কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি:
আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জেলায় ইতিমধ্যে সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রচার- প্রচারণা জোরেসোরেই শুরু হয়েছে। এবার কিশোরগঞ্জের ছয়টি আসনের মধ্যে সব কয়টিতে জয় পেতে চায় বিএনপি। একসময় এই জেলায় আওয়ামী লীগের আধিপত্য ছিল। দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকায় আওয়ামী লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণের কোনো সম্ভাবনা নেই। এই সুযোগটি পুরোপুরি কাজে লাগাতে চায় বিএনপি।
স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত কোনো নির্বাচনেই জামায়াতে ইসলামী এই জেলা থেকে কোনো আসনে জয়লাভ করতে পারেনি। জেলায় রাজনীতিতে তেমনভাবে সক্রিয়ও ছিল না দলটি। কিন্তু এবার তারা মাস খানেক আগেই ছয় আসনে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করে তাদের নির্বাচনী প্রচারণা জোরদার করেছে। প্রার্থী নির্বাচনেও জামায়াতে ইসলামী দলের মধ্যে কোনো অন্তর্দ্বন্দ্ব নেই।
অন্যদিকে, প্রতিটি আসনেই নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য বিএনপির অন্তত অর্ধ ডজন নেতা প্রচারণায় আছেন। কোনো কোনো আসনে প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে মিটিং-মিছিল ও মানববন্ধন হয়েছে । নির্বাচনী প্রচারণায় অন্যান্য দলের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ, গণঅধিকার পরিষদ, বাসদ ও এনসিপি।
কিশোরগঞ্জ-১ (কিশোরগঞ্জ-হোসেনপুর): কিশোরগঞ্জ পৌরসভাসহ কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন এবং হোসেনপুর পৌরসভাসহ হোসেনপুর উপজেলার ছয়টি ইউনিয়ন নিয়ে এই আসনটি গঠিত। এই আসন থেকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের ডা. জাকিয়া নূর লিপি, তিনি প্রয়াত সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের ছোট বোন। সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মারা যাওয়ার পর উপনির্বাচনে এই আসন থেকে ডা. জাকিয়া নূর লিপি নির্বাচিত।
আসন্ন সংসদ নির্বাচনের জন্য গত ৪ ডিসেম্বর জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মো. মাজহারুল ইসলামকে এই আসনে দলীয় প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দেয় বিএনপি । এই আসনে মনোনয়ন পেতে বিএনপির কমপক্ষে এক ডজন নেতা তদবির চালাচ্ছিলেন। এই আসন থেকে জামায়াতের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে জেলার সাবেক নায়েবে আমির অধ্যক্ষ মোসাদ্দেক ভূঁইয়াকে। এছাড়াও অন্যান্য দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা হলেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রফেসর হাফেজ মাওলানা আজিজুর রহমান জার্মানি, গণঅধিকার পরিষদের আবু হানিফ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মাওলানা মুহাম্মদুল্লাহ জামী ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাওলানা হেদায়েতুল্লাহ হাদী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির অ্যাডভোকেট এনামুল হক, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ ভূঁইয়া ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহনাফ সাঈদ খান।
কিশোরগঞ্জ-২ (কটিয়াদী-পাকুন্দিয়া): ১৯৭৩ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত শুধু কটিয়াদী উপজেলা নিয়ে গঠিত ছিল কিশোরগঞ্জ-২ আসন। ঐ সময়ে আট বারের নির্বাচনে তৎকালীন কিশোরগঞ্জ-২ (কটিয়াদী) আসনে চার বারই বিএনপি প্রার্থী জয়ী হয়েছিলেন। এর মধ্যে ১৯৭৩ সালে আওয়ামী লীগের মনোরঞ্জন ধর, ১৯৭৯ সালে বিএনপির আনিসুজ্জামান খোকন, ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টির অ্যাডভোকেট নূরুজ্জামান চাঁন মিয়া, ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির বীর মুক্তিযোদ্ধা বজলুল করিম ফালু, ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে বিএনপির বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান রঞ্জন বিজয়ী হন। ২০০১ ও ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের ডা. আব্দুল মান্নান, ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেট সোহরাব উদ্দিন, ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের নূর মোহাম্মদ ও ২০২৪ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী অ্যাডভোকেট সোহরাব উদ্দিন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
আসন্ন সংসদ নির্বাচনে এই আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেতে এক ডজন প্রার্থী তৎপর থাকলেও প্রাথমিকভাবে মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি ও জেলার পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট জালাল উদ্দিন। মনোনয়ন পেয়ে তিনি নির্বাচনি কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে তার মনোনয়ন বাতিলের দাবি জানিয়েছেন আহসান হাবিব বরুণ। এ আসনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী মাওলানা শফিকুল ইসলাম মোড়ল, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির আবদুর রহমান রুমি, গণঅধিকার পরিষদের শফিকুল ইসলাম শফিক, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাওলানা মুফতি আবুল বাশার রেজওয়ান, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাওলানা শফিকুল ইসলাম ব্রহানী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের মাওলানা শ আহমদ জাহাঙ্গীর হোছাইনী, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) পাকুন্দিয়া উপজেলার আহ্বায়ক আশরাফ উদ্দিন মেনু।
কিশোরগঞ্জ-৩ (করিমগঞ্জ-তাড়াইল): করিমগঞ্জের একটি পৌরসভা ও ১১টি ইউনিয়ন এবং তাড়াইলের ৭টি ইউনিয়ন মিলে গঠিত এই আসন। এই আসন থেকে ১৯৭৩ সালে জয়ী হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের এম এ কুদ্দুস, ১৯৭৯ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. এম ওসমান গণি, ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু, ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের ড. মিজানুল হক ও ২০০১ সালে বিএনপির ড. এম ওসমান ফারুক । এর পর থেকেই আসনটি মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু তার দখলে নেন । এছাড়া ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনে বিএনপির কবির উদ্দিন আহমেদ জয়লাভ করেছিলেন। এই আসনে বিএনপি থেকে প্রাথমিক মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ড. এম ওসমান ফারুক। অন্যদিকে এ আসনে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী কর্নেল (অব.) অধ্যাপক ডা. জেহাদ খান। তিনি সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদের শ্যালক। এছাড়া এই আসনে অন্যান্য দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা হলেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের হাফেজ মাওলানা আলমগীর হোসাইন তালুকদার, কমিউনিস্ট পার্টির আলী আকবর রাজ্জাকী, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) খায়রুল কবির, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাওলানা জুবায়ের আহমাদ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মাওলানা আবু বকর সিদ্দিক এবং খেলাফত মজলিসের প্রভাষক আতাউর রহমান শাহান।
কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা মিঠামইন-অষ্টগ্রাম): হাওর অধ্যুষিত ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার ২৪টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এই আসন থেকে সাত বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তিনি দেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি হলে এ আসনটি শূন্য হয়। রাষ্ট্রপতির বড় ছেলে প্রকৌশলী রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক উপনির্বাচনে দলীয় মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হন। পরে ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত টানা তিনটি সংসদ নির্বাচনেই রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক এমপি নির্বাচিত হন। আসন্ন নির্বাচনে এই আসনে বিএনপির দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন দলটির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা (বর্তমানে পদ স্থগিত) বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী ফজলুর রহমান ছাত্র রাজনীতি থেকে শুরু করে তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে নানা নাটকীয়তায় বিভিন্ন সময় আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন। সম্প্রতি তার ‘বঙ্গবন্ধু প্রীতি’, জামায়াতে ইসলামী এবং রাজাকার বিষয়ে বিভিন্ন মন্তব্যের কারণে ধর্মভিত্তিক দলগুলোর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এ আসনে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরা অ্যাডভোকেট ফজলুর রহমানকে ‘বিতর্কিত ব্যক্তি’ হিসেবে উল্লেখ করে তার প্রাথমিক মনোনয়ন বাতিলের দাবি জানিয়েছেন। এই আসন থেকে জামায়াতের প্রার্থী হয়েছেন অ্যাডভোকেট রোকন রেজা। এছাড়া এই আসনে সম্ভাব্য প্রার্থীদের তালিকায় আছেন ইসলামী আইনজীবী পরিষদের অ্যাডভোকেট বিল্লাহ আহমাদ মজুমদার, জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সাখাওয়াত হোসেন খান, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাওলানা খায়রুল ইসলাম ঠাকুর, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের শায়খ মাওলানা আনোয়ারুল ইসলাম এবং এনসিপির আকরাম হোসেন রাজ ও মুরাদ মিয়া।
কিশোরগঞ্জ-৫ (বাজিতপুর-নিকলী): এ আসনে বিএনপির ডজনখানেক নেতা মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। গত ৪ ডিসেম্বর এই আসনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান ইকবালের নাম ঘোষণা করা হয়। এই আসনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী মনোনীত হয়েছেন জেলা জামায়াতের আমির অধ্যাপক রমজান আলী। এছাড়া, এই আসন থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক সৈয়দ এহসানুল হুদাও মাঠে ব্যাপক প্রচারণা চালাচ্ছেন। তিনি ছাড়াও বাংলাদেশ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সভাপতি সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হাসনাত কাইয়ুন ও আলোচনায় রয়েছেন। অন্যান্য দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরা হলেন কমিউনিস্ট পার্টির অধ্যাপক ফরিদ আহাম্মদ, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দলের (বাসদ) সাজেদুল ইসলাম সেলিম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাওলানা দেলোয়ার হোসাইন কাসেমী, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মাওলানা মুফতি মুহাম্মদ উল্লাহ আমিন।
কিশোরগঞ্জ-৬ (ভৈরব-কুলিয়ারচর): এই আসন থেকে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান স্বাধীনতার পর পাঁচ বার সংসদ সদস্য নির্বাচত হন । ২০০৯ সালে তিনি দেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলে শূন্য আসনে তার ছেলে সাবেক বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন উপনির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে প্রথম বারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এই আসনে জেলা বিএনপির সভাপতি মো. শরীফুল আলম দলীয় মনোনয়ন পেয়ে তিন বার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও একবারও তিনি বিজয়ী হতে পারেননি। আসন্ন সংসদ নির্বাচনেও শরীফুল আলম বিএনপির দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। এখানে দলীয় কোনো রকম কোন্দল নেই । এই আসনে জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী মাওলানা কবির হোসাইন, কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থী ডা. হাবিল বাঙালি, ইসলামী শ্রমিক আন্দোলন বাংলাদেশের আলহাজ মো. মুসা খান, এনসিপির আরিফুল ইসলাম।
Sharing is caring!