প্রজন্ম ডেস্ক:
অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকারের অন্যতম বিদেশে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনা। এ জন্য ইতোমধ্যে কিছু পরিকল্পনা ও প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ১১ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন। বিভিন্ন দেশের সরকার এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে ঢাকা। সেসব দেশে ল ফার্ম নিয়োগের প্রক্রিয়াও চলমান। পাচারের টাকা ফেরানোর উদ্যোগের অংশ হিসেবে এবার চলছে লন্ডন-মিশন।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এখন লন্ডনে অবস্থান করছেন। এই সফরে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার উদ্যোগকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। লন্ডন সফরকালে তারা সে দেশের সরকার এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করছেন। পাচারের টাকা ফেরানোর বিষয়ে তারা সহযোগিতাও চাইবেন। প্রাথমিকভাবে ওই সব দেশে পাচারের অর্থ-সম্পদ অবরুদ্ধ, ক্রোক ও বাজেয়াপ্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। পরবর্তী ধাপে সেসব অর্থ ফেরত আনার প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হবে। প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পাওয়া গেলে পাচার হওয়া অর্থ বাংলাদেশে ফেরত আনা সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে দুদকের মুখপাত্র ও মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন বলেন, ‘পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে সেখানকার (যুক্তরাজ্য) সরকার ও আইন প্রয়োগকারী এজেন্সিগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা হবে। কী প্রক্রিয়ায় অর্থ ফেরত আনা যায়, সে বিষয়ে সহযোগিতা চাওয়া হবে। উল্লেখযোগ্য যেসব ব্যক্তির অর্থপাচার হয়েছে বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে, যা ওই দেশে পাওয়া গেছে; সেসব অর্থ ফেরানোর ব্যাপারে আলোচনা হবে। প্রথমত, ইউকে (যুক্তরাজ্য) বেইজড পাচারের অর্থ ফেরানোর বিষয়ে আলোচনা হবে। পাশাপাশি অন্য দেশ, যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত এবং সংশ্লিষ্ট অন্য দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতার বিষয়ে যদি কথা হয়, নিশ্চয়ই পাচারের অর্থ ফেরানোর বিষয়গুলো আলোচনায় আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো যদি আমাদের সহযোগিতা করতে আগ্রহ দেখায়, তাহলে সেসব পাচার হওয়া টাকা দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু হতে পারে। তবে আপাতত যুক্তরাজ্যে পাচার হওয়া টাকা ফেরানোর বিষয়ে সে দেশের সরকার এবং সেখানকার আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে আলোচনা হবে। আলোচনা ফলপ্রসূ হলে সেখানে পাচার হওয়া অর্থ-সম্পদ বাজেয়াপ্ত, অবরুদ্ধ বা ক্রোক করার বিষয়গুলো প্রাথমিকভাবে বাস্তবায়ন করা হবে। পরবর্তী ধাপে সেগুলো ফেরানোর প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হবে। ইতোমধ্যে যুক্তরাজ্যে পাচার হওয়া অর্থ-সম্পদ অবরুদ্ধ ও ক্রোক করতে বাংলাদেশের আদালতের দেওয়া আদেশের কপি পাঠানো হচ্ছে। কিছু কিছু বিশেষ চ্যানেলে পাঠানোও হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের সহযোগিতা ছাড়া পাচারের টাকা ফেরত আনা সম্ভব নয়। এ জন্য আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উদ্যোগ আছে। এটা সেই উদ্যোগেরই একটা অংশ।’
এদিকে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ মার্চ প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে ‘পাচার হওয়া অর্থ ও সম্পদ পুনরুদ্ধার, গৃহীত পদক্ষেপ ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক উচ্চপর্যায়ের একটি বৈঠক হয়। এই বৈঠকে যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের অন্য দেশ থেকে পাচার করা অর্থ ফেরত আনার বিষয়টিতে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। এই বৈঠকে ল ফার্ম নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্তও চূড়ান্ত হয়। এসব ল ফার্ম নির্দিষ্ট পরিমাণ ফির বিনিময়ে পাচারের অর্থ উদ্ধারে এবং পাচারের অর্থে ক্রয় করা সম্পদ জব্দ করে বিক্রির আইনি সহায়তা দেবে। আইনি প্রক্রিয়ায় প্রাপ্ত অর্থ দেশে আনার কাজেও ল ফার্ম সহযোগিতা করবে।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় সূত্রে আরও জানা যায়, যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপের অন্য দেশ থেকে পাচারের অর্থ ও পাচার করা অর্থে কেনা সম্পদ বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ দেশে আনার কাজে সহযোগিতা করতে গত তিন মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তরা ২০০টির মতো ল ফার্মের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যের ৩০টি ল ফার্মের সঙ্গে কথাবার্তা অনেক দূর এগিয়েছে। এবারের সফরে এসব ল ফার্মের সঙ্গে আরও বিস্তারিত আলোচনা করে কয়েকটি ল ফার্মকে চূড়ান্ত করা হবে। আলোচনায় ল ফার্মের ফি নির্ধারণ এবং সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে কত সময়ের মধ্যে পাচারের অর্থ দেশে আনা সম্ভব হবে তা গুরুত্ব পাবে।
পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের সংশ্লিষ্টদের নিয়ে ১১ সদস্যের টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করা হয়েছে। ল ফার্মকে এই টাস্কফোর্স কমিটি দেশ থেকে তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করার কাজে সহযোগিতা করবে। যুক্তরাজ্য থেকে পাচারের অর্থ ফেরত আনার বিষয়ে অনুষ্ঠিত প্রতিটি সভায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা। এসব সভায় কীভাবে পাচারের অর্থ দেশে নানা যাবে তা নিয়েই কথা হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টার সিনিয়র প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘বিগত সরকারের প্রভাবশালীরা প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন ডলার পাচার করেছেন। এর মধ্যে ১৭ বিলিয়ন ডলারই ব্যাংকিং লেনেদেনের মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য দিয়ে পাচার করা হয়েছে। বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ দ্রুত ফেরত আনতে সরকার জোর দিয়েছে। এবারের যুক্তরাজ্য সফরে এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে আলোচনা হচ্ছে। আশা করি, পাচারের অর্থ উদ্ধার এবং পাচারের অর্থে কেনা সম্পদ জব্দ করে তা বিক্রি করা যাবে। এবারের সফরে কীভাবে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে তা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে।’
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে তৈরি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যুক্তরাজ্যে শেখ হাসিনা ও তার পরিবার টাকা পাচারের শীর্ষে রয়েছে। যুক্তরাজ্যে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী, এমপি, সরকারি-বেসরকারি আমলাসহ দলীয় নেতা-কর্মীদের পাচার করা অর্থও কম নয়।
প্রধান উপদেষ্টার যুক্তরাজ্য সফরকে সামনে রেখে আয়োজিত প্রেস ব্রিফ্রিংয়ে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব রুহুল আলম সিদ্দিকী বলেছিলেন, ‘আমাদের এবারের সফরে যুক্তরাজ্যে পাচার হওয়া অর্থ উদ্ধারের চেষ্টা থাকবে।’
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যেসব দেশে অর্থ পাচার করা হয়েছে সেসব দেশে অর্থ পাচারকারীদের পাচারের অর্থ নিরাপদ রাখার জন্য কিছু আইনি সংস্থা, ট্রাস্ট কোম্পানি, অফশোর বিশেষজ্ঞ, রিয়েল এস্টেট এজেন্ট, হিসাবরক্ষক, নিয়ন্ত্রক বিশেষজ্ঞসহ শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। এরা মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে পাচারের অর্থ নিরাপদে রাখার ব্যবস্থা করে থাকে। ওই সব দেশের সরকারের সহায়তায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হচ্ছে। এতে পাচারের অর্থ সহজে দেশে ফিরিয়ে আনা যাবে।
প্রেস উইং থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার পরিবার ও তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচার বিষয়টি নিয়ে বিএফআইইউ (বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট) তদন্ত করছে। ৭২টি দেশের সঙ্গে সরকারের এই শাখার সমঝোতা-চুক্তি আছে। বিগত সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং এবং কেম্যান দ্বীপপুঞ্জে সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। ইতোমধ্যে তাদের ৫ কোটি ১৫ লাখ টাকার ১১টি ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হয়েছে। ১২৪টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৬ শ ৩৫ দশমিক ১৪ কোটি টাকা পাওয়া গেছে। সব ব্যাংক হিসাবের তথ্য দুদকে পাঠানো হয়েছে। মামলাও করা হয়েছে। প্রতারণা ও জালিয়াতির অভিযোগে মোট ৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। তদন্তের শেষে ৬টি মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের অর্থ পাচারের তদন্ত করছে বিএফআইইউ। ১৫ কোটি ৬ লাখ টাকার ১২৫টি ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ করা হয়েছে। যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সিঙ্গাপুরে সম্পদ ও বিনিয়োগের তথ্য উদ্ঘাটন করা হয়েছে। মামলা দায়ের করা হয়েছে। জালিয়াতি, প্রতারণা এবং অন্যান্য অপরাধমূলক অভিযোগে দায়ের করা মামলারও তদন্ত হচ্ছে। ৩৯টি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মোট ৫ কোটি ২৭ লাখ টাকা ফ্রিজ করা হয়েছে।
টাকা ফেরত আনার নজির
সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ছোট ছেলে মরহুম আরাফাত রহমান কোকোর টাকা ফেরত আনা হয় ২০১২ ও ২০১৩ সালে। সিঙ্গাপুর থেকে তিন দফায় মোট ২০ কোটি ৮৮ লাখ টাকা ফেরত আনা হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রথম দফায় ২০১২ সালের নভেম্বরে ফেরত আনা হয় ১৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে ১৫ লাখ এবং একই বছর আগস্টে ৭ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ফেরত আনা হয়।
Sharing is caring!