নমত লক্ষ করা যাচ্ছে। বাম সংগঠনের পক্ষ থেকে সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে হতাশা প্রকাশ করা হয়।

 

তবে বেশি অনৈক্য দেখা যাচ্ছে ছাত্রসংগঠনের মধ্যে। ৫ আগস্টের পর ক্যাম্পাস ছাত্রলীগশূন্য। গণহত্যায় যুক্ত থাকায় নিষিদ্ধ করা হয় সংগঠনটিকে। এর মধ্যে অধিকাংশ ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ করা হয় ছাত্ররাজনীতি। তবে সীমিত পরিসরে কার্যক্রমের মাধ্যমে সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির। বেশি সক্রিয় ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। তাদের নতুন ছাত্রসংগঠন প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তে অন্য ছাত্রসংগঠনের মধ্যে বিরোধ বাড়ে। মূলত এই বিরোধের সূচনা হয় গত ৩ ডিসেম্বর। সেদিন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে শিক্ষার্থী প্রতিনিধি হিসেবে শুধু বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সমন্বয়করা মতবিনিময় করেন। পরের দিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মতবিনিময় সভায় যোগ দেয়নি ছাত্রদল। তারা আলাদাভাবে ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে মতবিনিময় করে।

 

Manual5 Ad Code

দূরত্ব বাড়ে ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের মধ্যেও। ছাত্রদলের পক্ষ থেকে শিবিরের বিরুদ্ধে গুপ্ত রাজনীতির কথা বলা হয়। তাদের কমিটির সব সদস্যের নাম প্রকাশ করার কথা বলা হয়। এ নিয়ে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতারা সর্বত্র কথা বলেন। রাজনীতি নিষিদ্ধ ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের ফরম বিতরণ নিয়ে বুয়েটে বৈষম্যবিরোধীদের সঙ্গে ছাত্রদলের সংঘাতেও এই অনৈক্য দেখা যায়। পাল্টাপাল্টি দোষারোপ করে বক্তব্য দেন দুই সংগঠনের নেতারা। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ছাত্রসংগঠনগুলোর এই দ্বন্দ্ব তাদের অবস্থান তৈরিকে কেন্দ্র করে। ছাত্রলীগশূন্য ক্যাম্পাসে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়ে পরিকল্পনা করছে ছাত্রসংগঠনগুলো। সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেও ছাত্রদলের এ নিয়ে অনাগ্রহ রয়েছে। জাহাঙ্গীরগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের বাধায় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করা হয়নি। এখনই ছাত্ররাজনীতি ইস্যুতে সেটেলমেন্টে না এলে সামনে ক্যাম্পাসগুলোতে ত্রিমুখী সংঘাত দেখা যেতে পারে, যা সাধারণ শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই চাইছেন না।

 

আন্দোলনে কার কী ভূমিকা, তা নিয়ে মতানৈক্য

 

জুলাই আন্দোলনে কার কী ভূমিকা, তা নিয়ে প্রতিনিয়ত নতুন তথ্য সামনে আনছেন আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। আন্দোলনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ কে এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য দিয়েছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তথা জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিলেও এতে বিভিন্ন মতের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল। এ জন্য অনেকে একক কৃতিত্বের চেয়ে সবাইকে কৃতিত্ব দেওয়ার পক্ষে।

 

 

অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের মধ্যে দূরত্ব বেড়েছে। সমন্বয়ক সাদিক কায়েমের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর নানা তথ্য উঠে আসে। ৯ দফা, ১ দফাসহ কর্মসূচি পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে তার সম্পৃক্ততার বিষয়টি বিভিন্ন সাংবাদিকদের বর্ণনায় আসে। আন্দোলনের কৃতিত্ব নিয়ে পাল্টাপাল্টি দাবি, ছাত্র উপদেষ্টাদের ফেসবুক স্ট্যাটাস, আন্দোলন-পরবর্তী বিভিন্ন কার্যক্রমসহ নানা কারণে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বও প্রকট হয়।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual3 Ad Code