প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৮ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৩রা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৭শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

ফের বন্যার মৌসুম এল, কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ?

editor
প্রকাশিত জুন ২২, ২০২৫, ০৪:৫৬ অপরাহ্ণ
ফের বন্যার মৌসুম এল, কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ?

Manual6 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

আকস্মিক বন্যায় গতবার যে ক্ষতি হয়েছে, সে কথা মনে হলেই আঁতকে ওঠেন কুমিল্লার আরমান হোসেন। বর্ষার এই মৌসুমে আবহাওয়া কখন কেমন হয় তা নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই।

আরমানের বাড়ি মনোহরগঞ্জের পূর্ব বাতাবাড়িয়া গ্রামে। গত বছর অগাস্টের ভয়াল বন্যায় তার ঘর তলিয়ে যায় হাঁটু পানিতে। পরিবারের ১২ সদস্যকে নিয়ে টানা ৫ দিন সেখানে বন্দিদশায় কাটে।

তিনি জানান, আসবাবপত্রের তো ক্ষতি হয়েছেই; অনেকগুলো হাঁস-মুরগি খুঁজে পাওয়া যায়নি, ভেসে গেছে মাছের ঘের আর পুকুর। এরপর ১০ মাস কেটে গেলেও সরকারি-বেসরকারি কোনো সহায়তা মেলেনি।

আরমান বলেন, তাদের এলাকায় গত এক বছরে খাল খনন বা আনুষঙ্গিক কোনো কাজই হয়নি। মূল সড়কের সঙ্গের রাস্তাটি স্রোতের তোড়ে ভোসে যায়। সরকারি সহায়তা না পেয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে অল্প কিছু জায়গা মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে।

“গত এক বছর ধরে কার্যত কোনো ধরনের ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি, সেটা সরকারি উদ্যোগেই হোক বা অন্য কোনোভাবে হোক। খুব ভয় এবং আতঙ্কের একটা সময় আসতেছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে যে যতটুকু পারতেছে, ততটুকু ওভারকাম করতেছে। আমাদের ঘরের টিনগুলো ঠিকভাবে চেইঞ্জও করিনি। কারণ এবারও যদি বন্যা হয়, তাহলে আবার এগুলো ভেঙে যাবে।

“সেই শঙ্কায় আমরা চাইলেও কোনো উদ্যোগ নিতে পারছি না। আবার আর্থিক ব্যাপারগুলোও আছে। দেশের অবস্থা, আয় রোজকারের অবস্থা ভালো না। আমাদের এখানকার ৮০ শতাংশ মানুষের এমন অবস্থা। সবার মধ্যেই ভয় কাজ করছে, মেরামত করতে পারছে না।”

আবহাওয়ার নিরিখে জুন থেকে সেপ্টেম্বর- এই চার মাসকে বর্ষা মৌসুম ধরা হয়। জুলাই-অগাস্ট মাসে ভারি বৃষ্টির কারণে মৌসুমি ও আকস্মিক বন্যার ঝুঁকি থাকে।

সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, গত বছরের বন্যার অভিজ্ঞতা থেকে এবার ক্ষতি মোকাবেলায় বাংলাদেশের শতভাগ প্রস্তুতি রয়েছে।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্যোগ মোকাবেলায় বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত কোনো প্রস্তুতিই নেই। ফের বড় বন্যা এলে ক্ষতির পরিমাণ কয়েকগুণ বেশি হবে, যা মোকাবেলা করা সহজ হবে না।

 

গতবার কী হয়েছিল?

বর্ষার শুরুতেই গেলবার বন্যার মুখে পড়ে সিলেট-সুনামগঞ্জের বাসিন্দারা। টানা দুই সপ্তাহ তারা পানিবন্দি ছিলেন; এর মধ্যে পানি বেড়ে তলিয়ে যায় উত্তরাঞ্চলের নিচু এলাকা।

প্রায় প্রতিবছরই আকস্মিক বন্যার মুখোমুখি হলেও সিলেটের বাসিন্দারা ২০০৪ সালের পর সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েন ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে। কিন্তু অগাস্টে মুহুরী নদীর বানে ফেনী জেলা যে বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে, সাম্প্রতিক ইতিহাসে তেমন নজির নেই। ফুলগাজী, পরশুরাম, ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর উপজেলার প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকা ডুবে যায়। নতুন সরকার যাত্রা শুরুর দুই সপ্তাহের মাথায় দেশ এমন দুর্যোগের কবলে পড়ে।

উজানে পাহাড়ি ঢল আর অতি ভারি বৃষ্টির কারণে ২০ অগাস্ট থেকে ফেনী, কুমিল্লা, নোয়াখালীসহ দেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়। উপদ্রুতরা বলছিলেন, জীবদ্দশায় তারা বন্যার এমন ভয়াল রূপ দেখেননি।

এই বন্যা মোকাবেলায় সরকারি প্রস্তুতির ঘাটতি কথা বলে আসছিলেন বিশেষজ্ঞরা। পূর্বাভাস থাকলেও প্রস্তুতির ঘাটতির কথা স্বীকার করেছিল সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো।

গত বছর পূর্বাভাসে ভারি বৃষ্টি ও বন্যার কথা বলা হলেও ওই সতর্কবার্তা এলাকায় প্রচার করা হয়নি বলে জানিয়েছিলেন বাসিন্দারা। যার ফলে আকস্মিক বন্যায় তারা হতবিহ্বল হয়ে পড়েন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জুলাই-অগাস্টে মাসে বাংলাদেশে বন্যা নতুন কিছু নয়। তবে গতবার যেসব জেলায় বন্যা হয়েছে, সেসব এলাকার পরিস্থিতি সাধারণত এতটা খারাপ কখনো হয় না।

আবার এত দ্রুত পরিস্থিতি এতটা খারাপ সাধারণত হয় না। ওই বন্যায় পানি এত দ্রুত বেড়ে যায় যে অনেক এলাকায় মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ারও সুযোগ পায়নি।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক সমরেন্দ্র কর্মকার বলেছিলেন, ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা, মেঘনা অববাহিকায় ১৯৮৮, ১৯৯৮ সালে ভয়াবহ বন্যা হলেও কুমিল্লা, ফেনী, নোয়াখালী এলাকায় গতবারের মত পরিস্থিতি হয়নি কখনো।

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আকস্মিক বন্যা দেখা দিলে ত্রিপুরার ডাম্বুর ড্যামের গেইট খুলে দেওয়াকে দায়ী করা হয়, বিক্ষোভ দেখানো হয় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে।

তার প্রতিক্রিয়ায় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছিল, “২১ অগাস্ট থেকে পুরো ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতে ব্যাপক বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ব্যাপক অন্তঃপ্রবাহের কারণে (ডাম্বুর ড্যামে) পানি নিজে থেকে বের হওয়ার ঘটনা দেখা গেছে।”

ওই সময়ে ত্রিপুরায় অতি ভারি বৃষ্টিপাতের তথ্য জানিয়েছিল ভারতের আবহাওয়া অফিস। ২০ অগাস্ট ত্রিপুরার সাব্রুমে একদিনে ৩৭৫.৮ মিলিমিটার বৃষ্টি ঝরে।

অগাস্ট মাসের ২১ দিনে ওই অঞ্চলে স্বাভাবিক বৃষ্টি হওয়ার কথা ছিল ২১৪ মিলিমিটার, সেখানে বৃষ্টিপাত হয়েছে ৫৩৮.৭ মিলিমিটার; যা স্বাভাবিকের থেকে ১৫১ শতাংশ বেশি।

অগাস্টের ওই ভয়াল বন্যায় বাংলাদেশের ১১ জেলায় ৭৪ জনের মৃত্যু হয়, আহত হন ৬৪ জন। ২৩ জেলায় ২ লাখের বেশি ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি ৩৭ লাখ ২ হাজার ৭৩৩ হেক্টর ফসলি জমি আক্রান্ত হয়। এতে কৃষিতে ৩ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা ক্ষতি হয়; আর দুর্দশায় পড়েন ১৪ লাখের বেশি কৃষক।

অন্যদিকে কৃষি, ঘরবাড়ি আর রাস্তাঘাটসহ সবমিলিয়ে ক্ষতি হয় ১৪ হাজার ২৬৯ কোটি ৬৮ লাখ ৩৩ হাজার ৫২২ টাকার। ক্ষতিগ্রস্ত হন ৯ লাখ ৪২ হাজার ৮২১ জন মানুষ; ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় নেন ৪৫ লাখ ৫৬ হাজার ১১১ জন।

সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে টানা ভারি বৃষ্টিতে রংপুর, নীলফামারীসহ উত্তরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ জুড়ে ভারি বৃষ্টিপাতে নদীর পানি বেড়ে তলিয়ে যায় ময়মনসিংহ বিভাগের তিন জেলা। ফলে দুই লাখ ৩৮ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মৃত্যু হয় ১০ জনের।

Manual4 Ad Code

উজানের ঢলে গতবার জুলাইয়ের শুরুতেও দেশের উত্তর ও উত্তর পূর্বাঞ্চলে বন্যা দেখা দিয়েছিল। এর ফলে প্লাবিত হয় অনেক গ্রাম।

ক্ষতি কতটা সামলানো গেছে?

গতবারের দুর্গত এলাকার বাসিন্দা ও কর্মকর্তারা বলছেন, বন্যায় এত বিপুল পরিমাণে ক্ষতি হয়েছে যে ওই সময়ের ক্ষত এখনও সারানো যায়নি।

গতবছর বন্যার ফলে কুমিল্লায় যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার ৫০ শতাংশ পোষানো গেছে বলে ভাষ্য জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবেদ আলীর। এর কারণ হিসেবে ক্ষতির পরিমাণ বেশি হওয়াকে দায় দিচ্ছেন তিনি।

আবেদ আলী বলেন, “যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, সেগুলো নিয়ে বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট থেকে কাজ হচ্ছে; এখনও চলমান আছে। পাবলিকের যে ক্ষতি হয়েছে সেটাও বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট থেকে ঋণের মাধ্যমে যাতে পুষিয়ে উঠতে পারে, সেজন্য কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।”

ফেনী জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মাহবুব আলম বলেন, “যতটুকু সম্ভব হয়েছে পুনর্বাসন কার্যক্রমের মাধ্যমে বিভিন্ন এনজিও, আইএনজিও, সরকারি বরাদ্দ, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনীসহ সব মিলিয়ে মোটামুটি একটা পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে।

“যারা যারা ক্ষতির শিকার হয়েছেন, সবাইকেই সহযোগিতা করেছি, তবে পুরোপুরি দেওয়া যায়নি। রাস্তাঘাট মেরামতের কাজ চলছে।”

ফেনীর জেলা প্রশাসক সাইফুল ইসলাম বলেন, রাস্তা-ঘাট, স্কুল-কলেজ, বসতবাড়ির ক্ষতি হয়েছিল, সেগুলো উন্নয়নের কাজ এখনও চলমান।

“সরকারি হিসাবে সাড়ে ৭ হাজারের মত বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ইউএনডিপি ৫ হাজার পরিবারকে সহায়তা করেছে, এর পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও সংগঠন হেল্প করেছে। এখানকার অর্থনৈতিক অবস্থাও ভেতর থেকেই অনেক স্ট্রং, যার ফলে ওই ধকলটা কাটিয়ে ওঠা গেছে অনেকাংশে। বাঁধের কাজ, পুনর্বাসনের কাজ, রাস্তা-ঘাটের কাজ এখনও চলমান।”

তিনি বলেন, “কেউ সহায়তা না পেয়ে থাকলে আমাদের এখানে আসতে পারে। আমাদের এখানে আসছে না তা না। একটা দুইটা পরিবার বিভিন্ন মিডিয়া কর্মী পাঠিয়েছে। আমরা তখন কোনোভাবে সহায়তা করার চেষ্টা করি। এনজিওকে রেফার করি, হেল্প করার জন্য।”

৯০ শতাংশের বেশি ঘরবাড়ি মেরামত করা হয়েছে বলে তথ্য দিয়েছেন ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ইসমাইল হোসেন।

 

এবার প্রস্তুতি কতটা?

Manual2 Ad Code

গতবছর বন্যার ক্ষতি মোকাবিলা করতে না পারার ব্যাখ্যায় সরকারের তরফে বারবার বলা হচ্ছিল, ফেনী-কুমিল্লা অঞ্চলের এমন ভয়াল বন্যার ঘটনা নতুন, সরকারও নতুন। ফলে প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হয়নি।

তবে অগাস্টের বন্যার ১০ মাস পর ফের যখন বর্ষা মৌসুম এল, তখন প্রশ্ন উঠছে- এবার সরকার কতটা প্রস্তুত? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বড় ধরনের বন্যার ক্ষতি মোকাবেলায় কোনো প্রস্তুতি নেই।

এবার বর্ষার আগে থেকেই বৃষ্টির প্রবণতা বেড়েছে। ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তর বাংলাদেশের উজানে ২৫ জুন পর্যন্ত ভারি থেকে অতি ভারি বৃষ্টিপাতের সতর্কবার্তা দিয়েছে।

এই সময়ে বাংলাদেশেও টানা বৃষ্টিপাতের আভাস রয়েছে। মৌসুমি বায়ু সক্রিয় হওয়ার পাশাপাশি এরই মধ্যে বঙ্গোপসাগরে একটি লঘুচাপও তৈরি হয়েছে। এই সময়ে ফেনী, সিলেট, সুনামগঞ্জ ও নেত্রকোণার নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার আভাস রয়েছে।

এর ফলে বন্যার ঝুঁকি রয়েছে বলে জানিয়েছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সরদার উদয় রায়হান।

তিনি বলেন, “জুলাই-অগাস্ট মাসটা বর্ষা মৌসুমের সবচেয়ে শীর্ষ সময়। এ সময়টাতে যে কোনো সময়ই বন্যার ঝুঁকি থাকে।

“তখন সাধারণভাবেই বন্যার ঝুঁকি মৌসুমি বন্যা প্রবণ এলাকায় এবং আকস্মিক বন্যা প্রবণ এলাকায় থাকে।”

আবহাওয়াবিদ ওমর ফারুক বলেন, “বর্ষাকালে তীব্র বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা থাকেই। লঘুচাপ বা নিম্নচাপ যদি বাংলাদেশের উপর দিয়ে যায় বর্ষাকালে তখন প্রচুর বৃষ্টি হয়।”

জলবায়ু পরিবর্তন ও নদী বিশেষজ্ঞ পানি সম্পদ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন হচ্ছে; যার ফলে অল্প সময়ে বেশি বৃষ্টি হওয়ার প্রবণতা রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বহু বছর ধরে খাল নদী জলাধারগুলো ভরাট করে ফেলেছে মানুষ। ফলে এখন বন্যা হলে পানি সরার সুযোগ থাকে না। তাতে দুর্ভোগ হয় দীর্ঘস্থায়ী।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বহু বছর ধরে খাল নদী জলাধারগুলো ভরাট করে ফেলেছে মানুষ। ফলে এখন বন্যা হলে পানি সরার সুযোগ থাকে না। তাতে দুর্ভোগ হয় দীর্ঘস্থায়ী।

“এই সময়ে বৃষ্টিটা স্বাভাবিক, নদীর পানি উপচিয়ে দুই পাড়ে আসা- এটাও স্বাভাবিক। সব জায়গায় রাস্তা তৈরির ফলে পানি নিষ্কাশনের রাস্তা নাই এখন। কাজেই কঠিন বৃষ্টি হোক আর স্বাভাবিক বৃষ্টি হোক, জলাবদ্ধতা হবেই।”

২০১৫ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার একটি নীতিমালা প্রকাশ করে। সেখানে দুর্যোগ এলে সরকারের কোন প্রতিষ্ঠান কী দায়িত্ব পালন করবে তা বলা আছে জানিয়ে তিনি সেই মোতাবেক কাজ করার পরামর্শ দেন।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ শাহজাহান মণ্ডল বলেন, ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের ভাষ্য মতে এবার বর্ষায় স্বাভাবিক বৃষ্টি হতে পারে। তাদের আভাস ঠিক থাকলে বড় ধরনের বন্যার আশঙ্কা কম। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহাওয়া অনেক সময় অস্বাভাবিক আচরণ করছে।

Manual6 Ad Code

“ফলে গতবারের মত এমন অপ্রত্যাশিত বন্যা যে হবে না, সেটা নাকচ করা যায় না। হঠাৎ করে বৃষ্টি হল…. এটা কিন্তু কেউই পূর্বাভাস করতে পারবে না আগে থেকে। যে সময় হয়, হয়ত তার দুয়েকদিন আগে বলা যেতে পারে।”

বন্যা মোকাবেলায় সবসময় সতর্ক এবং প্রস্তুত থাকার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “কিছু রিসোর্স হয়ত ওয়েস্টও হতে পারে। হলেও প্রস্তুত থাকা দরকার। তাতে অনেক সময় মানুষের দুর্ভোগ কমানো যায়।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান খান বলেন, বন্যা বা দুর্যোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেসব প্রতিষ্ঠান বা মন্ত্রণালয় রয়েছে, তাদের কেউ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করে- এমন কাউকে ডাকেনি। ফলে প্রস্তুতির অভাব থাকছেই।

“একই মাত্রার একটা বন্যা যদি এবার হয় তা যে কতটা ভয়াবহ হবে! গত বছরের বাস্তবতা থেকে এমনিতেই প্রস্তুতি রাখা দরকার। প্রস্তুতির কথা, সচেতনতার কথা, ট্রেনিংয়ের কথা এরকম কোনো দিক আমরা দেখি নাই।

“ফেনী বন্যার পর আমাদের গবেষণা করার বড় সুযোগ ছিল, এরকম কোনো কিছু আমরা দেখি নাই। ১০ মাসে ভালো একটা উদ্যোগ, কাজ দেখি নাই। আমার তো মনে হয় না এটা নিয়ে কারোর কোনো ভাবনা বা উদ্যোগ আছে।”

 

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে মাঠ পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি করতে গিয়ে যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন তা তুলে ধরেন অধ্যাপক মনিরুজ্জামান।

“ফেনীতে মানুষের কাছে জানতে চেয়েছিলাম সরকার থেকে কী পেয়েছে তারা গতবারের বন্যার প্রেক্ষাপটে। মার্চ মাসেও বলেছে কিছু হয় নাই। মাদারীপুরে প্রচুর নদী ভাঙন হয়। গত ১০ মাসে কোনো ধরনের কোনো কর্মসূচি নেওয়া হয়নি বলে এই মাসের শুরুতে তারা জানিয়েছে।

Manual7 Ad Code

“উত্তরাঞ্চলের এক জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কাছে জানতে চেয়েছিলাম তাদের পরিবর্তন কী, ওই এলাকাটা প্রচুর বন্যাপ্রবণ। তিনি বলেছেন, ‘আমরা নিজ থেকে কিছু করতে চাই না’।”

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর পরই সব নির্বাচিত স্থানীয় প্রতিনিধিদের সরিয়ে দেওয়া হয়, দুর্যোগ মোকাবেলায় তাদেরকেই ‘সক্রিয়’ করার পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক মনিরুজ্জামান।

‘উড়ন্ত নদীই’ ডেকে এনেছে ফেনী-কুমিল্লার ভয়াল বন্যা?

তিনি বলেন, “তার কথা এলাকার মানুষ শোনে। কিন্তু ওই লোকটা এখন নাই। তার কথা ছাড়া কর্মকর্তা, প্রশাসকের কথা কেউ শোনে না। কারণ সে তো ওই ইউনিয়নের লোক না।

“সকল চেয়ারম্যান, মেম্বার- সমানভাবে অপরাধী, এটা কেউ বিশ্বাস করেবে না। এদেরকে কাজ করতে দেন। আর কমিউনিটি পর্যায়ে কমিটি গঠন করতে হবে। “

কুমিল্লা জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবেদ আলী বলেন, গত বছর নৌযান নিয়ে যে সংকট ছিল তা কাটাতে এবার বিভিন্ন জায়গায় কথা বলছেন।

“বাঁধের কার্যক্রমও ইতোমধ্যে করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড, এখনও করছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।”

গত বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে এ বছর ‘ প্রায় সব ধরনের প্রস্তুতি’ নিয়ে রাখার কথা বলেছেন ফেনী জেলার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মাহবুব আলমও।

“উদ্ধার কার্যক্রমের জন্য স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন, উদ্ধারকারী নৌযান, যেটা সেনাবাহিনী দেবে; এরপর রিলিফ গ্রুপ, আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বন্যা পূর্বাভাস কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন এক ঘণ্টা পরপর নদীর তথ্য নেওয়া হচ্ছে।”

উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামও বন্যায় ভুগেছে গতবছর।

উত্তরের জেলা কুড়িগ্রামও বন্যায় ভুগেছে গতবছর।

ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ইসমাইল হোসেন বলেন, প্রস্তুতির অংশ হিসেবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সঙ্গে ইতোমধ্যে দুই/তিনটি সভা করেছেন তারা। আশ্রয়কেন্দ্র, ত্রাণ কার্যক্রম চালানোর জন্য নৌযান, স্বেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রাখা আছে।

“পানিটা যাতে দ্রুত চলে যেতে পারে এবং ওয়ার্নিংটা আমরা আগে দিতে পারি, বাঁধ যেগুলো ভেঙে গেছিল- সেগুলো পানি উন্নয়ন বোর্ড মোটামুটি করেছে আরকি। নিয়মিত পানির লেয়ার পরিমাপ করি।

“আমরা শতভাগ প্রস্তুত। গত অগাস্টে বন্যা যেটা হয়েছে, ওরকম দুর্যোগ আসলে আপনি যত প্রস্তুতিই নেন, প্রকৃতির শক্তির সাথে কতটুকু পারবেন? একটি বন্যা প্রতিরোধে এবং মানুষকে নিরাপদে রাখতে যা যা প্রস্তুতি দরকার, আমাদের বিশ্বাস- সেরকম প্রস্তুতি আছে।”

নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক খন্দকার ইসতিয়াক আহমেদ বলেন, “প্রস্তুতি আছে। আমাদের সকল শুকনা খাবার, চাল, টাকা সবই আছে পর্যাপ্ত।”

আগাম প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম, মন্ত্রণালয়ের সচিব মোস্তাফিজুর রহমান এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমানকে একাধিকবার ফোন ও বার্তা পাঠিয়েও তাদের সাড়া পাওয়া যায়নি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখার অতিরিক্ত সচিব কে এম আবদুল ওয়াদুদ বলেন, “বন্যা তো হঠাৎ করে হবে না, পূর্বাভাস থাকবে। বন্যা হইলে ক্ষতি হবেই, ক্ষতি হতেই পারে। কিন্তু এ বছর এখন পর্যন্ত বন্যার কোনো পূর্বাভাস নাই।”

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual6 Ad Code