প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৫ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৩০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৪শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

বাজেটে এবার কতটা বাড়বে নিত্যপণ্যের দাম?

editor
প্রকাশিত মে ১৩, ২০২৫, ১২:১৩ অপরাহ্ণ
বাজেটে এবার কতটা বাড়বে নিত্যপণ্যের দাম?

Manual3 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট ঘিরে কর কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হচ্ছে। আইএমএফের শর্ত মেনে আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক বাড়াতে পারে সরকার। এতে রাজস্ব কিছুটা বাড়লেও সাধারণ মানুষের ব্যয় বহুগুণে বাড়বে, চাপে পড়বে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা। ফলে মূল্যস্ফীতি আরও বাড়ার শঙ্কা রয়েছে, যদিও সরকার তা নিয়ন্ত্রণের অঙ্গীকার করেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সূত্র বলছে, রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে আগামী বাজেটে শুল্ক, মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), এবং উৎসে কর (এআইটি) বাড়ানো হচ্ছে। সরকারের এ ধরনের পদক্ষেপের সরাসরি প্রভাব পড়বে সাধারণ ভোক্তার ব্যয়ভারে।

 

বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্য, ওষুধ, চিকিৎসা উপকরণ ও উৎপাদনের কাঁচামালের ওপর কর আরোপ বা হার বাড়ানোর পরিকল্পনা থাকায় পণ্যের দাম বাড়ার একটা বাস্তব সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এর ফলে ভোজ্যতেল, চিনি, চাল, ডাল, ওষুধসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এতে একদিকে সরকার রাজস্ব আদায়ে স্বস্তি পেলেও অপরদিকে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

 

জানা গেছে, নতুন বাজেটের আকার ধরা হচ্ছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি বছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে প্রায় ৭ হাজার কোটি কম। বাজেট ঘোষণা হবে আগামী ২ জুন। আইএমএফ ইতোমধ্যে আগামী অর্থবছরের (২০২৫-২৬) জন্য রাজস্ব বাজেট প্রণয়নে গাইডলাইন দিয়েছে। শর্ত অনুযায়ী, কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে হবে ০.৭ শতাংশ। নতুন কোনও খাতে কর অব্যাহতি দেওয়া যাবে না, বরং বর্তমানে কার্যকর অব্যাহতির সুবিধাগুলো প্রত্যাহার করতে হবে।

 

 

আইএমএফের শর্ত: রাজস্ব আদায়ের চাপ

 

সরকার আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী করজিডিপি অনুপাত বাড়াতে চাইছে। এজন্য কর অব্যাহতি হ্রাস, করহার বাড়ানো এবং করজাল সম্প্রসারণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। ২০২২ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে নেওয়া ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ কর্মসূচির আওতায় রাজস্ব আদায়ের হার জিডিপির অনুপাতে বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বাংলাদেশ সরকার। এই প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে কর অব্যাহতি কমানো, করের হার বাড়ানো এবং করজালের বিস্তার— এই তিন কৌশল গ্রহণ করা হচ্ছে।

 

একজন সিনিয়র রাজস্ব কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘রাজস্ব ঘাটতি পূরণে উৎপাদন ও আমদানি পর্যায়ে ২ থেকে ৫ শতাংশ হারে অতিরিক্ত কর আরোপ করার চিন্তাভাবনা হচ্ছে।’ অর্থাৎ, এর প্রভাব সরাসরি পৌঁছে যাবে বাজারে বিক্রি হওয়া প্রতিটি পণ্যে।

এনবিআর কর্মকর্তারা জানান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রায় ২০০টি করমুক্ত আমদানিকারক পণ্যে ২ শতাংশ হারে অগ্রিম আয়কর (এআইটি) আরোপের পরিকল্পনা করছে। এনবিআরের দাবি, এই কর আরোপের মাধ্যমে কর পরিপালন বাড়বে এবং অতিরিক্ত ২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আয় হবে। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমদানিতে এআইটি মূলত পণ্যের মূল্যে প্রতিফলিত হয়ে ভোক্তার ঘাড়েই এসে পড়ে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে বিপুল সংখ্যক খাদ্যপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল ও চিকিৎসা সরঞ্জামের ওপর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ী ও ভোক্তারাও।

 

এনবিআর বলছে, শুল্ক ছাড় ধাপে ধাপে প্রত্যাহার এবং করনীতিতে শৃঙ্খলা আনতেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত কর থেকে বছরে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের আশা করছে সংস্থাটি।

 

 

খাদ্য, কাঁচামাল ও চিকিৎসা-সামগ্রী

 

বেশি ঝুঁকিতে যেসব পণ্যে নতুন করে এআইটি আরোপের পরিকল্পনা করা হয়েছে, তার মধ্যে রয়েছে— দৈনন্দিন ব্যবহৃত আলু, পেঁয়াজ, ডাল, ছোলা, সয়াবিন, ভুট্টা, সার, চিনি, অপরিশোধিত তেল এবং চিকিৎসা যন্ত্রপাতি। এছাড়াও পোশাক শিল্পে ব্যবহৃত তুলা ও মানবসৃষ্ট তন্তু, কম্পিউটার প্রিন্টার, রাউটার, মডেম, বিমানের ইঞ্জিন ও বাসসহ শিল্প যন্ত্রপাতিও রয়েছে তালিকায়।

 

বিশেষ করে যেসব পণ্যে আগে কর অব্যাহতি ছিল, সেগুলোর ওপরও ভ্যাট ও শুল্ক বসানো হলে তা সরাসরি ভোক্তার খরচ বাড়াবে। এছাড়া বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতেও দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থাকলে তা প্রোডাকশন কস্ট ও পরিবহন ব্যয় বাড়িয়ে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতিতে ভূমিকা রাখতে পারে।

 

ব্যবসায়ীদের উদ্বেগ

 

শুল্ক ছাড়ের সংস্কার নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপের কথা স্বীকার করে এনবিআরের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘২০০টির মতো পণ্যে এখন কোনও এআইটি নেই। সবগুলোতেই কর আরোপের পরিকল্পনা করা হয়েছে, শুধুমাত্র এক-দুটি পণ্য বাদ দিতে হতে পারে।’

 

তবে শিল্প উদ্যোক্তারা বলছেন, প্রতিযোগী দেশগুলো যেখানে শিল্পে সহায়ক নীতি নিচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের এই কঠোর পদক্ষেপ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে দেবে।

 

একটি শিল্প গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘আমাদের ৩০০ কোটি টাকার আমদানিতে যদি ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর বসে, তাহলে বছরে অন্তত ৬ কোটি টাকা অতিরিক্ত দিতে হবে। এই খরচ মেটাতে আমরা বাধ্য হবো তা পণ্যের দামে অন্তর্ভুক্ত করতে।’

 

আমদানিকারকরা বলছেন, অগ্রিম কর কেটে রাখার কারণে বাজারে নগদ প্রবাহে চাপ পড়ে। সেই চাপ সরাসরি পণ্যের দামে প্রতিফলিত হয়। এই কর ফেরত পাওয়ার প্রক্রিয়াও জটিল এবং সময়সাপেক্ষ হওয়ায় অনেক কোম্পানি তা দাবি করে না। আমদানিকারকদের অনেকে জানান, অগ্রিম কর ফেরত পাওয়া যায় না, বা ফেরত পেতে অনেক সময় লাগে, ফলে এই টাকাটা কার্যত তাদের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল থেকে কাটা পড়ে।

 

Manual5 Ad Code

 

রাজস্ব ঘাটতির চিত্র

 

Manual6 Ad Code

চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। ছয় মাস না যেতেই ঘাটতি ছাড়ায় ৫০ হাজার কোটি টাকা, ফলে লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে আনা হয় ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকায়। তবু মার্চ পর্যন্ত (৯ মাসে) ঘাটতির অঙ্ক দাঁড়ায় ৬৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এভাবে চললে ২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষে রাজস্ব ঘাটতি ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে।

 

Manual3 Ad Code

রাজস্ব আদায় বনাম জনজীবনের ভারসাম্য

 

সরকারের সামষ্টিক অর্থনীতির বাস্তবতায় রাজস্ব আদায় বাড়ানো প্রয়োজন। তবে এই কর কাঠামো এমনভাবে সাজানো জরুরি, যাতে ভোক্তা পর্যায়ে চাপ না পড়ে। বিশেষ করে খাদ্য, চিকিৎসা, শিক্ষা ও শিশু পণ্যের ওপর কর বাড়ানোর যে পরিকল্পনা, তা পুনর্বিবেচনা করা জরুরি বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বাংলাদেশে অগ্রিম কর খুব কম ক্ষেত্রেই আমদানিকারকের পর্যায়ে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা ভোক্তার ওপর গিয়ে পড়ে। বিশেষ করে খাদ্যপণ্য ও শিল্প কাঁচামালে কর আরোপের আগে সরকারকে ভাবতে হবে এর সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রভাব।’

 

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘এনবিআর যদি আয়কর ও শুল্ক বাড়িয়ে ঘাটতি পুষিয়ে নিতে চায়, তবে তা জনগণের ওপর চরম চাপ তৈরি করবে। মূল্যস্ফীতির সময় এসব পদক্ষেপ হিতে বিপরীত হতে পারে।’

 

তিনি আরও বলেন, ‘এই মুহূর্তে রাজস্ব আদায়ে দক্ষতা বাড়ানো, অনলাইন রিটার্ন বাধ্যতামূলক করা ও করজাল সম্প্রসারণের দিকে নজর দিতে হবে, ভ্যাট বাড়িয়ে নয়।’

 

ভোক্তা অধিকার সংগঠনের আশঙ্কা

Manual8 Ad Code

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘চিনি, তেল, চাল, ডাল— এসব পণ্যে কর বসানো মানে মানুষকে না খেয়ে রাখার আয়োজন করা। সরকার রাজস্ব আদায়ের নামে মানুষের জীবনযাত্রাকে দুর্বিষহ করে তুলছে।’

তিনি বলেন, ‘এখনও বাজারে ডিম, পেঁয়াজ, চাল, ডাল— সবই আগুন দাম। এর মধ্যে নতুন করে কর বসানো হলে স্বল্প আয়ের মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছাবে।’

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual6 Ad Code