প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৯শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৪ঠা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৮শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

টিনের ঘর থেকে উঠে আসা এক বিপ্লবী, হাদির বাড়িতে আর্তনাদ

editor
প্রকাশিত ডিসেম্বর ১৯, ২০২৫, ১০:৩৭ পূর্বাহ্ণ
টিনের ঘর থেকে উঠে আসা এক বিপ্লবী, হাদির বাড়িতে আর্তনাদ

Manual1 Ad Code

 

ঝালকাঠি প্রতিনিধি:

ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র ও ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য প্রার্থী শরিফ ওসমান হাদির হত্যাকাণ্ড শুধু একটি রাজনৈতিক হত্যা নয়- এটি একটি সময়, একটি চেতনা ও একটি সম্ভাবনাকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা বলে মনে করছেন তার সহযোদ্ধা, প্রতিবেশী ও তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা। তার মৃত্যুর পর ঝালকাঠির নলছিটি পৌর শহরের খাসমহল এলাকাজুড়ে নেমে এসেছে শোক, ক্ষোভ ও আর্তনাদ।

Manual3 Ad Code

 

হাদির বাড়ির সামনে দাঁড়ালে চোখে পড়ে এক নিঃশব্দ সরু পথের পাশে একটি ছোট টিনের ঘর। যেখানে জন্মেছিলেন শরিফ ওসমান হাদি। কোনো অট্টালিকা নয়, কোনো বিলাসিতা নয়। এই সাধারণ টিনের ঘর থেকেই উঠে এসেছিলেন তিনি। যিনি ঢাকার রাজপথের শাহবাগসহ বিভিন্নস্থানে দাঁড়িয়ে কথা বলেছিলেন বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী রাজনীতি এবং নতুন রাষ্ট্রচিন্তার পক্ষে। ওই বাড়িতে আবেগ জড়িত কণ্ঠে এলাকাবাসীদের বলতে শোনা যায়, বিপ্লবীরা বড় অট্টালিকা থেকে আসে না।

হাদির মৃত্যুসংবাদ ছড়িয়ে পড়ার পরপরই গতরাত থেকে নলছিটির খাসমহল এলাকায় তার বাড়িতে ছুটে আসছেন আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী, সহপাঠী ও শুভানুধ্যায়ীরা। কান্না, আহাজারি আর নিস্তব্ধতায় পুরো এলাকা হয়ে ওঠে ভারী। অনেকেই বাকরুদ্ধ, কেউ কেউ আবার ক্ষোভে ফেটে পড়েন।

 

Manual1 Ad Code

নিরাপত্তাজনিত কারণে বৃহস্পতিবার রাতে হাদির পরিবারের সদস্যরা কারও সঙ্গে সাক্ষাৎ বা কথা বলেননি। পুলিশ জানিয়েছিল, পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায় পরিবারটির সঙ্গে যোগাযোগ সীমিত রাখা হয়েছিল। শুক্রবার সকালে কেবল সংবাদকর্মীরা বাড়িতে ঢুকে তথ্য সংগ্রহের সুযোগ পান।

বর্তমানে বাড়িতে অবস্থান করছেন হাদির বোন মাছুমা সুলতানা বিন হাদি ও তার ভগ্নিপতি আমির হোসেন। শোকাহত পরিবারটির পাশে থাকতে দূর-দূরান্ত থেকে স্বজনেরা বাড়িতে জড়ো হচ্ছেন। জড়ো হচ্ছেন সামাজিক, রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা।

 

শুক্রবার (১৯ ডিসেম্বর) সকালে নলছিটির খাসমহল এলাকায় প্রতিবেশী ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা একযোগে দাবি জানান, শরিফ ওসমান হাদির জীবনী জাতীয় পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।

তাদের মতে, হাদির জীবন নতুন প্রজন্মের জন্য একটি রাজনৈতিক পাঠ। তিনি শিখিয়েছেন বিপ্লব মানে শুধু জীবন দেওয়া নয়, বরং নিজেকে তৈরি করা, যোগ্য হওয়া এবং দীর্ঘ লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত থাকা।

এদিকে হত্যাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবিতে বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) রাত সাড়ে ১১টা থেকে ঝালকাঠি শহরের কলেজ মোড় এলাকায় ঢাকা-ঝালকাঠি মহাসড়ক অবরোধ করে ব্লকেড কর্মসূচি পালন করেন জুলাই যোদ্ধা, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), গণ অধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা।

রাত পৌনে ২টা পর্যন্ত চলা এই অবরোধে ঢাকা, বরিশাল, খুলনা ও দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন রুটের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এতে যাত্রী ও সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়লেও আন্দোলনকারীরা জানান, ন্যায়বিচারের প্রশ্নে এই ভোগান্তি অনিবার্য।

Manual8 Ad Code

হাদির হত্যাকাণ্ড নিছক ব্যক্তিগত বা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। ৫ আগস্টের পর গড়ে ওঠা নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় তিনি ছিলেন একটি বিকল্প কণ্ঠস্বর। ইনকিলাব মঞ্চ ও ইনকিলাব কালচারাল সেন্টারের মাধ্যমে তিনি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের সমন্বয় ঘটান, যা প্রচলিত সমাজ ও রাস্ট্র কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে পারতো। হাদি এমন রাজনীতি করছিলেন, যা দলীয় সীমানার বাইরে গিয়ে তরুণদের ভাবাতে শুরু করেছিল। এই জায়গাটাই তাকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে।

 

শরিফ ওসমান হাদি জন্মগ্রহণ করেন ১৯৯৩ সালে। তিনি মরহুম শরীফ মাওলানা আব্দুল হাদির ছেলে। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন কনিষ্ঠ। বড় ভাই ড. মাওলানা মুফতি আবু বক্কর ছিদ্দিক বরিশাল বাঘিয়া আল আমিন কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ ও গুঠিয়া জামে মসজিদের খতিব। মেজো ভাই ওমর ফারুক ঢাকায় একজন ব্যবসায়ী।

 

হাদির প্রতিবাদী চেতনা হঠাৎ করে জন্ম নেয়নি। তার বাবা মরহুম মাওলানা আব্দুল হাদি নিজেও ছিলেন একজন প্রতিবাদী মানুষ। অন্যায় ও অসত্যের সঙ্গে কখনো আপস করেননি তিনি। মাদ্রাসার শিক্ষকতা, ধর্মীয় দায়িত্ব আর সামাজিক ভূমিকার পাশাপাশি অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা ছিল তার স্বভাব। সেই আদর্শই ছোটবেলা থেকেই হাদির ভেতরে গেঁথে দেন তিনি। হাদির বাবা ছিলেন নীরব প্রতিবাদী। মুখে কম বলতেন, কাজে বেশি দেখাতেন। হাদি সেই শিক্ষাকেই রাজনীতিতে নিয়ে গিয়েছিল।

ওসমান হাদির ভগ্নিপতি আমির হোসেন বলেন, ওসমান হাদি একা কোনো ব্যক্তি ছিল না। সে ছিল একটি চেতনার নাম। শরিফ ওসমান হাদি কেবল একজন মানুষ নন, তিনি এক অবিনাশী চেতনা। আজ আমরা যেসব নিরাপত্তা, পাহারা আর রাষ্ট্রীয় সমবেদনা দেখছি, এসব জীবিত ওসমানের জন্য প্রয়োজন ছিল। রাষ্ট্র যদি সময়মতো ওসমানদের চিনতে পারত, তাহলে আজ ইতিহাস অন্যরকম হতো। শত্রুরা ভেবেছিল গুলি দিয়ে ইতিহাস থামিয়ে দেবে, কিন্তু তারা জানত না হাদিকে হত্যা করা যায় না। কারণ সে একা নয়, সে লক্ষ কোটি কণ্ঠের নাম। আমাদের স্পষ্ট দাবি, রাষ্ট্রীয়ভাবে ওসমান হাদিকে বাংলার বীর হিসেবে ঘোষণা করতে হবে।”

ঝালকাঠি-২ আসনের বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী মনোনীত প্রার্থী শেখ নেয়ামুল করিম বলেন, হাদির রাজনীতি ছিল নৈতিকতার রাজনীতি, আপসহীন আদর্শের রাজনীতি। শরিফ ওসমান বিন হাদি আমাদের দেখিয়েছেন রাজনীতি মানে শুধু ক্ষমতা নয়, রাজনীতি মানে নৈতিক সাহস ও সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো। তার বুকেই আমরা বাংলাদেশকে দেখেছি, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অদম্য সাহসকে দেখেছি। এই হত্যাকাণ্ড প্রমাণ করে, সৎ রাজনীতি এখনো কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী এভাবে কোনো চেতনাকে হত্যা করা যায় না।

Manual1 Ad Code

জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) জেলা যুগ্ম সমন্বয়ক মুফতি মাসুম বিল্লাহ বলেন, এটি শুধু একজন মানুষ হত্যার ঘটনা নয়, এটি একটি রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার চেষ্টা। তারা ভেবেছিল ভয় দেখিয়ে প্রতিবাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেবে। কিন্তু শরিফ ওসমান বিন হাদি ব্যক্তি নন, তিনি এক মহাকাব্য। হাদি এখন আর একজন মানুষের নাম নয় তিনি লক্ষ কোটি মানুষের চেতনা। তুমি নাই, এই মিথ্যা আমরা মানি না; তুমি আছো প্রতিটি প্রতিবাদে, প্রতিটি বিদ্রোহী শ্বাসে, প্রতিটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মেরুদণ্ডে।

স্থানীয় একজন আলেম মাওলানা ওমর ফারুক আবু হানিফ বলেন, হাদীর মৃত্যু আমাদের দায় আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি চলে যাননি, তিনি আমাদের কাঁধে দায়িত্ব রেখে গেছেন। শরিফ ওসমান বিন হাদি আজ ব্যক্তি নন, তিনি উপাখ্যান-এক মহাকাব্য, যা লেখা হচ্ছে রক্তে, সাহসে আর অবিরাম প্রতিরোধে। তার অসমাপ্ত কাজ আমাদের শেষ করতেই হবে, অন্যথায় এই হত্যার দায় ইতিহাস আমাদের ঘাড়েই চাপাবে।

ওসমান হাদির বাবার ছাত্র মনজুরুল হাসান সজীব বলেন, হাদির বাবার আদর্শের বাস্তব রূপ ছিলেন ওসমান হাদি। একজন শিক্ষক যেমন স্বপ্ন দেখেন, ঠিক তেমন করেই তার শিক্ষা বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন হাদি। তিনি ছিলেন শিক্ষকের শিক্ষার সফল ফল। শরিফ ওসমান হাদি প্রমাণ করে গেছেন মানুষ মরতে পারে, আদর্শ মরে না। আজ তাকে হারিয়ে আমরা বুঝেছি, কি বিশাল এক চেতনার ধারক ছিলেন তিনি।

হাদির প্রতিবেশী সাংবাদিক মো. শরিফুল ইসলাম পলাশ বলেন, এই ছোট একটি টিনের ঘর থেকে উঠে এসে যে মানুষ ঢাকায় দাঁড়িয়ে কথা বলেছে, তার মৃত্যু আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। অট্টালিকায় নয় এই টিনের ঘর থেকেই উঠে এসেছিল ওসমান হাদি। আমরা মানুষকে চিনতে দেরি করি, হারানোর পর স্মরণ করি। শরিফ ওসমান বিন হাদি আমাদের দেখিয়ে গেছেন সাহসের ঠিকানা বড় ঘর নয়, বড় মন আর দৃঢ় মেরুদণ্ড।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual2 Ad Code