প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৯শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৪ঠা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৮শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

জুলাই সনদ: সংকট কোথায়

editor
প্রকাশিত জুলাই ২, ২০২৫, ০৯:৪৩ পূর্বাহ্ণ
জুলাই সনদ: সংকট কোথায়

Manual5 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

আর এক মাস পরই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি হবে। ৫ আগস্টের সেই অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া লাখো মানুষের প্রত্যাশা ছিল দেশে পরিবর্তন আসবে। সেই লক্ষ্যে দাবি উঠেছিল জুলাই ঘোষণাপত্র ও সনদের। তবে এখনো সেই ঘোষণাপত্র ও সনদ তৈরি হয়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই কারণে সংকট তৈরি হয়েছে। অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে ঐক্যে ফাটল এবং সংস্কারের লক্ষ্যে ব্যাপক বিষয়ের তুলনায় সময় কম থাকা। অন্তর্বর্তী সরকারের এই দুই বিষয়ের সুরাহা করতে না পারার ঘটনাকে হতাশা এবং দুর্ভাগ্যজনক বলছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী।

তিনি বলেন, জুলাই সনদ কিংবা ঘোষণাপত্র নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য হওয়াটা আমাদের দেশের রাজনীতির জন্য নেতিবাচক। অভ্যুত্থানের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং যে জন্য অভ্যুত্থানটা হয়েছে সেটি যদি রাজনৈতিক দলগুলো ধারণ না করে তা হতাশাজনক। ঘোষণাপত্র ও সনদ না হলে অনেক সমস্যা দেখা দেবে।

দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্র তো ছাত্ররা অনেক আগে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সরকারই তো বলল, তারা দেবে। যারা অভ্যুত্থান করেছে, অভ্যুত্থানের ফলে যে সরকার এসেছে তাদের এই প্রত্যাশার বিষয়টি স্মরণ রাখতে হবে। সরকার এটা না করলে সরকারের বৈধতাও থাকে না। রাজনৈতিক দলগুলো কী মনে করল, সেটা নিয়ে চিন্তা না করে ঘোষণাপত্র ও সনদ দিয়ে দেওয়া উচিত।’

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন হয়। পরবর্তী সময়ে অভ্যুত্থানের বৈধতা ও অংশগ্রহণকারীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়ার দাবি ওঠে। ঘোষণাপত্র সাধারণত একটি লিখিত বার্তা, যেখানে আদর্শগত অবস্থান, নীতিমালা, দাবি কিংবা গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকে। জনগণের উদ্দেশে সেই ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়।

অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং পরবর্তী সময়ে গঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটি এ নিয়ে ৩১ ডিসেম্বর ‘প্রোক্লেমেশন অব জুলাই রেভল্যুশন’ কর্মসূচি ঘোষণা করে। একই সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সব রাজনৈতিক দলের মতামতের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই ঘোষণাপত্র দেবে। এ সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি আলটিমেটাম দিয়ে তাদের কর্মসূচিতে পরিবর্তন আনে। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে এ নিয়ে বেশ কয়েকটি সভার আয়োজন করা হয় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। কিন্তু ঘোষণাপত্র হয়নি। এরই মধ্যে নানা ইস্যুতে অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে। নতুন দল (এনসিপি) গঠন করা নিয়ে বিভক্তি দেখা দেয়। একাধিক প্ল্যাটফর্মের আত্মপ্রকাশ ঘটে। তবে গত মে মাসের প্রথমার্ধে রাজনৈতিক দল ‘আওয়ামী লীগ’ নিষিদ্ধের দাবিতে ঐক্যবদ্ধভাবে কর্মসূচি পালন করতে দেখা যায়। গত ১০ মে এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকার জানায়, ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়া হবে। সেই ৩০ কার্যদিবস গত ২৫ জুন শেষ হয়েছে। কিন্তু জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়া হয়নি। এটিকে সরকারের ব্যর্থতা হিসেবে দেখছে অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া শক্তিগুলো।

জুলাই অভ্যুত্থানের শক্তি হিসেবে গঠিত ইউনাইটেড পিপলস বাংলাদেশ (আপ বাংলাদেশ)-এর আহ্বায়ক আলী আহসান জুনায়েদ বলেন, ‘আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ চাই। কোনো দলীয়ভাবে নয়, সরকারকেই এই দায়িত্ব পালন করতে হবে। সরকার তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারেনি। সরকার যদি দ্রুত সময়ে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত না নেয় তাহলে আমরা কর্মসূচি দেব। এ নিয়ে আমরা কাজ করছি।’

Manual7 Ad Code

সাধারণত দেখা যায়, বিপ্লব বা অভ্যুত্থানের দর্শন, ঐক্য তৈরি, বিপ্লবের বৈধতা এবং পরবর্তী সরকারের কার্যক্রমকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ রকম ঘোষণাপত্রের নজির রয়েছে। ফরাসি বিপ্লব, আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণা এবং বেলফোর ঘোষণা অন্যতম। বাংলাদেশেও মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগর সরকারের ঘোষণাপত্র প্রচার করা হয়।

সরকার প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করায় এবং কোনো ধরনের ব্যাখ্যা না দেওয়ায় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ৩ আগস্ট নিজেরাই জুলাই ঘোষণাপত্র দেওয়ার কথা জানিয়েছে। গতকাল দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন।

Manual5 Ad Code

নাহিদ লেখেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্র হচ্ছে জুলাই ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, শহিদ, আহত ও নেতৃত্বদের অবদান ও রাজনৈতিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষা এবং জুলাইয়ের আকাঙ্ক্ষার সংজ্ঞায়ন নিশ্চিতে একটি জাতীয় দলিল, যা পরবর্তীতে আইনি ও সাংবিধানিক ভিত্তি পাবে। সরকার বিভিন্ন দল/পক্ষ থেকে খসড়া ঘোষণাপত্র চেয়েছিল। সেই সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে একটা খসড়া ঘোষণাপত্র দেওয়া হয়েছিল।

Manual3 Ad Code

সবগুলো ডকুমেন্ট মিলিয়ে একটা কমন দলিল তৈরি করার কথা ছিল, যা সব পক্ষ একসঙ্গে উদযাপনের মাধ্যমে ঘোষণা করবে। কিন্তু সরকার দু-দুবার সময় দিয়েও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। কেন করেনি, কোথায় বাধা পেল তা-ও স্পষ্ট করেনি। সরকারের কাছে অবশ্যই আমরা জবাবদিহি চাই এবং আমরা চাই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এ ঘোষণাপত্র জারি করা হোক, যা পরবর্তী সময়ে সংবিধানে যুক্ত করার কমিটমেন্ট থাকবে। কিন্তু সরকার যদি কোনো উদ্যোগই না নেয় আমরা বসে থাকব না। আমাদের বক্তব্য, আমাদের ইশতেহার অবশ্যই আমরা প্রকাশ করব। অন্য সব পক্ষকেও বলব আপনাদের ইশতেহার তৈরি করুন। সবাই মিলে আমরা দলিল তৈরি করতে পারলে সরকার সেটা গ্রহণ করতে বাধ্য থাকবে।’

এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব মুশফিক উস সালেহীন বলেন, ‘আমরা জুলাই ঘোষণাপত্র না হওয়ার পেছনে সরকারের সদিচ্ছার অভাব দেখছি। আর রাজনৈতিক দলের বাধাও এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে বলে মনে করছি।’

তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জুলাই-পরবর্তী রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলোর মধ্যে নিজ স্বার্থের কারণে ব্যাপক মতানৈক্য তৈরি হয়েছে। ফলে গুরুত্বপূর্ণ জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ তৈরি হয়নি।

Manual2 Ad Code

 

গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের বিভিন্ন সিস্টেমের পরিবর্তন ও সংস্কারের জোরালো দাবি ওঠে সর্বত্র। শিক্ষার্থীরা দেয়ালচিত্র, গ্রাফিতির মাধ্যমে নগর থেকে শহর-গ্রাম পর্যন্ত তাদের প্রত্যাশা তুলে ধরে; যা প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যেও নানা সময় উঠে আসে। এ নিয়ে সরকার ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। সেই কমিশনগুলোর প্রস্তাব নিয়ে এখন দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা করছে ঐকমত্য কমিশন। প্রধান উপদেষ্টা গত ৬ জুন এক ভাষণে জুলাইয়ের মধ্যে জুলাই সনদ তৈরির ঘোষণা দেন। তবে এখনো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বিধাবিভক্তি রয়েছে। এ নিয়ে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, জুলাই সনদ বিলম্ব হওয়ার পেছনের কারণ এখানে প্রসেস অনেক লম্বা। বিভিন্ন গণপরিষদে আমরা দেখি, এসব বিষয় দুই-তিন বছর ধরে আলোচনা করে হয়। যেহেতু এখানে সংবিধানের মূল পয়েন্ট নিয়ে কথা হচ্ছে, রাষ্ট্রের কাঠামো নিয়ে কথা হচ্ছে; সময়টা কম হয়ে গেছে। অন্যদিকে বিএনপিসহ কয়েকটি দল মনে করছে, এই সংস্কার হলে বর্তমান সিস্টেমে যে প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা বা একটা দলের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা সেটি কমে যাবে। তারা হয়তো ক্ষমতার কাঠামোটাকে ভারসাম্য করতে ইচ্ছুক না। তারা হয়তো এগোচ্ছে না।

জুলাই সনদ নিয়ে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম গতকাল ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘জুলাই সনদে রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা থাকবে। সংবিধানের কোন কোন জায়গায় পরিবর্তন হবে সে বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্যের দলিল হবে জুলাই সনদ, যেখানে সব দল স্বাক্ষর করবে। জুলাই সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি এখনো ঠিক হয়নি। গণভোট, গণপরিষদ অথবা সংসদে সংশোধনীর মাধ্যমে এই সনদ কার্যকর হবে। পরবর্তী নির্বাচিত সরকার জুলাই সনদ অনুযায়ী সংস্কারের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে বাধ্য থাকবে। জুলাই-আগস্টে জুলাইয়ের ঘোষণাপত্র ও সনদ দুটিই দেওয়া সম্ভব। কোনো একটি পক্ষ যদি দলীয় স্বার্থে ঐকমত্য প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করে তাহলে সরকারের উচিত ভয় না করে অন্য সব পক্ষ ও সাধারণ জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এ ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করা। জুলাই সনদ ও ঘোষণাপত্র দিতে না পারলে সরকারের এখতিয়ার থাকবে না জুলাই উদযাপনে কোনো ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার।’

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual3 Ad Code