প্রজন্ম ডেস্ক:
আরেক জুলাই মাস সমাগত। সংস্কার, ঐকমত্য ও জুলাই সনদের দিকে তাকিয়ে সবাই।
সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদন সরকারের হাতে এসেছে আগেই। ঐকমত্য কমিশন এখন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় ধাপের আলোচনার মাঝপথে।
দেড় ডজন বিষয়ভিত্তিক আলোচনার মধ্যে নয়টি বিষয়ে ইতোমধ্যে মতামতও নিয়েছে কমিশন।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলছেন, “ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টাটাই আমরা করছি। তারই প্রক্রিয়া হিসেবে আমরা দুটো (৭০ অনুচ্ছেদ ও স্থায়ী কমিটির সভাপতি মনোনয়ন) বিষয়ে একমত হতে পেরেছি। আরও একটি বিষয়ে প্রায় একমতের কাছাকাছি; প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার সুযোগ ১০ বছরে সীমিত করার বিষয়ে প্রায় সকলে একমত।”
তিনি বলেন, “আগামী দিনগুলোতে আরো আলোচনা হবে। সব মিলিয়ে ২০টির মত বিষয় রয়েছে। সব বিষয়ে একমত হওয়া যাবে সেরকম মনে করছি না। আশা করি, এরমধ্যে অনেক বিষয়ে একমত হতে পারব।”
একমত হওয়ার জন্য সময় খুব বেশি নেই হাতে। আসছে জুলাই মাসেই জুলাই সনদ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানে সংস্কার বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার থাকবে। আর ঐকমত্য আর সংস্কার শুরুর ওপরই ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন আয়োজনের বিষয়টি নির্ভর করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান বলেন, “আসলে অন্যতম ইস্যুগুলোতে আমরা ঐকমত্য কমিশনের দিকেই তাকিয়ে আছি। তারা কী সিদ্ধান্তে একমত হয়, সেগুলো দেখার জন্য অপেক্ষা করছি।”
তবে সার্বিকভাবে ঐকমত্যে পৌঁছানো যে এখনো বহু ‘দূরের পথ’, সে কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “ঐকমত্যের পদ্ধতিগত বিষয়ে মারাত্মক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে সরকারের।”
সংস্কারের অক্টোবর-জুন
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১১ মাস পার হতে যাচ্ছে। যাত্রা শুরুর তিন মাসের মাথায় রাষ্ট্র সংস্কারের পথরেখা ঠিক করতে প্রথম ধাপে ছয়টি সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়। দ্বিতীয় ধাপে আরও পাঁচটি সংস্কার কমিশন করে দেয় সরকার।
সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, দুর্নীতি দমন কমিশন, জনপ্রশাসন, পুলিশ ও বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে প্রতিবেদন দেয়।
আর নভেম্বরে দ্বিতীয় ধাপে গঠিত গণমাধ্যম, নারী, শ্রম, স্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন এপ্রিলের দ্বিতীয়ার্ধে সরকারের কাছে জমা পড়ে।
এর মধ্যে পুলিশ বাদে প্রথম ধাপের পাঁচ কমিশনের সংস্কার সুপারিশ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে এই ঐকমত্য কমিশনের কাজ জুলাই মাসেই শেষ হওয়ার কথা।
ঐকমত্য কমিশন প্রথম পর্যায়ে দলগুলোর সঙ্গে আলাদা আলাদা আলোচনা করে। পরে দ্বিতীয় পর্যায়ে সব দলকে একসঙ্গে বসিয়ে সংস্কার সুপারিশের বিষয়ভিত্তিক আলোচনা শুরু হয়।
ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার মধ্যে মার্চে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশন ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ১২১টি সুপারিশের ‘আশু বাস্তবায়নযোগ্য তালিকা’ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগে পাঠায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
নির্বাচন সামনে রেখে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব বাস্তবায়নে সরকারের কাছে অবস্থান তুলে ধরে নির্বাচন কমিশনসহ অন্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগ।
সংস্কার সুপারিশের দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য প্রস্তাবগুলো নিয়ে এগোনোর পাশাপাশি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন মৌলিক সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে।
জুলাই সনদ ঘোষণার আগে কতটুকু সংস্কারের সিদ্ধান্ত হল, ঐকমত্য কতদূর এগোল, সেদিক এখন সবার নজর।
৬ বৈঠকে ৯ বিষয়ে প্রাধান্য
স্থায়ী কমিটির সভাপতি মনোনয়ন
প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার সর্বোচ্চ সময়
নারী প্রতিনিধিত্ব
দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ (নিম্নকক্ষ ও উচ্চ কক্ষ)
প্রধান বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া
রাষ্ট্রের মূলনীতি
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি
জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন কাঠামো,
এর বাইরে অন্তর্বর্তীকালীন বা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা, সংবিধান সংশোধন পদ্ধতি, জরুরি অবস্থা ঘোষণার প্রক্রিয়া, স্থানীয় সরকারে নারী প্রতিনিধিত্ব, উচ্চকক্ষের নির্বাচন পদ্ধতি, জেলা সমন্বয় কাউন্সিল গঠন, নির্বাচনী এলাকার স্বাধীন সীমানা নির্ধারণ কমিশনসহ সব মিলিয়ে দেড় ডজন বিষয় সামনে আলোচনার অপেক্ষায় রয়েছে।
যে দুই বিষয়ে ঐকমত্য
>> সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের কারণে সংসদে দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার সুযোগ ছিল না আইনপ্রণেতাদের।
দলগুলো একমত হয়েছে, এখন থেকে যে কোনো সদস্য অর্থ বিল (বাজেট) এবং আস্থা ভোট–এ দুটোর বিষয়ে বাইরে যে কোনো বিষয়ে সংসদ সদস্য তার দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবেন।
এর বাইরে একটি দল (বিএনপি) আরও দুটো প্রস্তাব যুক্ত করার কথা বলেছে। তাতে বলা হয়েছে, সংবিধান সংশোধন ও জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে (বিশেষত যুদ্ধাবস্থায়) নিজের দলের পক্ষে ভোট দিতে বাধ্য থাকবেন একজন এমপি।
আলী রীয়াজ বলেন, “সিদ্ধান্ত হয়েছে, যেহেতু বিএনপির এ প্রস্তাবে সবাই একমত নয়, সেক্ষেত্রে সনদে বিএনপি উল্লেখ করবে এ দুটো বিষয়ে তারা যুক্ত হতে চান।”
>> দলগুলো একমত হয়েছে, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মনোনয়নে চারটি কমিটিতে অবশ্যই সভাপতি হবেন বিরোধী দল থেকে। বাকি কমিটিগুলোর ৫০ শতাংশও বিরোধী দলকে দেওয়া হবে।
ঐকমত্য হয়নি যেখানে
দুই ধাপের আলোচনার অগ্রগতি তুলে ধরে বৃহস্পতিবার অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “ইতোপূর্বে দলগুলোর সঙ্গে যে আলোচনা করেছি আমরা, তাতে অনেক বিষয়ে একমত হতে পেরেছি। কিন্তু কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একমত পারিনি, ভিন্ন ভিন্ন মত আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের মত একদিকে; আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংখ্যালঘিষ্ঠের মত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।”
এরকম প্রায় ২০টির মত বিষয় রয়েছে, যেগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্যে পৌঁছানো চেষ্টা করছে কমিশন।
রাষ্ট্রীয় কার্যাবলীতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনা এবং রাষ্ট্রীয় অঙ্গ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করতে নয় সদস্যের একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল বা এনসিসি গঠনের সুপারিশ করেছিল সংবিধান সংস্কার কমিশন।
বিএনপিসহ কয়েকটি দলের বিরোধিতায় ঐকমত্য কমিশন একটি নতুন প্রস্তাব দিয়েছে। সেখানে এনসিসির নাম বদলে ‘সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি’ করার কথা বলা হয়েছে।
এনসিসির প্রস্তাবিত কাঠামো নিয়ে সকলে প্রশ্ন তোলায় ঐকমত্য কমিশন এখন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতির বদলে তাদের প্রতিনিধিকে কমিটিতে রাখার কথা বলেছে।
বর্তমান সংবিধানে একজন ব্যক্তি কত মেয়াদ বা কত বছর প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারবেন, তার কোনো সীমা নেই। সংবিধান সংস্কার কমিশন সেখানে প্রস্তাব করেন, একজন প্রধানমন্ত্রী পদে দুই বারের বেশি থাকতে পারবেন না।
এ বিষয়েও একমত হতে পারছিল না দলগুলো। সেখানে দুই ‘পূর্ণ মেয়াদ’ হবে, নাকি দুই ‘বার’ হবে, তা নিয়ে দলগুলোর মধ্যে বিতর্ক হয়। পরে অধিকাংশ দল ১০ বছরের সীমা বেঁধে দেওয়ার বিষয়ে একমত হয়।
তবে এনসিসির বিরোধিতা করে আসা বিএনপি বলেছে, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ক্ষেত্রে আলাদা প্রতিষ্ঠান করা হলে তারা প্রধানমন্ত্রী থাকার ১০ বছরের সীমাও মানবে না।
মতৈক্য হয়নি রাষ্ট্রের মূলনীতি নিয়েও। বর্তমান সংবিধানে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা আছে। সংবিধান সংস্কার কমিশন এর পরিবর্তে নতুন মূলনীতি হিসেবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্র’র কথা সুপারিশ করেছিল।
এতদিনের আলোচনায় রাজনৈতিক দলগুলো মূলনীতির বিষয়ে একমত হতে না পারায় একটি সংশোধিত প্রস্তাব দিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। সেখানে মূলনীতি হিসেবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, গণতন্ত্র এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সম্প্রীতি’র কথা বলা হয়েছে। তবে এ প্রস্তাবেও দলগুলো একমত হতে পারেনি।
আলী রীয়াজ বলেন, “অন্তত পক্ষে তিনটি (সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার) ভবিষ্যতে যুক্ত করার বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ ঐক্যবদ্ধ। প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্ত করা হবে নাকি উল্লেখ করা হবে? ঐকমত্য কমিশন থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে-যেভাবেই থাকুক বা পরিবর্তিত হোক, তারপরও যেন এগুলো উল্লেখ থাকে।”
এছাড়া নারী প্রতিনিধিত্ব; দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ (নিম্নকক্ষ ও উচ্চকক্ষ) ও দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট সংসদ (উচ্চকক্ষের নির্বাচন পদ্ধতি; প্রধান বিচারপতি নিয়োগ প্রক্রিয়া; রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্য এখনো হয়নি।
নারী প্রতিনিধিত্বের বিষয়ে এক অর্থে ‘অর্ধেক’ ঐকমত্য হয়েছে বলে মনে করেন অধ্যাপক আলী রীয়াজ।
তিনি বলেন, “সবাই চান নারীদের প্রতিনিধিত্ব বাড়িয়ে নিম্নকক্ষে ১০০ আসন যেন থাকে। তবে নির্বাচনের প্রক্রিয়াটা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে।”
ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি জানান, দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ চালুর ক্ষেত্রেও দুই তৃতীয়াংশের বেশি দল একমত হয়েছে। কিন্তু উচ্চ কক্ষের নির্বাচনের প্রক্রিয়া কী হবে তা এখনো অমীমাংসিত।
জ্যেষ্ঠ বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের সুপারিশের বিষয়ে বিএনপি ও কয়েকটি দল বলেছে, এটা একজনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে দুজন করা হোক।
আলী রীয়াজ বলেন, “যেখানে ঐকমত্যটা দেখতে পাই–আগে যেখানে সুপারসিড করার সুযোগ ছিল (রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে নিয়োগ) সে ক্ষমতাটা সীমিত করার বিষয়ে সবাই একমত। এখন নির্ধারিত একটা সংখ্যা থেকে নির্ধারণ করতে হবে, আগে যে কাউকে নিয়োগ দিতে পারেন, সে পদ্ধতিটা সবাই পরিবর্তন চাইছে।”
হাজারো সংস্কার দশ মাসে
ছয় সংস্কার কমিশনের যেসব প্রস্তাব প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করতে পারে, সেগুলো দ্রুত শেষ করার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবিত আশু বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি সভা হয় ১৬ জুন। প্রধান উপদেষ্টার মুখ্যসচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া সভায় সভাপতিত্ব করেন।
সভাপতির বক্তব্যে বলা হয়, প্রতিটি মন্ত্রণালয়/বিভাগ নিজস্ব বাস্তবায়ন টিম গঠন করবে এবং সময়াবদ্ধ কার্যক্রম নেবে।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সচিবের তত্ত্বাবধানে গভর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিট (জিআইইউ)-এর আওতায় একটি তদারকি টিম থাকবে, যা মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখবে এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা দেবে। এছাড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগও এই সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়ন তদারকি করবে।
পর্যায়ক্রমে অন্যান্য সংস্কার কার্যক্রমও এগিয়ে নিতে নিয়মিত এই ধরনের সভা করা হবে।
বিগত মাসগুলোতে সরকারের প্রত্যেকটি মন্ত্রণালয় ছোটবড় বহু সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। মোট ৫৪টি মন্ত্রণালয়ে এক হাজার ৬১টি সংস্কার ও উন্নয়ন সংক্রান্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
পাঁচটি সংস্কার কমিশনের ‘আশু বাস্তবায়নযোগ্য’ ১২১টি প্রস্তাব মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে বিভিন্ন দপ্তরের হাতে গেছে।
এর মধ্যে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের নয়টি, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের ৩৮টি, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের ৪৩টি, পুলিশ সংস্কার কমিশনের ১৩টি এবং জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের ১৮টি সংস্কার প্রস্তাব আশু বাস্তবায়নযোগ্য হিসেবে বাছাই করা হয়েছে।
সংস্কার কতটুকু হচ্ছে?
ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ জানান, ১৬৬টি সুপারিশের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত চেয়েছিল কমিশন।
“পাশাপাশি ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশ থেকে বাছাই করে যেগুলো আশু বাস্তবায়ন করা সম্ভব, আইন সংশোধন ও নতুন আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সম্ভব, অফিস অর্ডারের মাধ্যমে সম্ভব- সবকিছু করার জন্য সরকারের কাছে আমরা তালিকা দিয়েছিলাম।”
তার কিছু কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে জানিয়ে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, “বিচার বিভাগ ও সংবিধান সংস্কার কমিশন জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল করার সুপারিশ করেছিল। ইতোমধ্যে সরকারের পক্ষ থেকে সে ব্যবস্থা করা হয়েছে। সে প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখতে পাচ্ছি, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।”
দুর্নীতি দমন কমিশনের সুপারিশগুলোও দ্রুত বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে জোর দেন ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি।
জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন ও পুলিশ সংস্কার কমিশনের কিছু সুপারিশও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছেন আলী রীয়াজ।
এদিকে সীমানা নির্ধারণ অধ্যাদেশ জারি হয়েছে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব সুপারিশে। সংস্কার কমিশনের কয়েকটি সুপারিশ রেখে আচরণবিধিমালা সংশোধনের খসড়া চূড়ান্ত হয়েছে, কিন্তু আরপিও এখনো সংশোধনের অপেক্ষায়।
নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের একগুচ্ছ সুপারিশ থাকলেও বড় কোনো ধরনের দৃশ্যমান উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি।
গণপ্রতিনিধিত্ব আইনের সংশোধনে ঐকমত্য কমিশনের সুপারিশ চূড়ান্ত না হওয়ায় পদক্ষেপগুলোর অগ্রগতি নেই।
প্রক্রিয়াতেই গলদ?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান মনে করেন, এখন পর্যন্ত যা হয়েছে, তাকে সংস্কার বলা যায় না।
“সংস্কার সুপারিশ নিয়ে ঐকমত্য কমিশনে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলে এবং ঘোষণা এলে তারপরে তো বাস্তবায়ন শুরু হবে। সুতরাং বাস্তবায়নের প্রশ্নটা এখন নেই। এখন প্রশ্ন ঐকমত্য হচ্ছে কিনা।”
সব দলকে গিয়ে বেশিরভাগ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো যে কঠিন কাজ, সে কথা তুলে ধরে এই অধ্যাপক বলেন, “প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত, চিন্তা, চেতনা, এজেন্ডা, আদর্শ আলাদা। দুটি রাজনৈতিক দলের আদর্শ একরকম হয় না; আবার কোনো কোনো দলের আদর্শ তো সম্পূর্ণ বিপরীত।”
কিছু কিছু বিষয়ে ঐকমত্য হলেও সব সংস্কারে সবগুলো দল যে সম্পূর্ণ একমত হতে পারছে না, সে দিকে ইংগিত করে মাহবুবুর রহমান বলেন, “সার্বিকভাবে ঐকমত্যে পৌঁছানো দূরের ব্যাপার হবে। সবকিছুতে না, কিছু কিছু ব্যাপারে ঐকমত্য আমরা দেখতেই পাচ্ছি। কিন্তু অনেক বিষয়ে দূরের ব্যাপার হবে।
“সকল রাজনৈতিক দলের রাজনীতিতে অবস্থান সমান নয়। প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দলকে যদি একইভাবে মূল্যায়ন করা হয়, তাহলে ঐকমত্য আসবে না। ঐকমত্যের পদ্ধতিগত বিষয়ে মারাত্মক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে সরকারের সামনে।”
বিএনপি, জামায়াতে ইসলাম এবং বাম দলগুলোর আদর্শ সম্পূর্ণ তিন রকম। সেখানে সংস্কারে সব বিষয়ে সবাই সম্পূর্ণ একমত হবে কীভাবে–সেই প্রশ্ন রাখেন এ অধ্যাপক।
তিনি বলেন, “এরকম আরও অনেক দল আছে, যাদের আদর্শ ভিন্ন ভিন্ন; তারা তো সব বিষয়ে একমত হতে পারবে না।”
সংবিধান সংস্কারের কিছু বিষয়ে সহজেই মতৈক্য হবে, কিন্তু অনেক বিষয়ে ঐকমত্য কঠিন হবে বলে মনে করেন মাহবুবুর রহমান।
তিনি বলেন, “অনেকেই দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী চায় না। কিন্তু সবাই কি মেনে নেবে? কিন্তু প্রত্যেকটি দলের রাজনৈতিক গুরুত্ব তো একরকম নয়। সংস্কার কমিশনে অংশ নেওয়া সব দলের অবস্থান তো এক নয়।”
ঐকমত্য কোন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে হবে, সেই পদ্ধতিই ঐকমত্য কমিশন ঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেনি বলে মন্তব্য করেন কাজী মাহবুবুর রহমান।
তিনি বলেন, “এই পদ্ধতিটা তারা এক্সপ্লেইন করতে পারে নাই। ব্যাখ্যা করতে পারে নাই। এই ধরনের কোনো পদ্ধতি তারা তুলে ধরতে পারে নাই–যে আমরা একমত বলতে এটা বোঝাচ্ছি।
“ধরেন, বাংলাদেশে ১০০টা দল আছে। এখন ১০০টা দলের প্রত্যেকটা দল কি এক ভোট পাবে? ওয়েটেড ভোটের (weighted vote) দরকার ছিল। ওয়েটেড ভোট না থাকায় একমত হওয়া কঠিন।”
পাঁচ সংস্কার কমিশন নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের কাজ চলছে, কিন্তু বাকি ছয়টি কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন নিয়ে কোনো পদক্ষেপ না থাকায় সমালোচনা করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের এ শিক্ষক।
তিনি বলেন, “ঐকমত্য কমিশন হয়েছে, এগুলো ছাড়া বাকিগুলো বাস্তবায়ন হবে–এরকম কোনো সিদ্ধান্ত তো সরকার জানায়নি। কীভাবে ওগুলো ইমপ্লিমেন্ট হবে? সরকারের তো পলিসিগত সমস্যা আছে এখানে। ঐকমত্য কমিশনের রিপোর্টগুলো বাস্তবায়ন করবে একমত হওয়ার পরে নাকি সবগুলো কমিশনের রিপোর্ট আলাদা আলাদা বাস্তবায়ন করবে? এ ব্যাপারে সরকারের নীতিগত কোনো ব্যাখ্যা স্পষ্ট না।”
নীতিগত পরিবর্তন আর সংস্কার ‘এক নয়’ মন্তব্য করে মাহবুবুর রহমান বলেন, নীতির কিছু পরিবর্তন সবসময়ই হয়। কিন্তু সংস্কারের সুযোগ সবসময় আসে না।
“প্রত্যেকটা মন্ত্রণালয় সবসময় কিছু না কিছু কাজ করে যাচ্ছে, পলিসিগত পরিবর্তন আনছে। ১৫ বছরে মন্ত্রণালয়গুলোতে নানান ধরনের নীতিমালার পরিবর্তন এসেছে, সেগুলোকে আমরা সংস্কার বলব? সংস্কার একটা মেজর জিনিস, মেজর কাজ। এটার ব্যাপারে দৃশ্যমান হতে হবে এবং সবার কাছে একটা বোধগম্য হতে হবে যে সংস্কার হচ্ছে।”
অপেক্ষা জুলাই সনদের
আলী রীয়াজ বলেন, বাংলাদেশে জুলাই সনদ করার প্রয়োজনীয়তা কেন দেখা দিল, সেই পটভূমির বর্ণনা সেখানে থাকবে।
“পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলো যেসব অঙ্গীকার করছে, তা বাস্তবায়ন করবে এবং সুরক্ষা করবে; এগুলোর বিপরীতে কোনো রকম প্রচেষ্টা হলে সেগুলোকে তারা সাধ্যের মধ্যে মোকাবেলা করবে–এমন প্রতিশ্রুতি থাকবে।”
ঐকমত্য কমিশনের ভাষ্য, বাংলাদেশের ভবিষ্যত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর, সাংবিধানিক ব্যবস্থাগুলোর, আইনি কাঠামো প্রক্রিয়াগুলোর কতগুলো সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি এই সনদে থাকবে, যেগুলোর বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো অঙ্গীকারাবদ্ধ হবে এবং সনদে স্বাক্ষর করবে।
“সবগুলো বিষয়ে যদি একমত না হয়, কোনো বিষয়ে যদি দুয়েকটি দলের ভিন্ন মত থাকে, তাদের ভিন্নমতও এ সনদে উল্লেখ করা হবে। দলের নাম উল্লেখ করে তা উল্লেখ থাকবে।”
আলী রীয়াজ বলেন, “আলোচনা যদি অব্যাহতভাবে এগিয়ে নিতে পারি, তাহলে জুলাইয়ের মধ্যে সনদ করা সম্ভব হবে। জুলাই মাসে সনদ তৈরি হওয়া উচিত ও সবার স্বাক্ষর করা উচিত।”
Sharing is caring!