প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৪ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৩শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

পাঁচ ইস্যুতে রাজনীতিতে অস্থিরতা

editor
প্রকাশিত মে ৪, ২০২৫, ১১:০৭ পূর্বাহ্ণ
পাঁচ ইস্যুতে রাজনীতিতে অস্থিরতা

Manual2 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ, সংস্কার বাস্তবায়ন, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার প্রশ্ন, মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের জন্য মানবিক করিডর ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন আগে না পরে- গুরুত্বপূর্ণ এই পাঁচটি ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর নানামুখী তৎপরতায় দেশে একধরনের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে।

 

এসব ইস্যুতে দলগুলোর পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে তৈরি হয়েছে উত্তাপ। এর ফলে আবার জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে যে প্রশ্নটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে তা হলো, নির্বাচন আসলে কবে বা আদৌ হবে তো! কারণ সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানই বলেছেন, নির্বাচন দাবি করাটাই যেন এখন বড় অপরাধ।

অন্যদিকে মায়ানমারের সঙ্গে মানবিক করিডরকে কেন্দ্র করে সরকার কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে। কারণ বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর পাশাপাশি এনসিপি; এমনকি সর্বশেষ গতকাল হেফাজতে ইসলামও করিডরের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

শনিবার (৩ মে) হেফাজতের সমাবেশ থেকে সরকারের উদ্দেশে বলা হয়েছে, মানবিক করিডরের নামে বাংলাদেশকে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়া যাবে না। একই মঞ্চ থেকে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেছেন, ‘ভুলে যাবেন না, আমরা আপনাদের (অন্তর্বর্তী সরকার) ক্ষমতায় বসিয়েছি।’

সরকারের বিরুদ্ধে এই অবস্থান ছাড়াও নির্বাচনের দিনক্ষণ ও সংস্কার বাস্তবায়ন, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ করার প্রশ্নে দলগুলো এখন প্রায় মুখোমুখি। কারণ বিএনপি আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচনের প্রশ্নে এখনো অনড় অবস্থানে রয়েছে। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ‘আমরা খেয়াল করছি, কিছুদিন ধরে অত্যন্ত সুকৌশলে দেশে এমন একটি আবহ তৈরির প্রচেষ্টা চলছে, যেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানানোই যেন এক অপরাধ।’

অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী আগে সংস্কারের কথা বললেও এখন তারা আগামী ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলছে। গতকাল জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, ‘আমরা দুটি সময়কে উপযুক্ত মনে করি। একটি ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগে। তবে যদি এ সময়ের মধ্যে সংস্কারগুলো এবং বিচারের প্রক্রিয়া দৃশ্যমান বা জনমনে আস্থা সৃষ্টির পর্যায়ে না আসে, তাহলে সর্বোচ্চ এপ্রিল। ফেব্রুয়ারিতে সম্ভব না হলে কোনোভাবেই এপ্রিল মাস পার হওয়া উচিত নয়।’ নির্বাচন প্রশ্নে জামায়াতের অবস্থান সরকার-এনসিপি ও বিএনপির মাঝামাঝি বলা যায়।

তবে এনসিপি নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তব্য রাজনীতির ময়দানে উত্তাপ ছড়িয়েছে। গত শুক্রবার রাজধানীর এক সমাবেশে দলটির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ প্রশ্ন অমীমাংসিত রেখে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হবে না।’ পর্যবেক্ষকদের মতে, এনসিপির এই বক্তব্য নির্বাচন নিয়ে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হলো। গতকাল বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, বর্তমান সরকার মনে হচ্ছে নির্বাচন দিতে চায় না।

এদিকে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে যোগাযোগের জন্য ‘মানবিক করিডর’ দেওয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত জানানোর পর থেকেই দেশের রাজনীতিতে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এই ইস্যুতে গুরুত্বপূর্ণ কোনো একটি রাজনৈতিক দল এখন পর্যন্ত সরকারের পক্ষে সমর্থন ব্যক্ত করেনি। জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি এবং সর্বশেষ হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ থেকে করিডরের ব্যাপারে কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করা হয়েছে।

হেফাজতের সমাবেশ থেকে আলোচিত ইসলামি বক্তা ও জৌনপুরের পীর মুফতি ড. সাইয়্যেদ এনায়েত উল্লাহ আব্বাসী বলেন, ‘করিডর (মায়ানমারের রাখাইনের জনগণের জন্য মানবিক করিডর) দিয়ে স্বাধীনতাকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। আলেমদের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না।’

এর আগে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের সঙ্গে জড়িত এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে জানায়নি অন্তর্বর্তী সরকার। স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণ মনে করে, করিডর দেওয়া না-দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে হবে জনগণের কাছ থেকে, সিদ্ধান্ত আসতে হবে জনগণের প্রত্যেক্ষ ভোটে নির্বাচিত জাতীয় সংসদের মাধ্যমে।

ফলে করিডর নিয়েও জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পাশাপাশি অস্পষ্টতা রয়েছে। বিশেষ করে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশ-মায়ানমারের সঙ্গে এই মানবিক করিডর নিয়ে আবার নতুন কোনো সংকট তৈরি হয় কি না, তা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা প্রশ্ন এবং উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা রয়েছে।

এ ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচন নাকি স্থানীয় সরকার নির্বাচন- কোনটি আগে হবে এই আলোচনা নিয়েও বিতর্ক ছড়াচ্ছে। এ নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই পক্ষে-বিপক্ষে নানা বক্তব্য শোনা যাচ্ছে। বিএনপি বরাবরই স্থানীয় জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে। আর জামায়াত, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলন, গণঅধিকার পরিষদ- এই চারটি দল ইতোমধ্যে স্পষ্ট করে বলেছে, তারা জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায়।

প্রসঙ্গত, গুরুত্বপূর্ণ এই পাঁচ ইস্যু ছাড়াও সংবিধান, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, নির্বাচন কমিশন সংস্কারের যেসব প্রস্তাব রয়েছে তা জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে আলোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। এসব প্রস্তাব নিয়ে এখন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনা তেমন জোরালো নেই।

Manual1 Ad Code

আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার প্রশ্নে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সমাবেশে হেফাজতের অনেকে অনেকভাবে বলতে পারেন। তবে দলটির মূল নেতৃত্ব জানে একটা বিচারকাজ শুরু করে শেষ করতে সময় লাগে। আপিল প্রক্রিয়া থাকে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে বিচারকাজ শুরু করতে পারাটাই। হেফাজত বিচার-প্রক্রিয়া শেষ করে নির্বাচনের কথা বলতে পারে।

কিন্তু বিএনপির সঙ্গে বৈঠককালে তাদের বুঝিয়েছিলাম, বিচার একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া। আমরা বিচার শুরু করি, পরবর্তী সময়ে যে সরকার ক্ষমতায় আসবে তারা বিচার প্রক্রিয়া চলমান রাখবে। কারণ সব অভিযুক্তকে এখনো বিচার-প্রক্রিয়ার মধ্যে আনা সম্ভব হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘মানবিক করিডর নিয়ে জনগণকে অন্ধকারে রেখে এমন সিদ্ধান্ত অনভিপ্রেত। যদি বিষয়টি একান্তই জরুরি হতো, তাহলে সবার সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত।’

‘বাংলাদেশের সংবিধান বা প্রচলিত আইনে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার কোনো এখতিয়ার সরকারের নেই’ বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের বিচার করা বা নিষিদ্ধ করার কোনো ধারা বা সিস্টেম আইনে আছে বলে আমার জানা নেই। আওয়ামী লীগের মধ্যে যেসব লোক খারাপ ছিল তাদের বিচার করতে পারে। কিন্তু গোটা দলকে নিষিদ্ধ করার যুক্তিসংগত কারণ নেই। কারণ এই দলকে অনেক লোক ধারণ করে, অনেকে এটার সঙ্গে যুক্ত আছে। সবাই তো আর খারাপ না। এখন জনগণের কাছে যদি এই দলটি গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলে জনগণই এটার বিচার করবে। দলকে নিষিদ্ধ করার এখতিয়ার কোনো দল বা সরকারের আছে, এটা আমি মনে করি না।’

Manual5 Ad Code

জি এম কাদের বলেন, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশ নিতে না দিলে সেই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। যদি অবাধ নির্বাচন দিতে হয়, তাহলে সব দলকে নির্বাচনে অংশ নিতে দিতে হবে। কাউকে বাদ দিয়ে রাখলে স্বাভাবিক নির্বাচন হবে না।’

সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, ‘দেশকে সংকটমুক্ত করতে নির্বাচিত সরকারব্যবস্থায় যাওয়া হলো অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কর্তব্য। এ ক্ষেত্রে কোনো শর্ত দেওয়া উচিত নয়। গণহত্যার দায়ে বিচার প্রক্রিয়াকে নিশ্চিত করার স্বার্থেই নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন।’

সংস্কার-প্রক্রিয়ার শর্ত জুড়ে যারা নির্বাচন দীর্ঘায়িত করতে চাইছে তাদের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘যারা বলছে, নির্বাচন হলে বিচার হবে না; আমি মনে করি অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে তাদের সন্দেহ আছে। নির্বাচিত সরকার আওয়ামী লীগের বিচার করবে না এ কথা বলার মানে হলো, জনগণের ওপর তাদের কোনো আস্থা নেই।’

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আওয়ামী লীগের কৃতকর্মের বিচার সবাই চায়, আমরা চাই। কিন্তু বিচার করতে কতদিন সময় লাগবে? বিচার তো কেউ নির্দিষ্ট করতে পারবে না। নির্বাচনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের বিচার বিষয়টি জুড়ে দেওয়ার যৌক্তিকতা দেখি না। বিচার-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তাদের (আওয়ামী লীগ) নিষিদ্ধের বিষয়টি আসতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘মানবিক করিডরের মতো এত বড় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কারও সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি সরকার। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধান করা যেতে পারে। কিন্তু সরকারের মধ্যে আমরা সেই ধরনের কোনো উদ্যোগ দেখছি না। এটা চিন্তার ব্যাপার।’

Manual2 Ad Code

জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ বলেন, ‘জুলাইয়ে আওয়ামী লীগ গণহত্যা পরিচালনাকারী দল হিসেবে জাতিসংঘ চিহ্নিত করে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে তাদের বিচার করার এখতিয়ার শুধু আদালতের, কোনো দলের নয়। যারা গত ১৫ বছর দেশে জুলুম, নির্যাতন, দুঃশাসন চালিয়েছে তাদের কি জনগণ ক্ষমা করবে? ফ্যাসিস্ট ও ফ্যাসিবাদ বাংলাদেশকে জনগণ আর দেখতে চায় না। দল ও ব্যক্তির দুটোরই বিচার করতে হবে। ব্যক্তি হিসেবে যারা অপরাধ করেছে তাদের বিচার করতে হবে। আর বিচার-প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের বিষয়ে চূড়ান্ত রায় আসতে হবে। পাশাপাশি সরকারকেও সতর্ক থাকতে হবে- ফ্যাসিবাদ যেন পুনর্বাসনের সুযোগ না পায়।’

আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার বিচারের আগে নির্বাচন না হওয়ার দাবি প্রসঙ্গে আমি বলতে চাই, এই দাবিটা কেন উঠল? বিচার নিয়ে কি তাহলে কোনো সন্দেহ-সংশয় তৈরি হয়েছে? কিংবা বিচার বিলম্বিত হবে বা হচ্ছে এ ধরনের কোনো আশঙ্কা? এটা যদি সত্য হয়, তাহলে তো সরকারের বিরুদ্ধেই এই অভিযোগ। সরকারেরই উচিত এ বিষয়টা পরিষ্কার করা। বিচার বিলম্বিত হলে যদি নির্বাচন পেছাতে হয় তাহলে মানুষ সরকারকেই সন্দেহ করবে। মনে হবে নির্বাচন না করার জন্য সরকার ইচ্ছা করেই বিচারে দীর্ঘসূত্রতা ঘটাচ্ছে। আমি মনে করি, বিচার বা নির্বাচন যে কোনোটারই অযৌক্তিক বিলম্ব সরকারকেই প্রশ্নবিদ্ধ করবে।’

Manual1 Ad Code

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual2 Ad Code