প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৫ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৩০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৪শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

অবসরের বয়স বাড়ে ইচ্ছেমতো

editor
প্রকাশিত জুলাই ১৫, ২০২৫, ১২:৩১ অপরাহ্ণ
অবসরের বয়স বাড়ে ইচ্ছেমতো

Manual8 Ad Code

 

Manual8 Ad Code

প্রজন্ম ডেস্ক:

জীবনে কোনো দূরই দূরে নয়। তবে সত্যি সত্যিই অবসর নেওয়ার বয়স যখন দরজায় কড়া নাড়ে, তখন মনে হয় আরও কয়েকটা দিন চাকরি করতে পারলে মন্দ হতো না। তখনই নিজেদের মতো করে কলকাঠি নাড়া শুরু করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের দুজন পরিচালক এ বছরেই অবসরে যাবেন। তারা সবসময়ই সংস্থাটির প্রাইম পোস্টগুলোতে চাকরি করেছেন। এখন অবসরের সময়ে এসে মনে হচ্ছে আরও কিছুদিন চাকরি করতে হবে। সংস্থাটিতে কর্মকর্তা, কর্মচারী, প্রকৌশলী, পাইলট কেবিন ক্রুসহ অন্যদের নানা সংগঠন, ইউনিয়ন ও অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে। এসব সংগঠন, ইউনিয়ন ও অ্যাসোসিয়েশন নেতাদের ডেকে এই দুই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ‘উসকে’ দিচ্ছেন।

তাদের বলেছেন, ‘সংগঠনের প্যাডে চাকরি থেকে অবসরের বয়স বাড়ানোর দাবি জানাতে।’ সেই চিঠিতে কি লিখতে হবে তার খসড়াও তারাই করে দিচ্ছেন। এ ধরনের একাধিক সংগঠন, অ্যাসোসিয়েশন ও ইউনিয়নের চিঠি বিমান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছেছে। এসব আবেদনের বক্তব্য একই। রেফারেন্স হিসেবেও একই বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এসব চিঠিতে বলা হয়েছে, বিদ্যুতের সরকারি কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ৬২ বছর বয়সে অবসর নিচ্ছেন। কয়টি ব্যাংকেও এই বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। কাজেই বিমানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবসরের বয়সও বাড়াতে হবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সংগঠনের নেতা দেশ রূপান্তরকে এ তথ্য জানিয়েছেন।

গণহারে বিমান কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার বয়স বাড়ানোর এই উদ্যোগ নেওয়ার আগেই প্রকৌশল ও ম্যাটেরিয়াল ম্যানেজমেন্ট পরিদপ্তরের প্রকৌশলী এবং প্রকৌশল কাজে সংশ্লিষ্ট টেকনিক্যাল কর্মচারীদের চাকরির অবসরের বয়সসীমা ৫৯-এর পরিবর্তে ৬২ বছর উন্নীত করা হয়। গত ৯ অক্টোবর এ সংক্রান্ত প্রশাসনিক আদেশ জারি করার আগে এসব প্রকৌশলী ও কর্মীদের অবসরের বয়স ছিল ৫৯ বছর। এরপর জারি করা হয় পাইলটদের বয়স ৫৯ থেকে ৬২ করার আদেশও।

Manual4 Ad Code

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও সরকারের সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, ‘সরকারের কর্মচারীদের চাকরি থেকে অবসরের বয়স নির্ধারণ করা আছে। অনিবার্য প্রয়োজনে সরকার এই নির্ধারিত সময়ের পরেও চুক্তিতে নিয়োগ দিতে পারে। এরপর কোনো সরকারি কোম্পানির কর্মকর্তা কর্মচারীর অবসরের বয়স গণহারে বাড়ানো উচিত নয়। কারণ এটা সংবিধানবিরোধী। সংবিধানে সমঅধিকারের কথা বলা হয়েছে। এরপরও সরকার সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের ধরন বুঝে কিছু ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও গণহারে নয়। মনে রাখতে হবে এগুলো সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি। অর্থাৎ এর মালিক সাধারণ মানুষ। এ ধরনের কাজ করতে গেলে জনস্বার্থ বিবেচনা করা উচিত। আমরা অতীতেও দেখেছি, ঢাকা ওয়াসার এমডি পদে ১৫ বছর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার ঘটনা। বিষয়গুলোতে জনস্বার্থ উপেক্ষিত হয়।’

অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে সরকারের ব্যয় বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা নেই। তা না হলে গত ১৮ নভেম্বর যখন চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩২ করা হয়, তখনই অবসরের বয়স বাড়ানোর বিষয়টি বিবেচনায় ছিল। কিন্তু আর্থিক সংশ্লেষের কারণে সে পথে যায়নি সরকার। কোম্পানিগুলোর সুযোগ আছে নিজস্বভাবে পরিচালনার। সেই সুযোগ নিয়েই সরকারি মালিকানাধীন এসব কোম্পানিগুলোর নীতি নির্ধারকরা নিজেদের বয়স বাড়িয়ে নিচ্ছে। কিন্তু এগুলো করা উচিত নয়। কারণ সরকারি মালিকানাধীন কোম্পানি পরিচালনা নীতি সরকারের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হতে পারে না। অতীতে আমরা দেখেছি এগুলো নিয়ে অনেক জটিলতা সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) বিজ্ঞানীদের অবসর গ্রহণের বয়স ৫৯ থেকে ৬৭ বছর করা হয়েছিল। আইন পাসের পরও তা কার্যকর করা যায়নি। সরকারকে বাধ্য হয়ে পাল্টা আইন পাস করাতে হয়েছে। অবসর গ্রহণের সময় বৃদ্ধির অর্থই হচ্ছে বাড়তি খরচ। দিন শেষে এই বাড়তি খরচ জনগণের কাঁধেই বর্তায়। সব ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ জনস্বার্থ আমাদের দেখা উচিত। তারা বাড়তি দিন চাকরিতে থাকলে সাধারণ মানুষের কোনো লাভ হবে না। বরং তাদের বেতন ভাতা পেনশন বা গ্র্যাচুইটি খরচ সাধারণ মানুষকেই বহন করতে হবে। সরকারি কর্মচারীর বেতন ভাতা খাতে বাজেটে ৮২ হাজার কোটি টাকার বেশি বরাদ্দ রাখতে হয়।

 

চাকরি থেকে অবসরের বয়স না বাড়ানোর বিষয়ে সরকার যখন কঠোর তখন একশ্রেণির সরকারি কোম্পানি বা করপোরেশন তাদের মতো করে অবসরের বয়স বাড়িয়ে নিচ্ছে। এতে নানা ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দিচ্ছে। সরকারি চাকরিজীবীদের বড় অংশ যখন অবসর নিচ্ছেন ৫৯ বছওে, তখন বিমানের পাইলট ও ইঞ্জিনিয়াররা অবসর নিচ্ছেন ৬২ বছর বয়সে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো এক্ষেত্রে আরও এক কাঠি সরেস। ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো), পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (পিজিসিবি) এবং ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) কর্মচারীদের অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছর। এসব কোম্পানির পরিচালকদের অবসরের বয়স ৬২ বছর। আর কোম্পানিগুলোর এমডিরা অবসরে যান ৬৫ বছরে।

বিলম্বে চাকরির শুরুর যৌক্তিক কারণে আগে থেকেই বেশি বয়সে অবসরে যাচ্ছেন বিচারপতিরা। তারা চাকরি থেকে অবসরে যান ৬৭ বছরে। এটা ছিল ৬৫ বছর। ২০০৫ সালে যখন সরকার বিচারপতিদের অবসরের বয়স দুই বছর বাড়িয়ে দেয়, তখন এটা নিয়ে সারা দেশে মহাসংকটের সৃষ্টি হয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান পদে নিজেদের লোক বসানোর জন্য বিচারপতিদের বয়স বাড়ানো হয় বলে অভিযোগ ওঠে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অবসরে যান ৬৫ বছরে। তবে সরকারের প্রায় ১৪ লাখ কর্মচারীকে ৫৯ বছরেই অবসরে যেতে হয়।

Manual8 Ad Code

 

আগে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ছিল ২৭ বছর। ১৯৯১ সালে ৩০ বছর নির্ধারণ করা হয়। চলতি বছর তা ৩২ করা হয়। আর অবসরের ক্ষেত্রে আগে সরকারি চাকরির বয়স ছিল ৫৭ বছর। ২০১১ সালে বয়স দুই বছর বাড়িয়ে ৫৯ করা হয়।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সরকারের উচিত অবসরের বয়স বাড়ানো। কারণ আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) বলছে, মানুষের গড় আয়ু বেড়ে বর্তমানে ৭২ দশমিক ৩ বছরে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতার আগে এ দেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৮ বছর। সেখান থেকে ধাপে ধাপে সেক্টরে সেক্টরে সরকার উন্নতি করেছে। উন্নত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়ে এসেছে। চিকিৎসা এখন মানুষের হাতের কাছে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পর সরকারের নজর এখন নিরাপদ খাদ্যের দিকে। এত উন্নয়নের ফলে আমরা আর ৫৯ বছরেই কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলি না। চাকরি থেকে বিদায় নেওয়ার পরও আমরা সুস্থ থাকি। ৬৫ বছরের পরেও অনেকে খুশি মনে কাজ করছেন আর এতে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকছে। কাজেই এই বিবেচনা করে পুরো সরকারি বেসরকারি চাকরিজীবীদের অবসরের বয়স বাড়ানো উচিত। তবে অবশ্যই সেটা কোম্পানি বা করপোরেশন ভিত্তিক আলাদা আলাদা নয়। এতে করে অপচয় বাড়বে বা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হবে।

বিমানের কর্মকর্তা কর্মচারীদের বয়স বাড়ানো নিয়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানিটিতেই দ্বিমত রয়েছে। বিমানের সংগঠনগুলোর অনেকেরই প্রশ্ন অবসরের সীমা বাড়িয়ে দিলে নতুন নিয়োগের সুযোগ কমে জটিলতা আরও বাড়বে! শিক্ষিত যুবকদের কর্মসংস্থানের সুযোগও কমবে।

Manual5 Ad Code

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, যারা যোগ্য যে সেক্টরের কর্মকর্তাদের দেশের উন্নয়নে অবদান আছে তাদের চাকরির থেকে অবসরের বয়স ভিন্ন হতেই পারে। কিন্তু এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার ঘটনা খুব সুখকর নয়। ২০১৭ সালে আইন করে বিসিএসআইআরের বিজ্ঞানীদের অবসরের বয়স ৫৯ থেকে ৬৭ করা হয়। বিধিমালা করে বলা হয়েছিল, তাদেরই অবসরের বয়স বাড়ানো হবে যাদের এ দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। কিন্তু এই আইন পাসের পর বিসিএসআইআরের সব বিজ্ঞানী চাকরি থেকে অবসরের বয়স বৃদ্ধির সুবিধা নিতে চাইলেন। একপর্যায়ে তারা বিষয়টি নিয়ে আদালতে চলে যান। বিশৃঙ্খলা চরম পর্যায়ে পৌঁছানোর পর ওই বছরই আইনের সংশ্লিষ্ট ধারাটি বাতিল করা হয়। অথচ শিল্পসংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানীদের চাকরির অবসরের বয়স বাড়ানো সম্ভব হলে কৃষিবিজ্ঞানীদের অবসরের বয়সসহ বৃদ্ধি করা সম্ভব হতো। কারণ এদেশের কৃষির উন্নয়নে কৃষিবিজ্ঞানীরা দারুণ অবদান রেখেছেন। তাদের নিরলস চেষ্টাতেই ধান চালের উৎপাদন তিনগুণ বেড়েছে। তাদের হাত ধরেই খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে এ দেশ। কিন্তু নানা জটিলতায় তাদের সম্মান জানানো সম্ভব হয়নি।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code