প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৫ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৩০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৪শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

মানব পাচারকারীর ওপরই আস্থা ঠকে যাওয়াদের

editor
প্রকাশিত জুলাই ৬, ২০২৫, ০৯:২৪ পূর্বাহ্ণ
মানব পাচারকারীর ওপরই আস্থা ঠকে যাওয়াদের

Manual2 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

মানব পাচারের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হলেও কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না এই অপরাধ। মামলা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খালাস পেয়ে যায় আসামিরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাদী-বিবাদীর আপস-মীমাংসা এর অন্যতম বড় কারণ।

মানব পাচার মামলার তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অনেক সময় পাচারের ঘটনার ভিকটিমই পাচারকারী হিসেবে পরিণত হন। আবার মামলা করলেও আসামিদের ওপরই বেশি আস্থা রাখেন বাদীরা। ব্রনাইয়ের মতো ভালো শ্রমবাজারগুলো বিতর্কের মুখে পড়ছে বাংলাদেশের অসাধু কিছু লোকের কারণে। তবে সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে মানব পাচার নিয়ে জানা যায় ভিন্ন ধরনের তথ্য। পাচারে সংশ্লিষ্ট দালালরাও অনেক ক্ষেত্রে প্রতারণার শিকার হয়। তখন তারাই অভিযোগ নিয়ে আসে পুলিশের কাছে। আবার বিদেশ গিয়ে প্রতারিত হয়ে নিজেরাই মানব পাচারে জড়িয়ে পড়ছে কেউ কেউ। মানব পাচার তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রত্যন্ত এলাকায় ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে একটি গ্রুপ পাচারের উদ্দেশ্যে লোক সংগ্রহ করে। পরে এই দলগুলো ঢাকায় অবস্থিত পাচারকারী বড় সিন্ডিকেটের দ্বারস্থ হয়। কোনো কারণে বড় সিন্ডিকেটের দ্বারা ছোট দলগুলো প্রতারিত হলে ছোট দলগুলো অভিযোগ নিয়ে আসে পুলিশের কাছে।

অতি লোভের কারণে বিতর্কের মুখে পড়ছে ভালো বাজার হিসেবে খ্যাত ব্রুনাইয়ের শ্রমবাজারও। জানা যায়, ব্রুনাইয়ে প্রায় ২০ হাজার বাংলদেশি কাজ করছেন। দেশটির নিয়ম অনুযায়ী একজন শ্রমিকের ন্যূনতম বেতন বাংলাদেশি মুদ্রায় ৪৮ হাজার টাকা। যাওয়ার ব্যয় ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। কিন্তু বাংলাদেশি দালাল চক্র নিচ্ছে ৪ লাখ টাকারও বেশি। আবার সেখানে যাওয়ার পর ৪৮ হাজার টাকা থেকেও একটি অংশ নিয়মিত নিয়ে যাচ্ছে দালাল চক্র।

সিআইডি সূত্রে জানা যায়, সাম্প্রতিক এ রকম বেশ কিছু অভিযোগ জমা পড়ে ব্রুনাইয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে এসব অনিয়ম ও মানব পাচারসংক্রান্ত বিষয় সমাধানে করণীয় নির্ধারণের জন্য আগামী ৭ জুলাই সোমবার ব্রুনাইয়ের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে আসবে সিআইডির সঙ্গে বৈঠক করতে।

Manual2 Ad Code

জানা যায়, একজন কাজ না জানা শ্রমিকও প্রায় পঞ্চাশ হাজার টাকা বেতন পান ব্রুনাইয়ে। সেখানে আগে থেকে কর্মরত বাংলাদেশি শ্রমিকরা প্রতিষ্ঠানের মালিকের কাছ থেকে শ্রমিক নেওয়ার জন্য অনুমতিপত্র বের করেন। কিন্তু তিনি যে সংখ্যক অনুমতিপত্র বের করেন তার চেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষের কাছ থেকে টাকা নেন ব্রুনাইয়ে পাঠানোর জন্য। এভাবে কিছুসংখ্যক মানুষকে ব্রুনাইয়ে নিয়ে যেতে পারলেও অনেকেই হচ্ছেন প্রতারিত। আবার অনেক ক্ষেত্রে প্রতারিত ব্যক্তিরা নিজেরাই বেছে নেন প্রতারণার একই রাস্তা।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, সাম্প্রতিক নৌপথে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া হয়ে অস্ট্রেলিয়ায় যাওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে। শুধু দরিদ্ররাই নন, সচ্ছল পরিবারের অনেকেই বেছে নিচ্ছেন এই পথ। বিপদসঙ্কুল পথে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ারকালে অনেক সময় দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা ঘটছে। আবার অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার আগেই ইন্দোনেশিয়ায় জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ারে ঘটনা ঘটছে।

চলতি বছরের মার্চ মাসে মানব পাচার ও অবৈধ অভিবাসন প্রতিরোধের জন্য বাংলাদেশ ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে স্ট্যাডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) স্বাক্ষর হয়। সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার উপস্থিতিতে এসওপিতে স্বাক্ষর করেন আইজিপি বাহারুল আলম এবং জয়েন্ট এজেন্সি টাস্কফোর্সের ডেপুটি কমান্ডার মার্ক হোয়াটচার্চ। জানা যায়, চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সিআইডির একটি প্রতিনিধি দল মানব পাচার প্রতিরোধ-সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনার জন্য বাংলাদেশসহ অস্ট্রেলিয়ান এম্বাসিতে যাবেন বৈঠকের জন্য।

এদিকে মানব পাচারে অনেক মামলা হলেও বিচার এবং শাস্তির হার খুবই কম। এ ক্ষেত্রে পাওয়া গেছে চমকপ্রদ তথ্য। মানব পাচারের মামলা করলেও অনেক ক্ষেত্রে বাদীই আসামিদের সঙ্গে আপসরফা করে বসেন। তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের মতে, মামলার পর মানব পাচারকারীদের ওপর ভিকটিমরা ৬ থেকে এক বছর পর্যন্ত আস্থা রাখে। টাকা ফেরতের আশ্বাস, হুমকি-ধমকি, সাক্ষীর উপস্থিতি না থাকা, পুনরায় বিদেশ পাঠানোর প্রতিশ্রুতিসহ নানা প্রলোভনে মামলাগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে। এ ছাড়া রয়েছে মামলার দীর্ঘসূত্রতাও।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক-৩ শাখার প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে তদন্তাধীন এবং আদালতে বিচারাধীন মানব পাচার মামলার সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ১৪১টি।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের প্রথম ১০ মাসে আদালত রায় দিয়েছেন মানব পাচারের ৩৩৬ মামলায়। এর মধ্যে মাত্র ১৯ মামলায় ৫০ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। বাকি ৩১৭ মামলায় খালাস পেয়েছেন ১ হাজার ১৭৮ আসামি। ২০২৩ সালে মানব পাচার মামলা ছিল ৮৫১টি (নভেম্বরের হিসাব ছাড়া)। রায় হওয়া ৪৩৬ মামলার মধ্যে ২১টিতে ৭১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়। বাকি ৪শর বেশি মামলায় ১ হাজার ৬১৭ আসামি মুক্তি পায়।

Manual1 Ad Code

২০২২ সালে ৬৯৭টি মামলার বিপরীতে বিচার সম্পন্ন হওয়া ৩৭ মামলায় কোনো আসামির সাজা হয়নি। মুক্তি পায় ১২১ আসামি। ২০২১ সালে ৫৫৪টি (আগস্ট ছাড়া) মামলার বিপরীতে রায় হয় মাত্র দুটি মামলায়। সেখানেও কেউ সাজা পায়নি; খালাস পায় পাঁচজন। ২০২০ সালে মামলা হয় ৫৩৩টি। এর বিপরীতে বিচার শেষ হওয়া ১৪ মামলায় একজনের সাজা এবং ৪৩ আসামি মুক্তি পায়। ২০১৯ সালে ৩৯ মামলার রায়ে ৬৮ আসামি মুক্ত এবং ২৫ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়।

Manual2 Ad Code

সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান বলেন, মানব পাচার রোধে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে সিআইডি। পাচারের নতুন নতুন রুট শনাক্ত করে সিন্ডিকেট শনাক্ত করা হচ্ছে। বিদেশি দূতাবাসগুলোর সঙ্গেও পাচাররোধে সমন্বিতভাবে কাজ করা হচ্ছে।

মানব পাচার মামলায় বেশিরভাগ আসামি খালাস পাওয়া প্রসঙ্গে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর বলেন, এর বেশ কিছু কারণ আছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাদী-বিবাদী নিজেদের মধ্যে আপস করে ফেলেন। যথাযথ সময়ে সাক্ষী না পাওয়াটাও একটি বড় কারণ। আবার কোনো একটি পক্ষ দেশের বাইরে থাকলেও বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়।

Manual4 Ad Code

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual3 Ad Code