প্রজন্ম ডেস্ক:
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ঘটনায় মামলার অগ্রগতি আশাব্যঞ্জক নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ফলে বিচার নিয়ে শহিদ পরিবারগুলোর মধ্যে বাড়ছে হতাশা। তবে আইন উপদেষ্টা আশ্বাস দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েই বিচার সম্পন্ন হবে। অন্যদিকে মামলার ত্রুটি এবং ঢালাওভাবে আসামি করায় ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত হবে বলে মনে করছেন আইনজ্ঞরা।
পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘটনায় মোট ১ হাজার ৬০১টি মামলা হয়েছে। যার মধ্যে ৬৩৭টি হত্যা মামলা। এসব মামলা বিশেষভাবে তদারক করছে পুলিশ সদর দফতর। জানা যায়, জুলাই অভ্যুত্থানের ঘটনায় করা মামলা তদন্তের জন্য পুলিশ হেডকোর্য়ার্টারে বিশেষ সেল গঠন করা হয়েছে। ৮টি বিভাগের জন্য ৮টি এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন ও গাজীপুরের জন্য পৃথক দুটি সেল নিয়ে সারা দেশে ১০টি ‘ম্যান্টরিং অ্যান্ড মনিটরিং’ সেল গঠন করা হয়।
অন্যদিকে গত বৃহস্পতিবার পুলিশ হেডকোর্য়ার্টারের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানকালে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত ঘটনায় রুজুকৃত মামলার মধ্যে ১২টি মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা মামলা ৩টি এবং অন্যান্য ধারায় মামলা ৯টি। এতে আরও উল্লেখ করা হয়, চার্জশিটকৃত ৩টি হত্যা মামলার মধ্যে ৩টি মামলাই শেরপুর জেলার। অন্যান্য ধারার ৯টি মামলার মধ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ১টি, বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের ১টি, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ৩টি, সিরাজগঞ্জ জেলার ২টি এবং পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের তদন্তাধীন মামলা ২টি। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের ঘটনায় মোট মামলার সংখ্যা বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়নি।
অন্যদিকে মানবাধিকার সংগঠনগুলো থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ঘটনায় গতকাল পর্যন্ত ১৭৯৯টি মামলা হয়েছে। এর বিপরীতে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে ১২টি মামলার। শতকরা হিসেবে শূন্য দশমিক ৬৭ শতাংশ মামলার চার্জশিট দেওয়া সম্ভব হয়েছে গত এক বছরে।
‘মানবাধিকার সাংস্কৃতিক ফাউন্ডেশন’(এমএসএফ) থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘটনায় গত ১১ মাস ১৮ দিনে মোট মামলা হয়েছে ১ হাজার ৭৯৯টি। আসামির সংখ্যা ৩ লাখ ৮ হাজার ৬৬৭ জন। প্রতিনিয়তই বাড়ছে মামলা আর আসামির সংখ্যা। ঘটনার ১১ মাস পর গত ৬ জুলাই কুমিল্লার দাউদকান্দিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘটনায় একটি হত্যা মামলা হয়। এতে সাবেক সংসদ সদস্য আবদুস সবুরসহ ৩৮ জনকে আসামি করা হয়।
এমএসএফ থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী ২০২৪ সালের পাঁচ মাসে (আগস্ট-ডিসেম্বর) মামলা হয় ১ হাজার ৬৮৭টি। সবচেয়ে বেশি মামলা হয় অক্টোবর মাসে, ১ হাজার ৯২টি। ২০২৫ সালের ১৮ জুলাই পর্যন্ত মামলা হয়েছে ১১২টি। এসব মামলায় এজাহারনামীয় আসামির সংখ্যা ৭৫ হাজার ৮০৪ জন। অজ্ঞাতনামা আসামির সংখ্যা ২ লাখ ৩২ হাজার ৮৬৩ জন। ১ লাখ ৬৮ হাজারেরও বেশি মানুষ এসব মামলার অজ্ঞাতনামা আসামি।
২০২৪ সালের আগস্টে ২৬৮টি মামলা হয়। এরমধ্যে এজাহারনামীয় ২৬,২৬৪ জন ও অজ্ঞাতনামা ১,৬৮,৫৫৫ জন অজ্ঞাতনামা আসামি। সেপ্টেম্বরে মামলা হয় ২৩৮টি, এজাহারনামীয় ১৯,২৮৩ জন, অজ্ঞাতনামা আসামি ৩০,২৩৫ জন। অক্টোবরে মামলা হয় ১,০৯২টি। এতে এজাহারনামীয় আসামি ১২,১৮০ জন এবং অজ্ঞাতনামা ১৫,৭৯৯ জন। নভেম্বরে ৭২টি মামলায় এজাহারনামীয় আসামি ৫,৮৫৬ জন এবং অজ্ঞাতনামা ৫,৫১৭ জন। ডিসেম্বরে ১৭টি মামলা রুজু হয়। এতে এজাহারনামীয় ১,২০৯ জন এবং অজ্ঞাতনামা ২,১০০ জন।
২০২৫ সালের জানুয়ারি মাসে ৭২টি মামলায় এজাহারনামীয় ৫,৮৫৬ জন এবং অজ্ঞাতনামা হিসেবে ৫,৫১৭ জনকে আসামি হিসাবে উল্লেখ করা হয়। ফেব্রুয়ারিতে ৪টি মামলায় এজাহারনামীয় ৩৬০ জন এবং অজ্ঞাতনামা আসামি ২০০ জন। মার্চে ৯টি মামলা রুজু হয়। যাতে এজাহারনামীয় ১,৯১৪ জন এবং অজ্ঞাতনামা আসামি ১,৮৪০ জন। এপ্রিল মাসে ৩টি মামলায় এজাহারনামীয় আসামি ৭১৫ জন এবং অজ্ঞাতনামা ৭০০ জন। মে মাসে ১৬টি মামলায় এজাহারনামীয় ১,০৭২ জন এবং অজ্ঞাতনামা ২,৪০০ জন অজ্ঞাতনামা আসামি। জুন মাসে ৭টি মামলায় এজাহারনামীয় হিসেবে ১,০৫৭ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। জুলাই মাসে একটি মামলায় ৩৮ জনের নামোল্লেখ করে হত্যা মামলা দেওয়া হয়।
অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘটনায় করা মামলার ত্রুটি এবং ঢালাওভাবে আসামি করার সমালোচনা করে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, যেভাবে এফআইআরে ত্রুটি ও ঢালাও আসামি করা হয়েছে, এতে ন্যায়বিচার করতে চাইলে বেশিরভাগ আসামিই সুবিধা পাবেন। আর এগুলো বিবেচনায় না নিয়ে আগে থেকে অনুমেয় রায় দেওয়া হলে সেটি বহির্বিশ্বে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। ফলে জুলাই হত্যা মামলাগুলোর বিচারকাজ জটিল হয়ে গেছে।
জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী অভ্যুত্থানের ঘটনায় ঢাকা জেলায় মামলা হয়েছে ১১৪টি। এর মধ্যে ১৫টি হত্যা মামলা। এসব মামলার মধ্যে ৩০টির তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এ প্রসঙ্গে পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি রেজাউল করিম মল্লিক বলেছেন, গণঅভ্যুত্থানের ঘটনায় করা মামলা নিবিড়ভাবে মনিটরিংয়ের জন্য ডিআইজি অফিসে একটি বিশেষ মনিটরিং সেল খোলা হয়েছে। মনিটরিং সেলে আমি প্রত্যেকটি মামলার বাদী, ভুক্তভোগী, গণঅভ্যুত্থানে শহিদ ও আহত পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলব এবং আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। এ ছাড়া ঢাকা রেঞ্জ পুলিশের প্রতিটি থানা-ফাঁড়ি-ক্যাম্প-সার্কেল অফিস-এসপি অফিস এবং আমার অফিসেও অভিযোগবক্স স্থাপন করা হবে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মামলা তদন্তে অনেক ক্ষেত্রে ঘটনাস্থলের সাক্ষী, ভিডিও ফুটেজ, সুরতহাল, ময়নাতদন্ত ও মৃত্যুসনদ সংগ্রহরে ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। তবে অনেক ক্ষেত্রেই এই সবকিছু সংগ্রহ করা যাচ্ছে না। ওই সময়ের অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক মৃতদেহই কোনো ধরনের সুরতহাল কিংবা ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করতে বাধ্য হন অনেকে। অধিকাংশ মৃত্যুর ঘটনাতেই হাসপাতাল থেকে মৃত্যুসনদ সংগ্রহ করতে পারেননি স্বজনরা। আবার এজাহারে ভুল ঠিকানা, সাক্ষী খুঁজে না পাওয়া, মাত্রাতিরিক্ত আসামির সংখ্যাসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বিলম্ব হচ্ছে বলে জানান তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
বিচার নিয়ে বাড়ছে হতাশা :
অন্যদিকে দীর্ঘ এক বছরেও জুলাই অভ্যুত্থানে দেশ-বিদেশে আলোচিত বেশ কিছু হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন না হওয়ায় হতাশা দেখা দিয়েছে শহিদ পরিবারগুলোতে। তবে তারা এখনও আশাবাদী বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েই বিচার সম্পন্ন হবে। একই আশার কথা বলেছেন আইন উপদেষ্টাও।
রাজধানীর বনানী বিদ্যানিকেতন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিল গোলাম নাফিজ। গত ৪ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিতে বন্ধুদের সঙ্গে শাহবাগে যাওয়ার সময় ফার্মগেটে ওভারব্রিজের নিচে গুলিবিদ্ধ হয় সে। রিকশার পাদানিতে পড়ে থাকা নাফিসের নিথর দেহের ছবি কাঁদিয়েছিল সব মানুষকে। নাফিজের বাবা গোলাম রহমান বলেন, বিচার তো এখনও পাইনি। বিচারের আশায় আমরা দিন গুনছি। আমরা এখনও আশা করি, ড. ইউনূসের শাসনামলেই এই বিচারের কাজ শেষ হবে।
জুলাই আন্দোলন চলাকালে প্রথম নারী শহিদ নাঈমা সুলতানা। ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই বিকাল ৫টার দিকে রাজধানীর উত্তরার বাসার বারান্দায় শুকাতে দেওয়া কাপড় আনতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তিনি।
নাঈমার মা আইনুন নাহার গণমাধ্যমকে বলেন, বিচারের অগ্রগতি আমরা কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। ড. ইউনূস আমাদের কথা দিয়েছিলেন ২০২৪-এর প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের বিচার ওনি করবেন। কিন্তু দীর্ঘ এক বছরে আমরা সেই বিচার দেখিনি। অথচ নাঈমা হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। স্নাইপার নাঈমাকে গুলি করেছে। সবকিছু ডকুমেন্ট থাকার পরও আমরা বিচারটা দেখতে পাচ্ছি না।
সম্প্রতি আবু সাঈদের ভাই আবু হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের প্রথম শহিদ আবু সাঈদ। সে তো আইকনিক শহিদ। আমরা প্রত্যাশা করেছিলাম, আসলে সবাই প্রত্যাশা করেছিল দিনে দুপুরে আবু সাঈদকে গুলি করে মারা হয়েছে এর বিচার দ্রুততম সময়ে হবে। বিচার প্রক্রিয়া ধীরগতিতে চলছে। তদন্ত করতেই এক বছর পার হয়েছে। এখনও আমরা আশাবাদী ড. ইউনূসের শাসনামলেই বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।
গত বুধবার রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুর গ্রামে শহিদ আবু সাঈদের কবর জিয়ারতের পর এক অনুষ্ঠানে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেই আবু সাঈদ হত্যার বিচার সম্পন্ন হবে।
Sharing is caring!