প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৫ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৩০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৪শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

বর্বরতায় স্তম্ভিত দেশ

editor
প্রকাশিত জুলাই ১২, ২০২৫, ০৯:৪১ পূর্বাহ্ণ
বর্বরতায় স্তম্ভিত দেশ

Manual7 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর। দর্জি দোকানের কর্মচারী বিশ্বজিৎ দাসকে বাহাদুরশাহ পার্কের সামনে কুপিয়ে ও পিটিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কর্মীরা। দেশব্যাপী ওই ঘটনায় ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। প্রায় এক যুগ পর একই ধরনের নৃশংসতা দেখা গেল পুরান ঢাকার মিটফোর্ডে। স্থান, সময়, হত্যাকারী আর ভিকটিম ভিন্ন হলেও বীভৎসতার মাত্রা যেন ফিরে এলো বহুগুণ বেশি হয়ে।

এক যুগ আগে বিশ্বজিতের হত্যাকারীদেরও একটি রাজনৈতিক দলের পরিচয় ছিল। এবারও তাই হয়েছে। তবে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে এবার খুনিদের পরিচয় তারা যুবদলের কর্মী। এবার ভিকটিম পুরান ঢাকার ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ (৩৯)। ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে তাকে নৃশংসভাবে খুন করা হয়। অনেক মানুষ নীরবে দাঁড়িয়ে ঘটনা দেখলেও এগিয়ে আসেনি কেউ। এই ঘটনায় জনমনে দেখা দিয়েছে তীব্র ক্ষোভ, ভয় আর হতাশা। বর্বরতায় স্তম্ভিত সারাদেশ।

অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও সমাজ বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতায় ক্রমশ পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। সামনের দিনগুলোতে এ ধরনের নৃশংসতার মাত্রা বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে। তারা মনে করছেন, অপরাধ করে সহজে পার পেয়ে যাওয়ার পাশাপাশি আইন প্রয়োগের ব্যর্থতার অভাবে সমাজে সৃষ্টি হয়েছে ভয়ের সংস্কৃতি। যার ফলে এ ধরনের ঘটনায় অনেক প্রত্যক্ষদর্শী থাকলেও নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে কেউ প্রতিরোধে এগিয়ে আসছে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, সাধারণত তিনটি কারণে এ ধরনের সহিংসতা মাত্রা ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমত যদি আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে সক্ষমতার অভাব থাকে, দ্বিতীয়ত অপরাধ করে পার পেয়ে গেলে, তৃতীয়ত সরকার যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়।

তিনি আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেন, সামনের দিনগুলোতে মবকেন্দ্রিক সংঘাত নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে এ ধরনের নৃশংসতার মাত্রা আরও বৃদ্ধি পাবে। অপরাধীরা যদি সন্ত্রাস করে সামাজিক, রাজনৈতিক ও আইনের আওতামুক্ত থাকতে পারে তা হলে এ ধরনের মব সন্ত্রাস ভয়াবহ পর্যায়ে চলে যাবে এবং সেই আলামতই আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি।

সোহাগকে হত্যার সময় অনেক মানুষ আশপাশে থাকলেও কেউ এগিয়ে আসেনি-এ প্রসঙ্গে এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলেন, কারণ সাধারণ মানুষের মনে অপরাধীদের যথাযথ শাস্তির নিশ্চয়তা নিয়ে শঙ্কা আছে। তারা জানে এসব অপরাধী জামিনে বেরিয়ে এসে তাদের খুঁজে বের করবে এবং তাদের ওপরই আক্রমণ করবে।

তিনি বলেন, এই অবস্থাটা সমাজের জন্য খুবই ভয়ের বিষয়। সমাজে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে। মানুষ এখন শুধু নিজের নিরাপত্তা নিয়েই চিন্তা করছে। সমাজ বা রাষ্ট্র তাদের সেই নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। হয়তো তারা মনে মনে এসব সন্ত্রাসীর মুখোমুখি হয়ে প্রতিরোধের ইচ্ছে পোষণ করে, কিন্তু বাস্তবতা সেই নিরাপত্তা তাদের দিচ্ছে না।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহম্মদ ওমর ফারুক বলেন, যখন জনজীবনে নিরাপত্তার ঘাটতি থাকে, অর্থনৈতিক সংকট থাকে, রাজনৈতিক অস্থিরতা থাকে, সরকার বা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দুর্বল অবস্থায় থাকে তখনই এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটে থাকে।

Manual3 Ad Code

তিনি বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে এ ধরনের ঘটনা আরও বেশি ঘটবে। দেশের পটপরিবর্তন হলেও এখনও একটি গ্রুপ অব পিপল এ রকম ঘটনা ঘটিয়ে নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে।

Manual6 Ad Code

তিনি বলেন, সোহাগের ঘটনাটিও এক ধরনের মব ভায়োলেন্স। তবে সবকিছুকে ‘মব ভায়োলেন্স’ তকমা দিয়ে যাচাই করা ঠিক হবে না। এখন একটি গ্রুপ বিশেষ ব্যক্তিকে টার্গেট করে মব ভায়োলেন্সের নামে নিজেদের গোষ্ঠী বা ব্যক্তি স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করছে। তবে শুধু পুলিশ দিয়ে এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব না। এ জন্য সামাজিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। জনগণকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। এ জন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। বিভিন্ন মাধ্যমে এ বিষয়ে ব্যাপক প্রচার কার্যক্রমের মাধ্যমে জনমত তৈরি করতে হবে।

নৃশংস এই ঘটনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারাও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে অনেককে।

জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরেই সোহাগ মিটফোর্ড এলাকার ৪ নম্বর রজনী বোস লেনে ভাঙারির ব্যবসা করতেন। ‘সোহানা মেটাল’ নামে তার একটি দোকানও রয়েছে।

তিনি পুরোনো অ্যালুমিনিয়াম শিট, তামা, পিতল, দস্তা, রাং ও সিসা ইত্যাদি বিক্রি করেন। এলাকায় তার গুদামও রয়েছে। ব্যবসার আধিপত্য নিয়ে গত মঙ্গলবার রাতে তার গুদামে গিয়ে প্রতিপক্ষ গুলি ছোড়ে। এর পর গত বুধবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে রজনী বোস লেনে এক দল লোক তাকে আটক করে, সেখান থেকে মারধর করতে করতে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের ৩ নম্বর ফটক এলাকায় নিয়ে যায়। হাসপাতাল চত্বরের ভেতরে নিয়ে ইট দিয়ে তার মাথা থেঁতলে দেওয়া হয়। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে হাসপাতালের সামনে ফেলে যায় হামলাকারীরা। পরে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

এ ঘটনার একটি সিসি ক্যামেরা ফুটেজ ভাইরাল হলে ঘটনার নৃশংসতায় স্তম্ভিত হয়ে পড়ে সারা দেশের মানুষ।

ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, প্রায় উলঙ্গ সোহাগের নিথর দেহের ওপর লাফাচ্ছে, কেউ মাথায় আঘাত করছে, কেউ সোহাগের বুকের ওপর সিমেন্টের ব্লক দিয়ে অনবরত আঘাত করে চলেছে। আকাশি রঙের শার্ট ও জিন্স পরিহিত এক তরুণকে বারবার এই কাজ করতে দেখা যায়। এ ছাড়া কালো এবং সবুজ গেঞ্জি পরিহিত আরও দুই তরুণকেও একইভাবে সিমেন্টের একই ব্লক দিয়ে সোহাগকে আঘাত করতে দেখা যায়। ঘটনার সময় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। পাশ দিয়ে অনেককে হেঁটে যেতে দেখা যায়। দূর থেকেও এই ঘটনা দেখছিলেন অনেকে। তবে কেউ এগিয়ে আসেননি। ঘটনাস্থলের পাশেই মিটফোর্ড হাসপাতালের আনসার ক্যাম্প ছিল। তারাও সাহায্যের জন্য আসেননি।

সোহাগের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, তিনি দুই সন্তানের জনক ছিলেন। ১৪ বছর বয়সি মেয়ে সোহানা ষষ্ঠ শ্রেণিতে এবং ১১ বছর বয়সি ছেলে সোহান চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। তার গ্রামের বাড়ি বরিশালে। তিনি পরিবার নিয়ে কেরানীগঞ্জের কদমতলীর মডেল টাউন এলাকায় থাকতেন।

সোহাগের বন্ধু মামুন বলেন, গত দুই-তিন মাস ধরে মহিন প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করত সোহাগের কাছে। সোহাগ টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানালে প্রায় দুই মাস আগে দোকানের সামনে এসে হুমকি দিয়ে বলে যায়-‘তোকে দেখে নেব’। এরপর গত বুধবার সন্ধ্যায় সোহাগকে একা পেয়ে মহিনসহ ৪-৫ জন মিলে তাকে পাথর দিয়ে আঘাত করে এবং উলঙ্গ করে নৃশংসভাবে মারধর করে। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। আমরা কেউ ভয়ে এগিয়ে যেতে পারিনি, কারণ মহিন চকবাজার থানা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী ছিল।

পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, সোহাগকে প্রথমে আঘাত করে মহিন। তাকে মারতে মারতে মিটফোর্ড হাসপাতালের ভেতর নিয়ে যায়। সোহাগ এ সময় পুলিশকে ফোন করারও চেষ্টা করেন। হামলাকারীরা এক পর্যায়ে ইট ও সিমেন্টের ব্লক দিয়ে তার মাথা থেঁতলে মৃত্যু নিশ্চিত করে। তারপরও থেমে থাকেনি হামলাকারীরা। তারা মরদেহের ওপর অনবরত আঘাত করতে থাকে।

মূলত ভাঙারি ব্যবসার দখল নিতে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর লাভের একটি অংশ দেওয়ার বিনিময়ে ওই এলাকার ভাঙারির ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের জন্য সোহাগকে দায়িত্ব দেয় মহিনসহ হামলাকারীরা। এক পর্যায়ে পুরো ব্যবসা তাদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করে তারা। এতে রাজি না হওয়ায় সোহাগকে হত্যা করা হয় বলে জানান তার পরিবারের সদস্যরা।

জানা যায়, সোহাগ একসময় যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে বর্তমানেও তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। অন্যদিকে হামলাকারী মহিনসহ অন্যরাও যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে স্থানীয় সূত্রে জানা যায়।

এ ঘটনায় নিহতের বোন মঞ্জুয়ারা বেগম বাদী হয়ে কোতয়ালি থানায় একটি মামলা করেছেন। এতে ১৯ জনের নাম উল্লেখসহ আরও ১৫ থেকে ২০ জনকে অজ্ঞাতনামা বলে উল্লেখ করা হয়। মামলায় যাদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা হলেন-মাহমুদুল হাসান মহিন, তারেক রহমান রবিন, সারোয়ার হোসেন টিটু, মনির ওরফে ছোট মনির, আলমগীর, মনির ওরফে লম্বা মনির, মো. নান্নু, সজীব, রিয়াদ, টিটন গাজী, রাজীব, সাবা করিম লাকী, কালু ওরফে স্বেচ্ছাসেবক কালু, রজব আলী পিন্টু, সিরাজুল ইসলাম, মিজান, অপু দাস, হিম্মত আলী ও আনিসুর রহমান হাওলাদার। এরমধ্যে মহিন ও তারেকসহ ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

ডিএমপির লালবাগ জোনের উপ-পুলিশ কমিশনার জসীম উদ্দিন বলেন, এ ঘটনায় সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকি আসামিদের ধরতে ঢাকাসহ আশপাশের জেলাগুলোতেও পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে। শিগগিরই সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।

Manual6 Ad Code

জানা যায়, পুলিশের পাশাপাশি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও র‌্যাবের একাধিক টিম মাঠে কাজ করছে। রাজধানীর পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোতেও চালানো হচ্ছে অভিযান। মোট ৭ থেকে ৮টি টিম কাজ করছে আসামিদের গ্রেফতারে। ইতিমধ্যেই আসামিদের সবাই পুলিশের নজরদারির ভেতর চলে এসেছে।

Manual1 Ad Code

অন্যদিকে গ্রেফতার মহিনকে ৫ দিন ও তারেকের ২ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual6 Ad Code