প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৫ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৩০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৪শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

লাইলাতুল কদর: মহিমান্বিত ভাগ্যনির্ধারণী রজনী

editor
প্রকাশিত মার্চ ২৭, ২০২৫, ১০:৩৭ পূর্বাহ্ণ
লাইলাতুল কদর: মহিমান্বিত ভাগ্যনির্ধারণী রজনী

Manual3 Ad Code

-মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ আইয়ুবী

Manual8 Ad Code

 

আরবিতে লাইলাতুল অর্থ রাত। আর কদর শব্দটি দুই ধরনের অর্থসংবলিত। প্রথমত কদর অর্থ নির্ধারণ করা, সময় নির্দিষ্ট করা, সিদ্ধান্ত নেওয়া। অর্থাৎ লাইলাতুল কদর হলো সে রাত, যে রাতে আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক বস্তুর পরিমাণ ও সময় নির্দিষ্ট করেন, হুকুম জারি করেন এবং ভাগ্য নির্ধারণ করেন। এক কথায়, লাইলাতুল কদর অর্থ ভাগ্যনির্ধারণী রাত। যেমন আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেন, ‘হা-মিম, সুস্পষ্ট কিতাবের কসম! আমি এ কিতাব নাজিল করেছি এক বরকতপূর্ণ রাতে, নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। সে রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়, আমার নির্দেশে। নিশ্চয় আমি রাসুল প্রেরণকারী।’ সুরা দুখান : ১-৫

বর্ণিত আয়াত দ্বারা বোঝা যায়, কুরআন নাজিল হয়েছে যে বরকতময় রাতে, সে রাতেই প্রত্যেক বিজ্ঞতাপূর্ণ বিষয়ের ফয়সালা আল্লাহর নির্দেশক্রমে হয়ে থাকে। তাই এ রাত ভাগ্যনির্ধারণী রাত। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘এ রাতে ফেরেশতাগণ এবং জিবরাইল (আ.) তাদের রবের অনুমতিক্রমে প্রত্যেক হুকুম (ফয়সালা) নিয়ে নাজিল হয়।’ সুরা আল-কদর : ৪

 

এ আয়াত থেকেও বোঝা যায়, লাইলাতুল কদর হলো সৃষ্টিজগতের জন্য ভাগ্যরজনী। এ রাতে জ্ঞানপূর্ণ বিষয়ের নির্ধারণ ও আল্লাহর হুকুম নিয়ে ফেরেশতাদের অবতরণের অর্থ সম্পর্কে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, লাইলাতুল কদরে সৃষ্টিজগতের সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ফয়সালা স্থির করা হয়, যা পরবর্তী লাইলাতুল কদর পর্যন্ত সংঘটিত হবে।

 

দ্বিতীয়ত ‘কদর’-এর দ্বিতীয় অর্থ সম্মান, মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব। অর্থাৎ লাইলাতুল কদর এমন এক রাত, আল্লাহর কাছে যার বিরাট সম্মান-মর্যাদা ও ফজিলত রয়েছে। আর এ মর্যাদা এ রাতে কুরআন নাজিলের কারণে। এ রাতের সম্মান-মর্যাদা ও ফজিলত সম্পর্কে কুরআনের একটি সুরা অবতীর্ণ করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালার ঘোষণা, ‘নিশ্চয়ই আমি একে (কুরআন) নাজিল করেছি কদরের রাতে। আপনি কি জানেন, হে রাসুল (সা.)! কদরের রাত কী? কদরের রাত হলো হাজার মাসের চেয়েও উত্তম।

লাইলাতুল কদর কখন : লাইলাতুল কদর রমজান মাসেরই কোনো এক রাত। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘রমজান মাস যাতে কুরআন নাজিল করা হয়েছে।’ সুরা বাকারা : ১৮৫

আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি এ কুরআন নাজিল করেছি সম্মানিত এক রাতে।’ সুরা কদর : ৩

প্রতিবছর লাইলাতুল কদরে আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী হজরত জিবরাইল (আ.)-এর নেতৃত্বে ফেরেশতাগণ অবতরণ করেন। তারা পরবর্তী লাইলাতুল কদর পর্যন্ত কার ভাগ্যে কী ঘটবে, সে ভাগ্যলিপি নিয়ে পৃথিবীতে আসেন এবং যত মুমিন নারী-পুরুষ এ রাতে ইবাদতে মশগুল থাকে, তাদের জন্য দোয়া করেন।

এ দুটি আয়াত দ্বারা সাব্যস্ত হয়ে যায়, লাইলাতুল কদর রমজানেরই কোনো এক রাত। তবে সেটি কোন রাত সে সম্পর্কে বেশ কিছু হাদিস থাকলেও অকাট্যভাবে কোন রাত তা জানা সম্ভব হয়নি। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘রমজানের শেষ দশকে তোমরা লাইলাতুল কদর তালাশ করো।’ সহিহ বোখারি

এ থেকে রমজানের ২১ থেকে ২৯ রাতের মধ্যে লাইলাতুল কদর থাকার সংবাদ পাওয়া যায়। অন্য কয়েকটি সহি হাদিসে আরেকটু নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে, হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, রমজানের শেষ ১০ দিনের বিজোড় তারিখে তোমরা লাইলাতুল কদর অন্বেষণ করো।’ সহিহ বোখারি

মুসলিম শরিফে উদ্ধৃত হাদিস রয়েছে, ‘(রমজানের) শেষ ১০ দিনের বিজোড় তারিখের রাতগুলোয় তোমরা লাইলাতুল কদর তালাশ করো।’ এ হাদিসসমূহ থেকে বোঝা যায়, রমজানের ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ তারিখের রাতগুলোর মধ্যে কোনো একটি লাইলাতুল কদর। কিন্তু বিভিন্ন হাদিস, অভিজ্ঞতা ও যুক্তির আলোকে রাসুলে কারিম (সা.)-এর সাহাবিদের বিরাট একটি দল এ ১০ দিনের মধ্যেও ২৭ তারিখের রাতটি নির্দিষ্ট করেছিলেন। এদের মধ্যে হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.), হজরত আবু হুরায়রা (রা.), হজরত উবাই ইবনে কাব (রা.), হজরত আবু জর (রা.) ও হজরত ওমর (রা.)-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইবনে আবি শাইবা

লাইলাতুল কদরের আলামত : হজরত উবাদা ইবনুস সামিত (রা.) থেকে বর্ণিত এক হাদিসে রাসুল (সা.) লাইলাতুল কদরের সম্ভাব্য তারিখ রমজানের শেষে বিজোড় পাঁচটি রাত ও এ রাত ও রাতের ফজিলত বর্ণনার পরে এ রাতের কিছু আলামত বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘সে রাত দীপ্তিময়, পূর্ণ স্নিগ্ধ প্রশান্তিময়, মেঘমুক্ত ঝড়ঝাপটামুক্ত, গরমও নয়, অতিঠান্ডাও নয় (নাতিশীতোষ্ণ) যেন চন্দ্রোজ্জ্বল রাত এবং সে রাতে নক্ষত্রসমূহ শয়তানকে তাড়াতে ছোটে না। আরও নির্দেশ হলো, ভোরবেলায় সূর্য কিরণহীন হয়ে উদিত হয়, তার আলোয় তীক্ষ্ণতা থাকে না, যেন তা চতুর্দশীর পূর্ণচাঁদ। সূর্যের সঙ্গে শয়তানের আত্মপ্রকাশ আল্লাহতায়ালা সেদিনের জন্য হারাম করে দিয়েছেন।’ আহমাদ

লাইলাতুল কদর হাজার মাসের চেয়ে উত্তম : তাফসিরে জালালাইন, মাজহারি, কুরতুবি, মাআরেফুল কোরআনসহ প্রায় সব তাফসির গ্রন্থেই আল্লাহর এ বাণী দ্বারা এ রাতে ইবাদত-বন্দেগির সওয়াব হাজার মাসের ইবাদত-বন্দেগির সওয়াবের চেয়ে বেশি করা হয়েছে, যা সুরা আল-কদরের শানে নুজুল ও ব্যাখ্যায় উল্লেখ করা হয়েছে।

Manual8 Ad Code

লাইলাতুল কদরের ফজিলত : সুরা কদরেই আল্লাহতায়ালা এ রাতের তিনটি ফজিলত বর্ণনা করেছেন, ‘লাইলাতুল কদর হাজার মাসরে চেয়ে উত্তম। হজরত জিবরাইল (আ.) ফেরেশতাদেরসহ এ রাতে আল্লাহর অনুমতিক্রমে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় নিয়ে দুনিয়ায় নাজিল হন। এ রাত সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত পুরোপুরি শান্তিময়।’ এ সম্পর্কে হজরত আবু হুরায়রাহ (রা.) থেকে বর্ণিত। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে লোক ঈমানের সঙ্গে ও আল্লাহর কাছ থেকে প্রতিদান পাওয়ার আশায় কদরের রাতে ইবাদতের জন্য দণ্ডায়মান হলো, তার অতীতের সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়েছে।’ সহি বোখারি

হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘একদা রমজান মাস উপস্থিত হলে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, তোমাদের কাছে যে মাসটি উপস্থিত হয়েছে, তাতে এমন এক রাত রয়েছে, যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। যে এ পুণ্যময় রাতে এর কল্যাণ থেকে নিজেকে ফিরিয়ে রাখল, সে সব কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত থাকে।’ ইবনে মাজাহ

হজরত আনাস (রা.) বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কদরের রাত জিবরাইল ফেরেশতাদের একটি জামাত নিয়ে দুনিয়ায় অবতীর্ণ হন এবং দাঁড়ানো ও উপবিষ্ট অবস্থায় যারা আল্লাহর জিকির ও অন্যান্য ইবাদতে মশগুল থাকে, তাদের জন্য রহমতের দোয়া করেন।’ বায়হাকি

Manual4 Ad Code

প্রতিবছর লাইলাতুল কদরে আল্লাহর হুকুম অনুযায়ী হজরত জিবরাইল (আ.)-এর নেতৃত্বে ফেরেশতাগণ অবতরণ করেন। তারা পরবর্তী লাইলাতুল কদর পর্যন্ত কার ভাগ্যে কী ঘটবে, সে ভাগ্যলিপি নিয়ে পৃথিবীতে আসেন এবং যত মুমিন নারী-পুরুষ এ রাতে ইবাদতে মশগুল থাকে, তাদের জন্য দোয়া করেন।

মহান আল্লাহ আমাদের তার অফুরন্ত নিয়ামত মহামহিমান্বিত লাইলাতুল কদর নসিব করুন। তিনি আমাদের গুনাহসমূহ মাফ করুন।

লেখক: মুফাসসিরে কুরআন ও খতিব, গাউসুল আজম জামে মসজিদ, উত্তরা

Manual7 Ad Code

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code