প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৪ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৩শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

সাহায্য বন্ধে সংকট বাড়বে আরও, শঙ্কায় বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গারা

editor
প্রকাশিত মার্চ ২৭, ২০২৫, ১০:০২ পূর্বাহ্ণ
সাহায্য বন্ধে সংকট বাড়বে আরও, শঙ্কায় বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গারা

Manual5 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

তহবিল সংকটের কারণে রোহিঙ্গাদের জন্য মাসিক খাবারের বরাদ্দ অর্ধেকে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করছে জাতিসংঘ। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচিও (ডব্লিউএফপি) সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের জন্য খাবারের বরাদ্দ অর্ধেকের বেশি কমানোর পরিকল্পনার কথা বাংলাদেশকে জানিয়েছে।

 

এমন অবস্থায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আশঙ্কা করছেন, সাহায্য বন্ধের ফলে সংকট আরও গভীর হবে। এমনকি সুযোগ-সুবিধা বন্ধের ফলে তারা কোথায় যাবেন; এমন প্রশ্নও তুলছেন কেউ কেউ।

বৃহস্পতিবার (২৭ মার্চ) এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা রয়টার্স।

 

বার্তাসংস্থাটি বলছে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একটি পুনর্বাসন কেন্দ্রে মাজুনা খাতুন তার ছয় মাস বয়সী শিশুকে কোলে নিয়ে বসেছিলেন। তিনি বেশ চিন্তিত, কারণ যুক্তরাষ্ট্র এবং কিছু ইউরোপীয় দেশ থেকে তহবিল হ্রাসের কারণে তার শিশুটি গুরুতর স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হবে।

পুনর্বাসন কেন্দ্রে ৩০ বছর বয়সী মাজুনা খাতুন বলেন, “এই সুবিধাটি বন্ধ হয়ে গেলে আমি কোথায় যাব?” এই পুনর্বাসন কেন্দ্রে তার শিশুকে ক্লাবফুটের জন্য ফিজিওথেরাপি দেওয়া হচ্ছে।

 

প্রতিবেশী মিয়ানমারের সহিংস নির্মূল অভিযানের কারণে পালিয়ে আসা বিশ্বের বৃহত্তম রাষ্ট্রহীন জনগোষ্ঠীর ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে কক্সবাজার জেলার শিবিরে আশ্রয় দিয়েছে বাংলাদেশ। এখানে তাদের চাকরি বা শিক্ষার সুযোগও সীমিত।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন বিশ্বজুড়ে বেশিরভাগ বিদেশি সাহায্য বন্ধ করে দেওয়ায় এবং মার্কিন আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা (ইউএসএইড) ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাপী মানবিক খাতে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। এই পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ সতর্ক করেছে, সহায়তা বন্ধের এই পদক্ষেপ শরণার্থীদের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি করবে।

আর তাই বাংলাদেশের শিবিরগুলোতে বসবাসরত রোহিঙ্গা শরণার্থীরা আশঙ্কা করছেন, সহায়তায় এই কাটছাঁটের ফলে খাদ্য ও স্বাস্থ্য সমস্যা আরও জটিল হবে এবং অপরাধ বৃদ্ধি পাবে।

Manual6 Ad Code

২৪ বছর বয়সী মোহাম্মদ সাদেক নামে এক রোহিঙ্গা বলছেন, “এখন ডাক্তারের সংখ্যা কম। আমাদের সহায়তাকারী রোহিঙ্গা স্বেচ্ছাসেবকদের বরখাস্ত করা হয়েছে। মানুষ কষ্ট পাচ্ছে কারণ তারা প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পাচ্ছে না।”

মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের ওয়েবসাইট অনুসারে, ২০১৭ সাল থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র সবচেয়ে বেশি সাহায্য প্রদানকারী দেশ। রোহিঙ্গাদের সহায়তায় প্রায় ২.৪ বিলিয়ন ডলার অবদান রেখেছে দেশটি।

তহবিল স্থগিত করার ফলে মার্কিন অর্থায়নে পরিচালিত পাঁচটি হাসপাতাল তাদের স্বাস্থ্য পরিষেবা হ্রাস করতে বাধ্য হয়েছে বলে শরণার্থী শিবির তত্ত্বাবধানকারী বাংলাদেশের শীর্ষ কর্মকর্তা মোহাম্মদ মিজানুর রহমান গত মাসে বলেছিলেন।

Manual2 Ad Code

ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর হাসিনা রহমান বলেন, ১১টি প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রসহ প্রায় ৪৮টি কেন্দ্রে স্বাস্থ্যসেবাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার ফলে অনেক শরণার্থী প্রয়োজনীয় চিকিৎসার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

তিনি বলেন, “আমাদের অগ্রাধিকার (এখন) সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ, বিশেষ করে নারী, মেয়ে এবং শিশুদের সুরক্ষা দেওয়া।”

কক্সবাজারে এনজিওগুলোর প্রচেষ্টা তদারককারী ইন্টার-সেক্টর কোঅর্ডিনেশন গ্রুপের প্রধান সমন্বয়কারী ডেভিড বাগডেন বলেছেন, স্বাস্থ্যসেবা পরিষেবায় ব্যাঘাতের কারণে প্রায় ৩ লাখ শরণার্থী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং মার্কিন দূতাবাস এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য অনুরোধের জবাব দেয়নি।

রয়টার্স বলছে, গুল বাহারের চার বছর বয়সী মেয়ে মুকাররামা সেরিব্রাল পালসিতে ভুগছে। গত তিন বছর ধরে তার চিকিৎসা চলছে যা তার অবস্থার উন্নতিতে সাহায্য করেছে। ৩২ বছর বয়সী বাহার কাঁপতে কাঁপতে বললেন, “যদি এই কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে এখন পর্যন্ত চিকিৎসায় যা ভালো কিছু তার অর্জিত হয়েছে সবকিছু হারাব আমরা। আমি আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসব।”

 

ক্ষুধা ও অপরাধ

যুক্তরাষ্ট্র এবং কিছু ইউরোপীয় দেশের সহায়তার পরিমাণ কমানোর ফলে ইতোমধ্যেই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে থাকা শরণার্থীদের অবস্থার আরও অবনতি ঘটাবে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।

 

জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জানিয়েছে, তহবিলের ঘাটতির কারণে এপ্রিল থেকে খাদ্য রেশনের পরিমাণ অর্ধেক কমিয়ে ৬ ডলারে নামিয়ে আনতে বাধ্য হতে পারে তারা। ২০২৩ সালে রেশনের পরিমাণ কমিয়ে ৮ ডলারে নামিয়ে আনার ফলে ক্ষুধা ও অপুষ্টির তীব্র বৃদ্ধি ঘটেছিল বলেও জাতিসংঘ জানিয়েছে। পরে সেই কর্তন বাতিল করা হয়।

“আমরা শিবিরের বাইরে কাজ করতে পারি না এবং আমরা যে রেশন পাই তা খুব কম। যদি তারা আরও কমিয়ে দেয়, তাহলে অপরাধ বৃদ্ধি পাবে, মানুষ বেঁচে থাকার জন্য যেকোনও কিছু করবে,” বলছেন নজির আহমেদ। পাঁচ সন্তানের বাবা নজির ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিলেন।

পুলিশের তথ্য অনুসারে, রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অপরাধের সংখ্যা বেড়েছে। গত বছর মিয়ানমার থেকে প্রায় ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিল, যার একটি কারণ ছিল তাদের নিজ প্রতেশ রাখাইনে ক্রমবর্ধমান ক্ষুধা।

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাংলাদেশি কর্মকর্তা বলছেন, সাহায্য হ্রাসের ফলে শরণার্থীরা আরও বেশি করে পাচার, মৌলবাদ এবং শোষণের ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। গণমাধ্যমের সাথে কথা বলার অনুমতি না থাকার কারণে তিনি নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি।

Manual8 Ad Code

মোহাম্মদ জুবায়ের নামে রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের একজন বিশিষ্ট নেতা বলছেন, “আমাদের খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। যদি এটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, তবে এটি কেবল বাংলাদেশের জন্য সমস্যা হবে না — এটি বিশ্বব্যাপী সমস্যা হয়ে উঠবে।”

 

Manual8 Ad Code

পাঁচ বছর আগে গাছ থেকে পড়ে যাওয়ার পর শফিউল ইসলাম শয্যাশায়ী ছিলেন। ৩৫ বছর বয়সী এই ব্যক্তি বলেন, পুনর্বাসন কেন্দ্রটি তার চিকিৎসা শুরু না করা পর্যন্ত তার পৃথিবী কেবল তার কুঁড়েঘরের চার দেয়ালে সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছিল।

তিনি বলেন, “আমি দাঁড়াতেও পারিনি, এমনকি বিছানায়ও যেতে পারিনি… তাদের কারণে, আমি আবার নড়াচড়া করতে পারছি। যদি এটি বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে সমস্ত স্বপ্ন ভেঙে যাবে। আমার মতো মানুষের আর কোথাও ঘুরে দাঁড়ানোর জায়গা থাকবে না।”

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual4 Ad Code