প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৯শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৪ঠা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৮শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

‘হত্যা মিশনে’ জড়িত পুলিশের মধ্যে আসামি ৯৫২, গ্রেফতার মাত্র ২৮

editor
প্রকাশিত মার্চ ৫, ২০২৫, ০৫:২৭ পূর্বাহ্ণ
‘হত্যা মিশনে’ জড়িত পুলিশের মধ্যে আসামি ৯৫২, গ্রেফতার মাত্র ২৮

Manual7 Ad Code

স্টাফ রিপোর্টার:
৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেও তার দোসর পুলিশ কর্মকর্তাদের অনেকেই নানা মাধ্যমে তদবির করে নিজেদের সুরক্ষিত রেখেছেন। বিচারের কাঠাগড়ায় দাঁড় করানোর পরিবর্তে উলটো তাদের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পোস্টিং দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে চাঁনখারপুলে স্কুলছাত্র আনাসসহ ৭ জনকে হত্যায় জড়িত কর্মকর্তারা মামলার আসামি হলেও তাদের এখনো গ্রেফতার করেনি পুলিশ। মাঠে কিলিং বাস্তবায়নকারী রমনা জোনের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) শাহ আলম মো. আখতারুল ইসলামকে সিলেটে বদলি করা হয়। কর্মস্থল থেকে পালিয়ে যান তিনি। জুলাই আন্দোলনে হত্যা ও হত্যাচেষ্টা মামলায় সাবেক ও বর্তমান ৯৫২ পুলিশ আসামি হলেও মাত্র ২৮ জন গ্রেফতার হয়েছেন। গ্রেফতারের হার মাত্র ২.৯৪ শতাংশ। ৫ আগস্ট-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশের বয়স ৭ মাস হতে চললেও গণহত্যায় জড়িত সেই ‘কালপ্রিট’ কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় না আনায় হতাশ শহিদপরিবারের সদস্যরা।

শহিদপরিবারের সদস্যরা বলেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী ‘পুলিশ লীগের’ জড়িত কর্মকর্তা ও সদস্যদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। এখনই গ্রেফতার করা না হলে বাকিরাও আত্মগোপন বা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবে। চাকরিতে বহাল থাকলে জুলাই হত্যা মামলায় জড়িত অপরাধীদের রক্ষায় অপচেষ্টা চালাবে তারা। এ অবস্থায় গণহত্যায় ‘হুকুমদাতা’ ও ‘সরাসরি জড়িত’ পুলিশ কর্মকর্তাসহ জড়িত সদস্যদের দ্রুত গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান তারা। এমনকি নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদেই খুনিদের বিচারের নিশ্চয়তাও চান তারা। গণহত্যায় জড়িতদের বিচার প্রসঙ্গে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম বলেন, ট্রাইব্যুনালের মামলার তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া ভিন্ন। জুলাই হত্যা মামলার তদন্ত পর্যায়ে পুলিশ বা অন্য কারও মাধ্যমে সন্দেহভাজন আসামিরা তথ্য পেয়ে যাচ্ছে। ফলে গ্রেফতারের আগেই তারা পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। তিনি শহিদপরিবারের দাবি পূরণে ট্রাইব্যুনালের গ্রেফতারি ক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনা করার কথা বলেন।

চাঁনখারপুল কিলিংয়ে জড়িত পুলিশকে গ্রেফতার ও বিচারের মুখোমুখি না করায় শহিদ আনাসের বাবা শাহরিয়ার খান পলাশ যুগান্তরকে বলেন, হত্যা মিশনে অংশ নেওয়া ও হুকুম দেওয়া আসামিরা পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেলে কিংবা গ্রেফতারে বিলম্ব হলে ন্যায়বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কা তৈরি হবে। যেখানে প্রকাশ্যে গুলি করার ভিডিও রয়েছে, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী আছে, সেখানে টালবাহানা করার কারণ বোধগম্য নয়। জড়িতদের দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করা না হলে শহিদ ও আহতদের পরিবারের সঙ্গে বেইমানি করা হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

Manual3 Ad Code

পুলিশের গুলিতে শহিদ যারা: ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার রক্তের ওপর দিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান স্বৈরাচার শেখ হাসিনা। তার পলায়নের বিষয়টি জানার পরও সুবিধাভোগী খুনি পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের তাণ্ডব থামেনি চাঁনখারপুলে। ওইদিন দুপুরের দিকে এডিসি আখতারের নির্দেশে গুলি চালানো হয় নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার ওপর। এতে স্কুলছাত্র আনাসহ ঘটনাস্থলেই শহিদ হন সাতজন। যুগান্তরের অনুসন্ধানে তাদের মধ্যে ৬ জনের বিস্তারিত পরিচয় পাওয়া গেছে। তারা হলেন পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার শাহরিয়ার খান পলাশের ছেলে শাহরিয়ার খান আনাস, একই এলাকার শেখ জামাল হাসানের ছেলে শেখ মেহেদী হাসান জুনায়েদ, বংশালের ইউসুফ মিয়ার ছেলে মো. ইয়াকুব, একই এলাকার ফারুক আহামেদের ছেলে ইয়াসিন আহমেদ রাজ, চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার নুরুল হকের ছেলে মো. ইসমামুল হক এবং ঝালকাঠির মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের ছেলে রাকিব হাওলাদার। অন্য একজনের পরিচয় কেউ নিশ্চিত করতে পারেনি। এ বিষয়ে তদন্ত করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

Manual8 Ad Code

হত্যায় জড়িত পুলিশ: জোন বা অঞ্চল হিসাবে চাঁনখারপুল এলাকা পুলিশের রমনা ও লালবাগ বিভাগের আওতাধীন। আন্দোলনের কেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও শহিদ মিনারমুখী হওয়ায় চাঁনখারপুলের একাংশসহ বেশির ভাগ এলাকা শাহবাগ থানার অধীন। ৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের সময় রমনা বিভাগে পুলিশের ডিসি (ক্রাইম) মো. আশরাফুল ইসলাম, রমনা জোনাল টিমের এডিসি শাহ আলম মো. আখতারুল ইসলাম, এসি মো. ইমরুল দায়িত্বে ছিলেন। এছাড়া রমনা বিভাগের আওতাধীন নিউমার্কেট জোনাল টিমের এডিসি হাফিজ আল আসাদ, এসি রেফাতুল ইসলাম এবং ধানমন্ডি জোনাল টিমের এডিসির দায়িত্বে ছিলেন মো. ইহসানুল ফিরদাউস, শাহবাগ থানার ওসি মোস্তাজিরুর রহমান ও পরিদর্শক (অপরাশেন) ছিলেন আরশাদ হোসেন।

একই সময়ে রমনা গোয়েন্দা বিভাগে ডিসি (ডিবি) মো. হুমায়ুন কবীর, এডিসি (অ্যাডমিন) মো. আজহারুল ইসলাম মুকুল, রমনা জোনাল টিমের এডিসি মিশু বিশ্বাস, এসি জাবেদ ইকবাল প্রীতম ও ধানমন্ডি জোনাল টিমের এডিসি ছিলেন মো. ফজলে এলাহী। এছাড়া অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও মাদক নিয়ন্ত্রণ টিমের এডিসি ছিলেন নাজিয়া ইসলাম। যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে এসব পুলিশ কর্মকর্তার পরিচয় জানা গেছে।

সেই কর্মকর্তারা কে কোথায়: অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, রমনার ডিসি আশরাফুল ইসলাম জুলাই হত্যা মামলার আসামি। তিনি বর্তমানে রংপুর রেঞ্জ অফিসে সংযুক্ত আছেন। ৫ আগস্টের পর এডিসি আখতারকে সিলেটের ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে বদলি করা হয়। সম্প্রতি গ্রেফতারের বিষয়টি টের পেয়ে কর্মস্থল থেকে পালিয়েছেন তিনি। অন্যদের কেউ এপিবিএনে, কেউ কক্সবাজারের উখিয়ায় (এপিবিএন), কেউ গাজীপুরে শিল্প পুলিশে কর্মরত আছেন। শাহবাগ থানার সাবেক ওসি মোস্তাজিরুর রহমান বর্তমানে বরিশালে ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টারে কর্মরত আছেন। একইভাবে ডিবির কর্মকর্তারাও বিভিন্ন জেলায় কর্মরত আছেন। রমনায় জুলাই হত্যা মামলার অন্য আসামিদের মধ্যে রয়েছেন ডিবির ডিসি হুমায়ুন কবীর, এডিসি ফজলে এলাহী, এসি জাবেদ ইকবাল প্রীতম ও এসি রেফাতুল। এর মধ্যে জাবেদ ইকবাল ট্রাইব্যুনালের একটি মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন। বাকিরা পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত আছেন।

কারাগারে এপিবিএন কনস্টেবল সুজন : উত্তরা থেকে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন-১৩) সদস্য কনস্টেবল মো. সুজন হোসেনকে ৫ আগস্ট হত্যা মিশনে চাঁনখারপুলে পাঠানো হয়। ঘটনার দিন তাকে নানা ভঙ্গিমায় গুলি চালাতে দেখা যায়। পলাতক এডিসি আখতার হোসেন পাশে থেকে তাকে নির্দেশনা দেন। সাতজনকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় শাহবাগ থানার একটি মামলায় সুজন গ্রেফতার হন। পরে ট্রাইব্যুনালের একটি মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়। বর্তমানে কারাগারে আছেন সুজন।

Manual3 Ad Code

পরিদর্শক আরশাদ ও ইমাজকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ: ট্রাইব্যুনালের মামলায় সম্প্রতি শাহবাগ থানার তৎকালীন পরিদর্শক (অপারেশন) আরশাদ হোসেন ও কনস্টেবল ইমাজ হোসেন প্রামাণিককে গ্রেফতার করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় আরশাদকে রোববার ও ইমাজ হোসেন প্রামাণিককে সোমবার একদিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। অন্য একটি মামলায় রমনার ডিবির এসি জাভেদ ইকবাল প্রীতমকে গ্রেফতার করেছেন ট্রাইব্যুনাল। তিনি র‌্যাব-২ বছিলা ক্যাম্পে ছিলেন। ছাত্র সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম ও সারজিস আলমসহ ৬ জনকে গ্রেফতার করে ডিবি কার্যালয়ে হাজির করেছিলেন তিনি।

Manual7 Ad Code

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর বিএম সুলতান মাহমুদ বলেন, চাঁনখারপুল হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহত স্কুলছাত্র আনাসের নানার অভিযোগের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ান, সিসিটিভি ফুটেজ ও গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি ও ভিডিওর পাশাপাশি নানা তথ্য বিশ্লেষণ করে ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা হয়েছে। যাদের সুস্পষ্ট সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, তাদের আসামি করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual8 Ad Code