প্রজন্ম ডেস্ক:
বন্দুকের নলের মুখে বুক টান টান করে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। সেই দৃশ্য ছবি হয়ে ছড়িয়ে গেল সবখানে। তার মৃত্যু তারুণ্যের বিক্ষোভে জ্বেলে দিল দ্রোহের আগুন। ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন পরিণত হল হাসিনাশাহির পতন ঘটানো গণ অভ্যুত্থানে।
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে বলা হয় চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ।
তার মৃত্যুর এক বছর পর তার শিক্ষক ও সহযোদ্ধারা বলছেন, দুই হাত প্রসারিত করে গুলির মুখে বুক টান করে দাঁড়িয়ে থাকা আবু সাঈদের সেই ছবি পরের দিনগুলোতে আন্দোলনের একটি ‘আইকনে’ পরিণত হয়েছিল। অকুতভয় আবু সাঈদের সেই আত্মদান ছাত্র-জনতার লড়াই-সংগ্রামে কাজ করেছিল ‘স্ফূলিঙ্গের মত। ক্ষোভের দাবানল ছড়িয়ে দিয়েছিল পুরো বাংলাদেশে।
আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়ানো অনেকেই সেসময় ‘আইকনিক’ সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করেন। সেই দৃশ্যকল্প দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতির রূপ পায়। অভ্যুত্থান পরবর্তী রাষ্ট্রীয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথি ও অনুষ্ঠানেও ছবিটিকে ব্যবহার করা হয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী আবু সাঈদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক ছিলেন। আন্দোলন চলাকালে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই তিনি গুলিতে নিহত হন।সহপাঠীরা এখনো ক্লাসে বসে তাদের এই সাহসী বন্ধুটিকে ‘মিস’ করেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক, বেগম রোকেয়ার ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী সাবিনা ইয়াসমিন বললেন, “আবু সাঈদ প্রায়ই বলতেন, আমরা দাবি আদায় করেই ছাড়ব। তার দৃঢ় সংকল্প আমাদের সবাইকে আন্দোলনে উজ্জীবিত করেছিল।”
পরম্পরা
২০১৮ সাল পর্যন্ত ৫৬ শতাংশ পদে কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের সুযোগ ছিল। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনিদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারীদের জন্য ১০ শতাংশ, জেলাভিত্তিক ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য ৫ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী প্রার্থীদের জন্য ১ শতাংশ কোটা সংরক্ষিত ছিল। ওই বছর জাতীয় নির্বাচনের আগে কোটা সংস্কারের দাবিতে বড় ধরনের বিক্ষোভের মুখে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার।
ওই পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। এরপর ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে টানা চতুর্থবার আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় বসার পর ওই রিট আবেদনের নড়াচড়া শুরু হয়। ২০২৪ সালের ৫ জুন সেই আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি শেষে কোটা পদ্ধতি বাতিলের সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় হাই কোর্ট।
এরপর নতুন করে আন্দোলন শুরু হয়। গঠিত হয় নতুন প্ল্যাটফর্ম ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হওয়া সেই আন্দোলন পরে ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। ১ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে বিক্ষোভ হয় ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে তিন দিনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
ছাত্রদের ধারাবাহিক কর্মসূচির মধ্যে ১৪ জুলাই কোটা পুনর্বহালের নির্দেশ দিয়ে হাই কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। ওইদিন গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্তব্য ক্ষোভ আরও উসকে দেয়।
এক প্রশ্নে তিনি বলেছিলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি পুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি পুতিরা (চাকরি) পাবে?”
তিনি সাফ জানিয়ে দেন, কোটার সমাধান দেবে আদালত, অশান্তি হলে আইন চলবে নিজের গতিতে।
ওইদিন গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে মিছিল বের হয়। ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার, রাজাকার’ স্লোগান উঠলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে ওঠে।
১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগসহ সরকার সমর্থকরা। নিরীহ ছাত্রীদের ওপর লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলার ছবি আর ভিডিও সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে, ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায় সাধারণ মানুষ। দেয়ালে দেয়ালে ‘স্বৈরাচারবিরোধী’ স্লোগান দিয়ে গ্রাফিতি আঁকা শুরু হয়।
ছাত্রলীগের হামলার প্রতিবাদে ১৬ জুলাই দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সেদিনও দেশব্যাপী বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। পাশাপাশি পুলিশও মারমুখী অবস্থান নেয়।
রংপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবু সাঈদ। সারা দেশে মৃত্যু হয় ছয়জনের।
সেদিন বিকালে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে শিক্ষার্থীরা জড়ো হলে পুলিশ তাদের সরাতে কঁদুনে গ্যাস ছোড়ে, লাঠিপেটাও করে। শিক্ষার্থীদের ওই আন্দোলনে নেতৃত্বে ছিলেন আবু সাঈদ।
পুলিশের ধাওয়ায় শিক্ষার্থীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে আবু সাঈদ দুই হাত প্রসারিত করে বুক পেতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে যান। রাস্তার উল্টো দিকে মাত্র ১৫ মিটার দূর থেকে তার ওপর শটগানের গুলি চালান অন্তত দুই পুলিশ সদস্য।
সেই ছবি আর ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে। ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় সড়কে অবস্থান নিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয় শিক্ষার্থীরা। মহাখালীতে রেলপথ অবরোধ করে ঢাকার সঙ্গে সারাদেশের ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া হয়। অবরোধ করা হয় ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক।
রাজধানীর পথে পথে সেদিন সংঘর্ষ চলে। ছাত্রলীগ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষে ঢাকা কলেজ ও সায়েন্সল্যাব এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সেখানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে ছাত্রলীগ-পুলিশের সংঘর্ষে দুইজন নিহত হন। চট্টগ্রামে সংঘর্ষে নিহত হন তিনজন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন পরদিন দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে কফিন মিছিল ও গায়েবানা জানাজার কর্মসূচি ঘোষণা করে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের সকাল থেকে নিজ নিজ ইউনিট অফিসে অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।
এই পরিস্থিতির মধ্যে ১৬ জুলাই রাতে পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, রংপুর, রাজশাহী ও গাজীপুরে মোতায়েন করা হয় বিজিবি। দেশের সব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও অধিভুক্ত কলেজ বন্ধ ঘোষণা করা হয়, শিক্ষার্থীদের দেওয়া হয় হল ত্যাগের নির্দেশ।
পাশাপাশি দেশের সব মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। ১৮ জুলাইয়ের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়।
এরপর একের পর এক মৃত্যু, সরকারি সম্পত্তিতে হামলা, আগুনের মধ্যে ১৯ জুলাই কারফিউ দিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি শেখ হাসিনা সরকার। তুমুল গণ-আন্দোলনের মধ্যে ৫ অগাস্ট পতন হয় টানা সাড়ে ১৫ বছরের আওয়ামী লীগের শাসন। শেখ হাসিনা বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে ভারতে পাড়ি জমান।
‘অন্যরা সরে গেলেও আবু সাঈদ দাঁড়িয়ে ছিলেন’
রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের জন্ম ২০০১ সালে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুর গ্রামে। মকবুল হোসেন ও মনোয়ারা বেগম দম্পতির ছয় ছেলে আর তিন মেয়ের মধ্যে সাঈদ ছিলেন সবার ছোট।
তিনি জাফর পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়ে উত্তীর্ণ হন। এরপর খালাশপীর দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পান। বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক পরীক্ষাতেও ইংরেজি বিভাগে সিজিপিএ-৪ এর মধ্যে ৩.৩০ পেয়ে মেধা তালিকায় ১৪তম স্থান অধিকার করেন।
১৬ জুলাই যখন আবু সাঈদকে গুলি করা হয়, তখন ঘটনাস্থলে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের ছাত্র ও সংবাদকর্মী তাওহিদুল হক সিয়াম। তিনি নিজেও গুলিতে আহত হয়েছিলেন সেদিন।
তিনি বলছিলেন, রংপুরের ছাত্র-ছাত্রীরা কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরু থেকেই রাজপথে কাঁপিয়েছে। শহরে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে সেসব কর্মসূচিতে ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা হামলা চালিয়েছে। অনেকে আহত হয়েছেন। কিন্তু শিক্ষার্থীরা মাঠ ছেড়ে যাননি।
১৬ জুলাইয়ের ঘটনা বর্ণনা করে সিয়াম বলেন, পুলিশ সেদিন বেপরোয়াভাবে রাবার বুলেট, কাঁদুনে গ্যাস ও গুলি করে ছাত্রদের ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। আবু সাঈদের হাতে তখন শুধু একটি সাধারণ লাঠি ছিল। সবাই সরে যাচ্ছিল। কিন্তু আবু সাঈদ সরেননি। তিনি বুক পেতে দিয়েছিলেন। খুব কাছ থেকে তাকে গুলি করা হয়। আবু সাঈদ লুটিয়ে পড়েন।
“আমি ও আরো কয়েকজন আবু সাঈদকে বাঁচানোর চেষ্টা করি। আমরা তাকে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি। তাকে যখন নিয়ে আসছিলাম, পুলিশ আবারও গুলি ছোড়ে। আমার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ৬০টি ছররা গুলি ঢোকে।”
সিয়াম বলেন, “আবু সাঈদকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমার পাশে থাকা শিক্ষার্থী আহমাদুল হক আলভী আমাকেও হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমি সেখানে বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে আমার ভাই আবু সাঈদের লাশসহ আরো ১৫-১৬ জন আহত শিক্ষার্থীকে দেখতে পাই। তখন আমি প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে নিরাপত্তাজনিত কারণে হাসপাতাল ত্যাগ করি।”
তার মতে, “সেদিন আবু সাঈদের আত্মত্যাগ কাজ করেছিল ‘স্ফূলিঙ্গের মত’। সবাইকে সাহস যুগিয়েছিল। আন্দোলনকে করেছিল বেগবান।”
আবু সাঈদের মৃত্যু কীভাবে হয়েছিল, তা নিয়েও ধোঁয়াশা তৈরি করা হয়েছিল আওয়ামী লীগের শেষ সময়ে। বলার চেষ্টা হয়েছিল, গুলিতে নয়, তিনি মারা গেছেন মাথায় আঘাত পেয়ে।
সেদিনের সহিংসতার ঘটনায় শেখ হাসিনা সরকার পতনের আগে একটি মামলা করেছিল পুলিশ। ১৭ জুলাই তাজহাট থানায় মামলা করেন বিশ্ববিদ্যালয় ফাঁড়ির ইনচার্জ বিভূতি ভূষণ রায়।
মামলায় সরকারি কাজে বাধা সৃষ্টি করে গুরুতর জখম, চুরি, ভাঙচুর, ক্ষতিসাধন, অগ্নিসংযোগ ও নিরীহ ছাত্রকে হত্যার অপরাধে আসামি করা হয় অজ্ঞতানামা উশৃঙ্খল দুই থেকে তিন হাজার আন্দোলনকারী, ছাত্র নামধারী দুর্বৃত্তসহ বিএনপি, জামায়াত-শিবির সমর্থিত নেতাকর্মীদের।
মামলার বিবরণের মাঝে এক জায়গায় বলা হয়, বিভিন্ন দিক থেকে আন্দোলনকারীদের ছোড়া গোলাগুলি ও ইট-পাটকেল নিক্ষেপের একপর্যায়ে একজন শিক্ষার্থীকে রাস্তায় পড়ে যেতে দেখা যায়। তখন সহপাঠীরা তাকে ধরাধরি করে জরুরি চিকিৎসার জন্য বিকাল ৩টা ৫ মিনিটে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত বলে ঘোষণা করেন। মৃত ছাত্রের নাম আবু সাঈদ।
আবু সাঈদের মৃত্যুর ২ মাস ৮ দিন পর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। সেখানে বলা হয়, আবু সাঈদের মুখ থেকে ঊরু পর্যন্ত ছিল ছররা গুলির চিহ্ন। ছররা গুলি ঢুকে তার শরীরের ভেতরের বিভিন্ন অংশে গর্ত তৈরি করেছিল। এ কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়। তার মাথার বাঁ দিকেও আঘাতের কারণে রক্তজমাট ছিল।
ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক রংপুর মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রাজিবুল ইসলাম সেদিন স্পষ্ট করেই বলেন, গুলি করে হত্যা করা হয়েছে আবু সাঈদকে।
‘ছেলের লাশটাও পুলিশ নিয়ে নেয়’
রংপুর শহর থেকে আবু সাইদের বাড়ি প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে। যাওয়া যায় দুভাবে। নগরী থেকে দর্শনা দিয়ে ভেণ্ডাবাড়ী হয়ে খালাশপীর; তারপর সেখান থেকে সাঈদের বামনপাড়া গ্রামের বাড়ি। আবার নগরীর মর্ডান মোড় থেকে পীরগঞ্জ উপজেলা সদর হয়েও খালাসপীর যাওয়া যায়।
বাড়ির পাশেই আবু সাঈদের কবর। কবরটি চারপাশে বাঁশের বেড়া দেওয়া। বাড়িতে আগে মাটির ঘর থাকলেও সম্প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে একটি টিনের আধা পাকা বাড়ি করে দেওয়া হয়েছে।
বাড়িতে বাবা-মা ছাড়াও আবু সাঈদ হত্যা মামলার বাদী তার বড় ভাই রমজান আলীকে পাওয়া যায়। তারা জানান, আবু সাঈদের কবর জিয়ারতের জন্য নানা জায়গা থেকে মানুষ আসে।
আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন বলছিলেন, “ছেলেটা নিজে টিউশনি করে অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করেছে। কিন্তু জীবনে সুখ উপভোগ করতে পারল না। আল্লাহ যেন তার জান্নাত কবুল করে।”
১৬ জুলাইয়ের কথা স্মরণ করে মকবুল হোসেন বলেন, “সেদিন দুপুরে জানতে পারলাম যে, আমার ছেলে গুলিতে মারা গেছে। আমার বড় বেটা আর বেটি জামাই অটোরিকশা ভাড়া করে করে অমপুর চলে যায়। কিন্ত যেয়ে লাশের কোনো সন্ধান পায়নি। লাশ নাকি গুম করছে। গুলি লাগার পরে ছাত্ররা মেডিকেল নিয়ে গ্যাইছে সেখানে ডাক্তার মৃত ঘোষণা করছে।
“পরে লাশ পায়। সেখান থেকে নিয়ে আসতে ধরছে রাস্তায় পুলিশ লাশ কাড়ি নিয়ে গেছে। তারপর রাত ২টায় সংবাদ পাই, লাশ মর্গে আছে। কিন্তু যেয়ে দেখতে চাইছে, দেখায় না। পরে আমার বেটা বলছে, ভাই মরছে, দেখতে পারব না?’ তারপর নাকি দেখাইছে।
“লাশ আনতে চায়, লাশ আনতে দেয় না। তারা বলে, কবর তৈরি হইছে? ছেলে বলে, হইছে। তখন বলছে, রাত ৩টায় লাশ যাবে। তারপরও রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় লাশ আটক করে রাখে, এখানের খোঁজ-খবর নেয়। তারপর লাশ আসে বাড়িতে।”
মকবুল বলেন, “তারপরও প্রশাসন এসে বলে, রাতেই মাটি দিতে হবে। আমি বলি, কবর খুড়বে কে? তখন তারা বলে, আমরাই খুড়ব। ভেকু দিয়ে খুড়ি আর পুতি থুই। তখন আমি বলি, না এভাবে হবে না। আমি বাধা দেই। আমি আমার মত করে মাটি দিতে চাই। তখন তারা বলে, খুব সকালে মাটি দিতে হবে। তখন আমি বলি, না সকালে মানুষ ঘুম থেকে ওঠে না, আমার আত্মীয়-স্বজন আছে তারা আসবে। তখন ঠিক করল, সকল ৮টায়। কিন্ত আমরা মাইকিং করলাম, সকাল ৯টায় মাটি হবে। এজন্য তারা আমাদের কাছে অনেক জবাব নিয়েছে। এগলা বহুত জুলুম-অত্যাচার সহ্য করে মাটি দেওয়া হয়েছে।”
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “এক বছর পূর্ণ হল, মাত্র চারজন আসামি আইনের আওতায় এসেছে। বাকি আসামি বাইরে বহাল তবিয়াতে। সরকারের কাছে আমার আকুল দাবি, বাকি আসামিদের আইনের আওতায় আনা হোক।”
মামলার অগ্রগতি দেখছেন না বাদী
বড় ভাই রমজান আলী বলছিলেন, “আমার ভাই ছোট থেকেই নম্র-ভদ্র। সে কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিল না। আমার ভাইয়ের জীবনটা অকালে ঝরে গেল।
“এক বছর হয়ে গেল বিচারের কোনো অগ্রগতি নাই। আমার ভাইকে যারা মেরেছে তাদের বিচার দ্রুত করতে হবে। সরকারের কাছে আমাদের আকুল আবেদন, যারা আমার ভাইকে মেরেছে তাদের সবাইকে আইনের আওতায় এনে দ্রুত বিচার করতে হবে।”
রমজান বলছিলেন, “আবু সাইদের ছোটবেলার স্মৃতি যখন মনে পড়ে তখন আর ঠিক থাকতে পারি না। মনে হয়, আমার ছোট ভাই আবু সাইদ আমার সামনে বলছে, বড়ভাই চলেন, মাঠে যাই কাজ করতে। ভাই, আমাদের বলার ভাষা নাই।”
এ সময় পাশে ছিলেন আবু সাইদের মা মনোয়ারা বেগম। তিনি বলছিলেন, “আমার বাবা তো আর নাই। বাড়িঘর টাকা-পয়সা সব আছে, আমার বাপ তো নাই। আমার ঘুম আসে না বাবার কথা মনে পড়লে। পৃথিবীর সব কিছু মনে হয় যেন উল্টা-পাল্টা।
“আমার বাবাকে যারা মেরেছে আমি তাদের বিচার চাই। আমার বাবা কোনো দোষ করে নাই। আমার বাবার অপরাধ ছিল হাসিনার কাছে চাকরি চাওয়া, চাকরি হয় নাই, তারপরও আমার বাবাকে কেন তারা মারল? আমি বিচার চাই, আমি বিচার চাই।”
মামলার অবস্থা
আবু সাঈদ নিহতের ঘটনায় ১৮ অগাস্ট বড় ভাই রমজান আলী ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় ৩০ থেকে ৩৫ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন।
এ ছাড়া গত ১৩ জানুয়ারি সাঈদের পরিবার ২৫ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি ওই হত্যার ঘটনায় ট্রাইব্যুনালে মামলা (আইসিটি বিডি কেস নম্বর: ১২/২০২৫) করেন চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট এম তাজুল ইসলাম। তদন্ত প্রতিবেদনে আবু সাঈদ হত্যার সঙ্গে ৩০ জনের সম্পৃক্ততার বিষয় উঠে এসেছে।
আবু সাঈদ হত্যা মামলায় চার আসামি কারাগারে আছেন। তারা হলেন- পুলিশের সাবেক এসআই আমির হোসেন ও কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর শরিফুল ইসলাম ও ছাত্রলীগকর্মী ইমরান চৌধুরী আকাশ।
বাকি ২৬ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু পরে আইনজীবী ট্রাইব্যুনালকে জানান, রাফিউল হাসান ও আনোয়ার পারভেজ নামে দুইজন আসামি অন্য মামলায় আটক রয়েছেন। সেইজন্য ওই দুইজনকে প্রডাকশন ওয়ারেন্ট মূলে এ মামলায় হাজির করানোর জন্য আবেদন করা হয়। ট্রাইব্যুনাল সেটি মঞ্জুর করে। সেই দুজন আসামির বিরুদ্ধে প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট জারি করা হয়েছে।
বাকি পলাতক ২৪ জনকে আদালতে হাজির হওয়ার জন্য সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার আদেশ দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। মামলা পরবর্তী শুনানির জন্য ২২ জুলাই দিন রয়েছে।
পলাতক আসামির তালিকায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. হাসিবুর রশীদ, রংপুর মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান, রংপুর মহানগর পুলিশের সাবেক উপকমিশনার (অপরাধ) মো. আবু মারুফ হোসেন রয়েছেন।
স্মরণে আবু সাঈদ
আবু সাঈদের এই আত্মত্যাগের স্মরণে ১৬ জুলাই পালিত হবে ‘জুলাই শহীদ দিবস’ হিসেবে। দিনটি উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
অনুষ্ঠানে আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন থাকবেন প্রধান অতিথি। আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক ই আজম বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন।
আবু সাঈদের সহপাঠী ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী রাকিব আহমেদ বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়েছে। আমরা ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষায় ফিরেছি। কিন্তু আমাদের ভাই আবু সাঈদ আর কখনোই ক্লাসে ফিরবেন না।
“তাকে ছাড়া বিভাগে এসে ক্লাস করে কতটা শূন্যতা অনুভব করি, তা ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়। দুই হাত দুই দিকে টান করে বুক চিতিয়ে দেওয়া আবু সাঈদকে কাছ থেকে যেভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, সেই দৃশ্য মনে হলে কিছুটা নিস্তব্ধ ও নির্বাক হয়ে যাই।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান আসিফ আল মতিন বলেন, “আবু সাঈদ ছিলেন নম্র আর ভদ্র। নিজের কষ্ট সে কখনও প্রকাশ করত না। ক্লাসে নিয়মিত ছিল। স্নাতক ভালভাবে শেষ করেছিল। বেঁচে থাকলে তার জীবনটা অন্যরকম হতে পারত।
“আবু সাঈদ তার জীবন উৎসর্গ করেছে। আমরা যেন তার এই ত্যাগের যথাযথ মূল্য দিতে পারি।”
Sharing is caring!