প্রজন্ম ডেস্ক:
গত রবিবার বেলা ১১টা। আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনের সপ্তম তলায় একটি ফাইল নিয়ে হাঁটাহাঁটি করছেন মো. খালেকুজ্জামান (৪৫)। তার বাড়ি লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলায়। সেখানকার বেসরকারি একটি স্কুলে ২০১৬ সাল থেকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে চাকরি করছেন। ইসিতে কেন এসেছেন- জিজ্ঞেস করতেই খালেক বলেন, ‘আপা আমার এনআইডিতে বয়স সংশোধন করা দরকার। সেটা করতে না পারলে আমার চাকরি থাকবে না। পাঁচ মাস ধরে আমি বেতন পাচ্ছি না।’
খালেকুজ্জামানের সংশোধনী চাওয়া সম্পর্কে জানতে কথা হয় সংশ্লিষ্ট ইসি কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি জানান, জাতীয় পরিচয়পত্রের চেয়ে বয়স ১০ বছর কম দেখিয়ে তিনি চাকরি নিয়েছিলেন। পরে চাকরি বাঁচাতে বয়স মিলিয়ে আরও একটি এনআইডি বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে ধরা পড়েন ইসির বায়োমেট্রিক ফাঁদে। এনআইডি সার্ভারে খালেকের দুটি এনআইডির ফিঙ্গারপ্রিন্ট ম্যাচ ফাউন্ড (আগের এনআইডির সঙ্গে মিলে যাওয়া) হলে তার দুটি এনআইডি-ই ব্লক করে দেয় কর্তৃপক্ষ। পরে প্রথম এনআইডি সংশোধনে করা আবেদনে কাগজপত্র ভুয়া প্রমাণ হওয়ায় তার সংশোধন আবেদনও বাতিল করা হয়। তবে খালেকুজ্জামানের বিরুদ্ধে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেয়নি ইসি।
আইন অনুযায়ী একজনের একাধিক জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পাওয়ার সুযোগ না থাকলেও নানা কৌশলে খালেকুজ্জামানের মতোই অনেকেই দেশে-বিদেশে চাকরিপ্রাপ্তিসহ নানা স্বার্থ হাসিলের জন্য করে থাকেন একাধিক এনআইডি। আইনত এ ধরনের অপরাধের শাস্তি অনূর্ধ্ব ১ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড থাকলেও তা এখন পর্যন্ত তেমনভাবে কার্যকর হতে দেখা যায়নি। তবে জালিয়াতি ধরা পড়ার পর একটি (দ্বিতীয় এনআইডি) এনআইডি ব্লক করায় বিপাকে পড়ে ইসির কাছে ধরনা দিতে বাধ্য হন অনেকে।
মিথ্যা তথ্যে, ভুয়া কাগজ বানিয়ে দাখিল করে চাকরি নিয়ে থাকেন অনেক শ্রেণি-পেশার মানুষ। বিশেষ করে সরকারি চাকরি পাওয়ার জন্য এ ধরনের জালিয়াতির (বয়স কমানো) ঘটনা সবচেয়ে বেশি। তাদের মধ্যে অনেকে কৌশলে দ্বিতীয় এনআইডি বাগিয়ে নিলেও ধরা পড়ছেন নির্বাচন কমিশনের (ইসি) এনআইডি ডেটাবেজের ম্যাচ ফাউন্ডে (ফিঙ্গারপ্রিন্ট মিলে যাওয়া)। এরপর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির দুটি এনআইডি ইসি ব্লক করে দিলে নানা কৌশলে নিজের চাহিদামতো সংশোধনী পেতে তৎপর হয়ে ওঠেন।
খালেকের জালিয়াতির ধরা পড়ে তদন্তে
এনআইডি সার্ভারে খালেকের দুটি এনআইডির ফিঙ্গারপ্রিন্ট ম্যাচ ফাউন্ড হলে তার দুটি এনআইডি-ই ব্লক করে দেয় এনআইডি কর্তৃপক্ষ। এ ঘটনার পর অফিসের চাকরি হারানোর নোটিশে বাধ্য হয়ে এনআইডি সংশোধনের আবেদন করেন। ইসির কাছে তার জমা দেওয়া তথ্য ও কাগজপত্র সন্দেহজনক মনে হওয়ায় মাঠপর্যায়ে তদন্ত করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এরপর হাতীবান্ধা উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. সাদ্দাম হোসেনের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে খালেকুজ্জামানের জালিয়াতির তথ্য-প্রমাণ।
এ বিষয়ে সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘তিনি উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মিথ্যা তথ্যে দুটি এনআইডি নিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, পরে চাকরি বাঁচাতে ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে আবার নিজের চাহিদামতো সংশোধনের চেষ্টাও করেছেন, যা সম্পূর্ণ বেআইনি ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আবেদনকারী খালেকুজ্জামানের প্রকৃত জন্ম সাল ১৯৮০। তিনি অষ্টম শ্রেণি পাসের প্রত্যয়নপত্র জমা দিলেও সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ে ভর্তির তথ্য দিতে পারেননি। প্রকৃত বয়স গোপন করতে শিক্ষাগত যোগ্যতা মাধ্যমিক পাসের শিক্ষা সনদ জমাই দেননি। তার তিন সন্তানের মধ্যে প্রথম সন্তান সপ্তম শ্রেণিতে পড়ছে এবং তার বর্তমান চেহারার সঙ্গে আবেদনপত্রে উল্লিখিত বয়সেরও কোনো মিল পাওয়া যায়নি।’ এসব কারণে খালেকুজ্জামানের প্রথম এনআইডির বয়স ১০ বছর কমানোর সংশোধন আবেদন তিনি বাতিলের সুপারিশ করেছেন।
মিথ্যা তথ্যে এনআইডির আইনি বিধান
জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন আইন, ২০২৩ (অপরাধ ও দণ্ড) অনুযায়ী কোনো নাগরিক জাতীয় পরিচয়পত্র প্রাপ্তির লক্ষ্যে অথবা একাধিক জাতীয় পরিচয়পত্র নিতে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বা জ্ঞাতসারে কোনো মিথ্যা বা বিকৃত তথ্য দিলে বা তথ্য গোপন করলে সেটা দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এ ধরনের অপরাধ প্রমাণিত হলে তার অনূর্ধ্ব ১ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। তবে এ ধরনের ঘটনার প্রমাণ হওয়ার পরও বেশির ভাগ প্রতারকের শাস্তি সীমাবদ্ধ থাকে এনআইডি ব্লক করা পর্যন্ত।
চাকরি নেওয়াসহ অনৈতিক স্বার্থ হাসিলে করা দ্বিতীয়বার ভোটার, মৃত ভোটার জীবিত আর জীবিত ভোটারদের মৃত চিহ্নিত হওয়াদের আলাদা করার উদ্যোগ নেয় তৎকালীন সিইসি নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। সে সময় অন্তত ১০ লাখ দ্বিতীয়বার ভোটার হওয়া ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে তাদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। এরপর দ্বৈত বা ম্যাচ ফাউন্ড ভোটারের সংখ্যা কমে এলেও বন্ধ হয়নি এনআইডি জালিয়াতির ঘটনা।
গত ৩০ এপ্রিল ইসি আবুল ফজল সানাউল্লাহ জানান, নির্বাচন কমিশনের ডেটাবেজে দ্বৈত এনআইডি বা ম্যাচ ফাউন্ড ভোটার আছে ২ লাখ ৯ হাজার, যা পুরো ডেটাবেজের দশমিক ১৬ শতাংশ। এর মধ্যে ৯ শতাধিক লোকই উদ্দেশ্যমূলকভাবে তথ্য গোপন করে দ্বিতীয়বার এনআইডি নেওয়ার চেষ্টা করেছেন। যাদের বেশির ভাগের এনআইডি ‘লক’ (অকার্যকর) করে দেওয়া হয়েছে। আর চিহ্নিত কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়। তবে কিছু শ্রমিক শ্রেণির লোক আছেন যাদের কারও কারও আঙুলের ছাপ পরিষ্কার না থাকায় ফলস ম্যাচ আসে, তাদের ক্ষেত্রে ছাড় দেওয়া হয়। তবে যে কারণেই হোক না কেন- দুবার এনআইডি হাতিয়ে নেওয়া এসব লোকের ক্ষেত্রে প্রথমটি সচল রেখে দ্বিতীয়টা ব্লক করে দেওয়া হচ্ছে।
এনআইডি মহাপরিচালক এ এস এম হুমায়ুন কবীর জানান, ঘটনা তদন্ত করে শনাক্তকারীদের দ্বিতীয় এনআইডি ব্লক করে দেওয়ায় বর্তমানে ইসির ডেটাবেজে এদের সংখ্যা অনেক কমে এসেছে। তারপরও তদন্তাধীন রয়েছে ৫০০-এর বেশি ম্যাচ ফাউন্ড ভোটার। আগামীতে ইসির সার্ভারকে ম্যাচ ফাউন্ড বা দ্বৈত ভোটার শনাক্তের ব্যাপারে ইসির তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। কারণ স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে এনআইডি জালিয়াতি করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ সতর্কতা এবং এনআইডি অনুবিভাগের ডিজিটাল নজরদারি (অটো বায়োমেট্রিক স্ক্যান) জোরদার করা হয়েছে।
Sharing is caring!