প্রজন্ম ডেস্ক:
রমজান মাসের শুরুতেই রাজধানীর নিরাপত্তায় বিশেষ অভিযানে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের সঙ্গে আছে সেনাবাহিনী, বিজিবি ও নৌবাহিনীর সদস্যরাও। সেই সঙ্গে গোয়েন্দাদের একটি বিশেষ টিমকেও নামানো হয়েছে মাঠে। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চতুর্মুখী অভিযানে নাগরিক জীবনে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এলেও এখনও কমেনি আতঙ্ক। যদিও রাতের রাজধানীকে সুরক্ষিত রাখতে বিছানো হয়েছে নিরাপত্তার জাল।
ঢাকার নিরাপত্তায় কাজ করছে ৬১১টি টহল টিম আর ৮৫টি চেকপোস্ট। সেই সঙ্গে জোরদার করা হয়েছে গোয়েন্দা তৎপরতাও। সাইবার দুনিয়াতেও বৃদ্ধি করা হয়েছে নজরদারি। চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের ধরতে ডিবির পক্ষ থেকে গতকাল থেকে শুরু হয় ‘অলআউট অ্যাকশন’ কার্যক্রম।
অন্তর্বর্তী সরকার যেকোনো মূল্যে রাজধানীর নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে সমুন্নত রাখতে বদ্ধপরিকর। এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন নামে এবং স্বতন্ত্র ও যৌথভাবে বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বয়ে চলছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা কার্যক্রম।
রমজান মাসের শুরুতেই এসব অভিযান আরও জোরদার করা হয়। চুরি, ছিনতাই রোধে শনিবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে চেকপোস্ট বসিয়ে অভিযান চালায় যৌথবাহিনী। এ সময় দফায় দফায় তল্লাশি চালাতে দেখা যায় অভিযানে অংশ নেওয়া সদস্যদের।
গত শনিবার রাত ১০টা থেকে রাজধানীর বিজয় সরণি, নিউমার্কেট, আগারগাঁও ও মিরপুর এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় সেনাবাহিনীর টহল দল এবং পুলিশ সমন্বয় করে এ অভিযান চালায়। সন্দেহভাজন ব্যক্তি, হেলমেট ও লাইসেন্সবিহীন মোটরসাইকেল আরোহী এবং প্রাইভেটকারে তল্লাশি চালায় যৌথবাহিনীর সদস্যরা।
ডিএমপির মুখপাত্র মুহাম্মদ তালেবুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, রমজান মাস উপলক্ষে ঢাকা মহানগরীতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে যৌথবাহিনী এ অভিযান শুরু করেছে। ঢাকা শহরে শনিবার রাতে পাঁচ শতাধিক স্থানে টহল ও শতাধিক স্থানে চেকপোস্ট বসানো হয়েছে। সন্দেহ হলেই গাড়িতে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। মাদক ও অপরাধপ্রবণ এলাকায় তল্লাশি চালিয়ে কয়েকজনকে আটকও করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
সাম্প্রতিক সময়ে হঠাৎই দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হতে শুরু করে। সৃষ্টি হয় চরম জনরোষের। মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে শুরু করে। ফলে নড়েচড়ে বসে সরকার সংশ্লিষ্টরা। তবে হঠাৎ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির পেছনে শুধু পেশাদার অপরাধীদের স্বাভাবিক অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকেই একমাত্র কারণ হিসেবে দেখছেন না অপরাধ বিশেষজ্ঞসহ সরকার সংশ্লিষ্টরা। এর পেছনে দেশকে অস্থিতিশীল করার সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রও কাজ করছে বলে মনে করছেন তারা।
এ প্রসঙ্গে গত শনিবার ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিবিপ্রধান অতিরিক্ত কমিশনার রেজাউল করিম মল্লিক বলেছেন, আমাদের গোয়েন্দা প্রতিবেদন বলছে, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতির সঙ্গে যারা যুক্ত হচ্ছে তাদের বেশিরভাগের বয়স পনেরো থেকে ত্রিশের মধ্যে। এদের অনেকেই কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য। তারা বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। আবার কিছু পতিত ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক শক্তি ইন্ধন দিয়ে তাদের অপরাধ কার্যক্রমে জড়িয়ে দিচ্ছে। ডিবিপ্রধান বলেন, মহানগরীতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। আমাদের কাজ হচ্ছে গোয়েন্দা নজরদারি শক্তিশালী করা। আমরা সে বিষয়টিতে গুরুত্ব দিচ্ছি। আশা করি, কয়েক দিনের মধ্যে আপনারা আরও ভালো অবস্থা দেখতে পাবেন।’
সাম্প্রতিক সময়ে গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের ফাঁস করা একটি অডিও বার্তায় সুস্পষ্টভাবে তাকে বলতে শোনা যায়, দেশকে অস্থিতিশীল করার পরিকল্পনার কথা। মূলত এর কয়েক দিন পর থেকেই হঠাৎই দেশে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। সেই সঙ্গে বেড়ে যায় ছিনতাই, ধর্ষণও। ফিল্মি স্টাইলে ঘটতে থাকে একের পর এক লোমহর্ষক ঘটনা। জনমনে দেখা দেয় চরম আতঙ্ক। বিক্ষুব্ধ জনগণ কোথাও কোথাও স্থানীয় থানার ওসির অপসারণ চেয়ে মিছিল করে। কোথাওবা জনতাই মোকাবিলা করতে শুরু করে দুর্বৃত্তদের। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত এতটাই বৃদ্ধি পায় যে স্থানীয় জনগণ ওই থানার ওসির অপসারণ চেয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে। পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে ধরা পড়ে প্রাণ যায় এক ছিনতাইকারীর।
অবস্থা এতটাই নাজুক হয় ওঠে যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে গভীর রাতে ডাকতে হয় সংবাদ সম্মেলন। ২৪ ফেব্রুয়ারি সচিবালয়ে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, নৌবাহিনী ও সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে করা হবে কম্বাইন্ড পেট্রোলিং। একই দিন রাজশাহীতে এক কর্মশালায় ছিনতাইরোধে পুলিশের তিনটি বিশেষায়িত ইউনিট মাঠে নামার কথা জানিয়েছিলেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) সূত্রে জানা যায়, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ৫০টি থানা এলাকায় বর্তমানে ডিএমপির ৫৫০টি টহল টিম দায়িত্ব পালন করছে। এ ছাড়া মহানগর এলাকার নিরাপত্তা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ও কৌশলগত স্থানে ডিএমপির ৬৫টি পুলিশি চেকপোস্ট পরিচালিত হচ্ছে। জননিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ডিএমপির টহল টিমের পাশাপাশি মহানগরীর বিভিন্ন অপরাধপ্রবণ স্থানে সিটিটিসির ১৪টি, অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের (এটিইউ) ১২টি এবং ডিএমপির সঙ্গে র্যাবের ১০টি টহল টিম দায়িত্ব পালন করছে।
এ ছাড়াও ডিএমপির সঙ্গে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট এপিবিএন আরও ২০টি চেকপোস্ট পরিচালনা করছে। ভোরে থানা ও বিভিন্ন টহল কার্যক্রম পরিদর্শনে যাচ্ছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। দায়িত্বে অবহেলার অপরাধে নিচ্ছেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থাও, যা ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায়। পাশাপাশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করেছে গোয়েন্দা নজরদারি। সেই সঙ্গে বাড়ানো হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারও। প্রতিটি বাহিনী নিজেদের মধ্যে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে অ্যাকশন কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
অভিযান জোরদার হওয়ার পর অস্ত্র-গুলি ফেলে দুর্বৃত্তদের পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। গত শুক্রবার গভীর রাতে রাজধানীর পল্লবীর বাউনিয়া বেড়িবাঁধ এলাকায় পরিত্যক্ত অবস্থায় ৩০০ রাউন্ড চাইনিজ রাইফেলের গুলি উদ্ধার করে পুলিশ। ধারণা করা হচ্ছে, যৌথবাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে পর্যুদস্থ হয়ে দুর্বৃত্তরা এসব গুলি নিজেদের জিম্মা থেকে সরাতে সেগুলো ফেলে দেয়।
এদিকে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী বাহিনীর বিরুদ্ধে ‘অলআউট অ্যাকশনে’ যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার রেজাউল করিম মল্লিক। গত শনিবার ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন তিনি।
রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, ডিবির চলমান কার্যক্রমের পাশাপাশি রমজান মাসকে সামনে রেখে বিশেষ অভিযান শুরু করতে যাচ্ছি আমরা। এটি এক ধরনের বিশেষ গোয়েন্দা অভিযান। যেটিতে ছদ্মবেশে আমাদের সদস্যরা মানুষের মধ্যে থেকে অপরাধীদের শনাক্ত করবে। ব্যাপক জনসমাগম স্থানগুলোতে বাড়ানো হচ্ছে গোয়েন্দা নজরদারি।
এদিকে গত পাঁচ দিনে যৌথবাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের পর কিছুটা কমে এসেছে ছিনতাইসহ কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত। বিভিন্ন অভিযানে ১৫ সহস্রাধিক জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এতে জনমনে ফিরতে শুরু করেছে স্বস্তি। তবে রমজান মাস ও ঈদকে সামনে রেখে আবারও এসব পেশাদার দুর্বৃত্তের উৎপাত বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন জনগণ।
তাদের মতে, যতদিন দেশে চাঁদাবাজি থাকবে, যতদিন রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা সুযোগসন্ধানীরা তৎপর থাকবে ততদিন এসব দুর্বৃত্ত কিংবা কিশোর গ্যাং নামধারী সন্ত্রাসীদের হাত থেকে মানুষের মুক্তি মিলবে না।
মাসুম বিল্লাহ নামে এক ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, যেভাবে কিশোর গ্যাংসহ ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল তা মনে হচ্ছে কিছুটা কমেছে। তবে আমাদের আতঙ্ক এখনও কাটেনি। আবার সবসময়ই রমজানসহ যেকোনো উৎসবকে কেন্দ্র করে এরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। তাই স্বস্তি কিছুটা ফিরলেও শঙ্কা রয়েই গেছে।
মিরপুর-১ নম্বরের থাকেন বেসরকারি চাকরিজীবী আদনান সরকার।
তিনি জানান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের ফলে এলাকার উঠতি বয়সি ছেলেদের এখন আগের মতো জটলা করতে দেখা যাচ্ছে না। বিকট শব্দ করে মোটরসাইকেলও চালাচ্ছে না বখাটেরা। তবে কতদিন এ রকম অবস্থা বজায় থাকবে তা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। বরাবরের মতো এলাকার বড় ভাই নামধারী রাজনৈতিক সুযোগসন্ধানীদের ছত্রছায়ায় আবারও এসব দুর্বৃত্তরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। হাট-বাজার, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, ফুটপাথ, পরিবহন সেক্টরসহ বিভিন্ন সেক্টরে যতদিন চাঁদাবাজি বন্ধ না হবে ততদিন এসব সন্ত্রাসীর হাত থেকে মানুষের মুক্তি নেই বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি।
Sharing is caring!