প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২০শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৫ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৯শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

শুল্ক জটে ব্যবসায়ীরা চাপে

editor
প্রকাশিত জুলাই ১৯, ২০২৫, ০৯:৩৩ পূর্বাহ্ণ
শুল্ক জটে ব্যবসায়ীরা চাপে

Manual7 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

কয়েক বছর ধরেই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে অস্থিরতা ছিল। তবে সাম্প্রতিককালের কয়েকটি ঘটনা ব্যবসা-বাণিজ্যকে নতুন করে চাপে ফেলেছে। গত ৭ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে বাংলাদেশি পণ্যে ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করায় তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানিকারকরা বড় ঝুঁকি দেখতে পাচ্ছেন। জ্বালানি সংকটও তীব্র। ব্যাংক ঋণে উচ্চসুদ বিরাজ করছে। ফলে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রফিট মার্জিন কমছে। টিকে থাকতে এ খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো নানা ক্ষেত্রে ব্যয় কমানোর উদ্যোগ নিচ্ছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা অব্যাহত থাকায় নতুন বিনিয়োগ আসছে না। সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে একটা অনিশ্চয়তা লক্ষ করা যাচ্ছে।

সবচেয়ে বড় ম্যানুফ্যাকচারিং খাত হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্প। এ শিল্পে এখন নানা সংকট। আগামী বছর বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে বেরিয়ে গেলে এমনিতেই চাপ বাড়বে। ইউরোপের বাজারে তখন আর অগ্রাধিকারমূলক বাজার-সুবিধা পাওয়া যাবে না। যদিও তিন বছর এ সুবিধা থাকবে বলে জানিয়েছে ইইউ। তবু এটি দেশের তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য বড় চাপ। পোশাক রপ্তানিতে সবচেয়ে বর্ধনশীল বাজার ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দেশটিতে বছরে প্রায় সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়। এ রপ্তানির প্রায় ৯০ শতাংশ তৈরি পোশাক। গত ৭ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করার পর তা কমানোর জন্য সরকারের তরফ থেকে দরকষাকষি করা হচ্ছে, যদিও এখন পর্যন্ত আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি। বর্তমানে ১৫ শতাংশ শুল্ক রয়েছে। সব মিলে এখন থেকে মার্কিন বাজারে ৫০ শতাংশ শুল্ক দিয়ে পণ্য রপ্তানি করতে হবে। এটি তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিষয়টি আরও গুরুতর এ কারণে যে, মার্কিন বাজারে অন্য যেসব দেশ পোশাক রপ্তানি করে, তাদের শুল্কহার বাংলাদেশের চেয়ে কম। বিশেষ করে ভিয়েতনামের, মার্কিন বাজারে দেশটির জন্য শুল্কহার ২০ শতাংশ। সেখানে বাংলাদেশকে দিতে হবে ৫০ শতাংশ শুল্ক। ভারতের শুল্কহারও বাংলাদেশের চেয়ে কম হবে বলে জানা যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানি বড় সংকটে পড়বে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

দেশের অভ্যন্তরেও নানা সংকট বিরাজ করছে অনেক দিন ধরে। তীব্র জ্বালানি সংকট রয়েছে, যা শিল্পোৎপাদনে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। এ সংকটের আশু সমাধানে এখনো কার্যকরী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ব্যবসায়ীদের তাগিদেও কাজ হয়নি। আমদানিনির্ভরতা এর বড় কারণ। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার দেশীয় উৎস থেকে গ্যাস আহরণে জোরালো উদ্যোগ নেয়নি। তারা আমদানির মাধ্যমে জ্বালানি সমস্যার সমাধানে নজর দিয়েছিল। এখন জ্বালানি খাতে পুঞ্জীভূত সমস্যা দেখা দিয়েছে। গত বছরের অভ্যুত্থানের পর জ্বালানি খাতে সংস্কার ও অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গ্যাস উত্তোলনে জোর দেওয়ার সুযোগ তৈরি হলেও তা কাজে লাগানো যায়নি। ঋণের উচ্চসুদও ব্যবসার জন্য বড় সমস্যা। কয়েক বছর আগে ঋণের সুদ ছিল ১ অঙ্কে, অর্থাৎ ৯ শতাংশের মধ্যে; এখন ১৫ শতাংশ। ফলে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চের শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে মাত্র ৭ দশমকি ৫৭ শতাংশ। গত বছর মার্চের শেষে প্রকৃত প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ৪৯ শতাংশ। অভ্যন্তরীণ এবং বহিঃস্থ সমস্যার কারণে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য নানামুখী সংকটে রয়েছে।

Manual1 Ad Code

তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বাবু বলেন, ‘আমরা চ্যালেঞ্জের মধ্যেই থাকি। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বিষয়ে তাদের সিদ্ধান্ত পরিষ্কার করেছে। সরকার ও সংশ্লিষ্টরা আমাদের জানিয়েছেন, তারা সমাধানের চেষ্টা করছেন। তবে সেটি যেন প্রতিযোগী দেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করা হয় এ অনুরোধ আমরা করেছি। প্রতিযোগী দেশ বেশি শুল্ক সুবিধা পেলে আমরা পিছিয়ে যাব। তারা চুক্তিতে বেশি সুবিধা পেলে বাণিজ্যের বড় ব্যবধান তৈরি হবে। এ ব্যবধান কিছুতেই ঘোচানো সম্ভব হবে না।’

Manual2 Ad Code

বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বেশ কিছু শর্ত দিয়েছে বলে গুঞ্জন রয়েছে। সরকার সেসব শর্ত পরিপালনে ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারায় এখনো শুল্ক বিষয়ে সমঝোতা হয়নি। এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘এমন কোনো বিষয় আমার জানা নেই। দুই দেশের সরকারের মধ্যে তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলাপ হতে পারে। এগুলো সরকারের বিষয়। আমাদের লক্ষ্য বাণিজ্যসুবিধা।’

Manual7 Ad Code

অন্যান্য খাতেও সংকট বিরাজ করছে। দেশের যেসব খাত মোটামুটি ভালো ব্যবসা করে তার মধ্যে রয়েছে ওষুধ শিল্প। এ খাতের প্রথম সারির কোম্পানিগুলো কর্মীদের নিয়মিত বেতন-ভাতার পাশাপাশি ইনসেনটিভ বোনাস, কার বিলসহ নানা সুবিধা দিয়ে থাকে। সাম্প্রতিককালে এ খাতও চাপে পড়েছে। দেশের ওষুধ শিল্প মোটামুটি স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও এ খাতের কাঁচামাল আমদানি করতে হয় অন্য দেশ থেকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ডলারের দাম বাড়ার ফলে দেশের ওষুধ শিল্পে উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। কিন্তু সে অনুযায়ী ওষুধের দাম সমন্বয় করা হয়নি। অনেক কোম্পানি গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ উৎপাদন কমিয়ে দিচ্ছে। ফলে জীবনরক্ষাকারী অনেক ওষুধের সংকট দেখা দিতে পারে বাজারে। ওষুধ কোম্পানির প্রফিট মার্জিন কমে যাওয়ায় কর্মীদের সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে ব্যয় কমানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।

Manual4 Ad Code

দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি ওষুধ কোম্পানির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আগে তাদের প্রতিষ্ঠান বছরে চারটি ইনসেনটিভ বোনাস দিত। এখন দুটিতে নামিয়ে এনেছে। অন্যান্য সুবিধাও কমানো হয়েছে। আগে মাসের ১ তারিখে বেতন দিলেও এখন তা প্রায়ই সম্ভব হচ্ছে না।’

দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ও চলমান অস্থিরতার বিষয়ে ব্যবসায়ীরা জানান, টালমাটাল বিশ্ব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, রপ্তানি খাত, পণ্য সরবরাহ তথা সাপ্লাই চেইন, মুদ্রা ও পুঁজিবাজার, জনজীবন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রভৃতি ক্ষেত্রে বহুমুখী সমস্য বিরাজমান। বাংলাদেশের বেসরকারি খাত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে বহুমুখী সংকট বিরাজ করছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বিদ্যুৎ-জ্বালানির তীব্র সংকট, ঋণের উচ্চসুদ সর্বোপরি মার্কিন পাল্টা শুল্ক দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যকে ঘরে-বাইরে সমানভাবে চাপে ফেলেছে। জ্বালানি সংকট সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এলএনজির আমদানিনির্ভরতা অর্থনীতিকে আরও সংকটের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে গ্যাস আহরণে চলতি অর্থবছরের বাজেটে অঙ্গীকার থাকলেও জোরালো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। বাড়তি মূল্যস্ফীতির কারণে ঋণের নীতি সুদহার না বাড়িয়ে কোনো উপায় নেই। উচ্চ সুদহার নতুন বিনিয়োগের জন্য বড় সমস্যা। তবে মূল্যস্ফীতি কমলে সুদহারও কমবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য জরুরি নীতি সহায়তা আবশ্যক।’

মার্কিন পাল্টা শুল্কের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য বড় দুশ্চিতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে মার্কিন পাল্টা শুল্ক প্রসঙ্গ। এটা কমানো না গেলে রপ্তানি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দরকষাকষিতে দক্ষ ব্যক্তিদের দায়িত্ব দিতে হবে।’

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code