প্রজন্ম ডেস্ক:
রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। আর এই বিভ্রান্তিকে পুঁজি করে ডালপালা মেলছে গুজব। দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির অসৎ উদ্দেশ্যে নানা মহল থেকে এসব গুজব ছড়ানো হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। তাই সবাইকে এসব গুজবে কান না দিতে আহ্বান জানানো হয়েছে সরকারের শীর্ষ মহলসহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের পক্ষ থেকে।
হতাহতের সংখ্যা নিয়ে ঘটনার পর থেকেই সৃষ্টি হয় বিভ্রান্তির। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সবশেষ তথ্য অনুযায়ী মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ২৯ আর চিকিৎসাধীন ৬৯ জন। বুধবার এ তথ্য জানানো হয়। তবে গত মঙ্গলবার আইএসপিআরের দেওয়া সবশেষ তথ্যানুযায়ী নিহতের সংখ্যা ৩১ জন, আহত ১৬৫। তবে আইএসপিআরের দেওয়া তথ্যের পর গত মঙ্গলবার রাত পৌনে ১টার দিকে মারা যায় ৯ বছর বয়সি নাফির। তাকে নিয়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩২ জনে।
অন্যদিকে অজ্ঞাতনামা মৃতদেহ আছে ৬টি। সিআইডির কাছে অজ্ঞাতনামা এই ৬ মরদেহের জন্য ডিএনএ নমুনা দিয়েছেন ৫টি পরিবার। তবে রেকর্ড কিপিং এবং মুভমেন্টের কারণে তথ্যগত পার্থক্য হচ্ছে জানিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে পার্থক্য দূর হতে কিছুটা সময় লাগবে। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর), স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বার্ন ইনস্টিটিউট ও প্রধান উপদেষ্টার দফতর থেকে দেওয়া তথ্যে গরমিল দেখা দেওয়ায় জনমনে সৃষ্টি হয় সংশয়। লাশ গুমের অভিযোগ তুলে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ঘটে অপ্রীতিকর ঘটনাও। কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের ফেসবুক পোস্ট থেকে ক্রমাগত দেওয়া হয় উসকানিমূলক বিভিন্ন পোস্ট। গত মঙ্গলবার হতাহতের তালিকা প্রকাশের দাবিতে মাইলস্টোন ক্যাম্পাসে পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। মাইলস্টোনে হতাহতের তথ্য গোপনের অভিযোগসহ এইচএসসি পরীক্ষা পেছানোর তারিখ গভীর রাতে প্রকাশের প্রতিবাদে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় সচিবালয়সহ আশপাশের এলাকা। অভিযোগ আছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ এই ঘটনায় ইন্ধন ও উসকানি দেয়। এর আগে গত সোমবার রাতে ‘লাশ গুম করা হচ্ছে’ এমন অভিযোগ তুলে উত্তাল হয়ে ওঠে মাইলস্টোন ক্যাম্পাস।
সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল হতাহতের তালিকা তৈরির উদ্যোগ নেয় স্কুল কর্তৃপক্ষ। এর আগে প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে সবাইকে আশ্বস্ত করা হয়, আহত-নিহতদের সম্পূর্ণ ও নির্ভুল তালিকা প্রকাশের জন্য বাংলাদেশ সরকার, সেনাবাহিনী প্রশাসন, বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একযোগে কাজ করছে। নিহতের সংখ্যা নিয়ে গুজব সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে আইএসপিআর।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব :
বিভ্রান্তি দূর করতে কলেজ ক্যাম্পাসে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ (কন্ট্রোল রুম) স্থাপনের কথা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। বুধবার দুপুরে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে তিনি এ তথ্য জানান। তিনি লেখেন, বিভ্রান্তি দূর করতে কলেজ ক্যাম্পাসেই একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছেন দুই উপদেষ্টা। এই কক্ষ থেকেই প্রতিদিন আহত ও নিহতদের হালনাগাদ সংখ্যা জানানো হবে এবং তা মিলিয়ে দেখা হবে কলেজ রেজিস্টারের উপস্থিতি তালিকার সঙ্গে।
প্রেস সচিব লেখেন, সরকারের মৃত্যুর সংখ্যা গোপন করার কোনো কারণ নেই। শফিকুল আলম বলেন, কলেজ ক্যাম্পাসে যে কন্ট্রোল রুম গঠন করা হচ্ছে, সেখানে বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে।
এর আগে গত ২২ জুলাই প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা নিয়ে অপ্রচার না চালানোর আহ্বান জানানো হয়। আহত-নিহতদের সম্পূর্ণ ও নির্ভুল তালিকা প্রকাশের জন্য বাংলাদেশ সরকার, সেনাবাহিনী প্রশাসন, বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একযোগে কাজ করছে বলে সবাইকে আশ্বস্ত করা হয়। দুর্ঘটনায় নিখোঁজ কেউ থেকে থাকলে স্কুলের কন্ট্রোল রুমে যোগাযোগের জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়।
স্কুল কর্তৃপক্ষের তালিকা তৈরির উদ্যোগ :
যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় আহত, নিহত ও নিখোঁজদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ধারণ এবং তাদের ঠিকানাসহ একটি তালিকা তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। এ লক্ষ্যে একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে। গত মঙ্গলবার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ এ কমিটি গঠন করে। বুধবার এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন প্রতিষ্ঠানটির এক প্রশাসনিক কর্মকর্তা। স্কুলের ফেসবুক পেজেও এ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে।
আইএসপিআর :
অন্যদিকে নিহতের সংখ্যা নিয়ে গুজব সৃষ্টির প্রেক্ষাপটে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে আইএসপিআর। গতকাল আইএসপিআরের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হয়, সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক গুজব ছড়ানো হচ্ছে। অনেকেই না বুঝে এসব গুজবে বিশ্বাস করছেন। ঘটনার পরপরই কোনো পূর্ব নির্দেশনা ছাড়াই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ প্রচেষ্টার মাধ্যমে দ্রুত সাড়া দিয়েছে; যেমনটি সবসময় করে থাকে। আমাদের সন্তানদের বিষয়ে কোনো তথ্য গোপন করার ইচ্ছা বা প্রয়াস আমাদের নেই।
স্কুলের শিক্ষিকা পূর্ণিমা দাসের স্ট্যাটাস :
যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহতের সংখ্যা নিয়ে ভুল তথ্য না ছড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন স্কুলটির শিক্ষিকা পূর্ণিমা দাস। গতকাল বুধবার সকালে ফেসবুকে দেওয়া এক আবেগঘন পোস্টে পূর্ণিমা দাস এ অনুরোধ করেন। মাইলস্টোনের হায়দার আলী ভবনের এই শিক্ষিকা বিমান বিধ্বস্তের সময় নিজেও আগুনে আটকা পড়েছিলেন।
মাইলস্টোন কলেজের শিক্ষিকা পূর্ণিমা দাস লিখেছেন, ‘ভুল তথ্য ছড়াবেন না। মানুষের ইমোশন নিয়ে খেলবেন না।’ লাশ নিয়ে ফেসবুকে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হচ্ছে বলেও দাবি করেন এই শিক্ষিকা।
হতাহতের তথ্যগত পার্থক্যের কারণ :
দুর্ঘটনার দিন (সোমবার) থেকেই হতাহতের সংখ্যা নিয়ে আইএসপিআর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে দেওয়া তথ্যের পার্থক্য দেখা যায়। গত মঙ্গলবার স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা সরকার ফারহানা কবীর মাইলস্টোন ট্র্যাজেডিতে নিহত ২৮ এবং আহত ৬৮ জনের তথ্য জানান। আবার ওইদিনই দুপুরে জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়বিষয়ক বিশেষ সহকারী সায়েদুর রহমান ২৯ জনের মৃত্যুর তথ্য দেন।
তথ্যের গরমিল প্রসঙ্গে ফারহানা কবীর বলেন, উত্তরার লুবনা জেনারেল হাসপাতাল ও কার্ডিয়াক সেন্টারে মৃত দুজনের মধ্যে একজনকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল। তার নাম ওমাইয়ার নুর আশফিক। আরেকজনকে এখনও শনাক্ত করা হয়নি। এই স্থানান্তরের কারণে একজনের তথ্য দুবার যোগ হওয়ায় সংখ্যায় বিভ্রাট তৈরি হয়, যা পরে সংশোধন করা হয়েছে।
এদিকে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর-আইএসপিআর মঙ্গলবার বিকালে ৩১ জনের মৃত্যুর তথ্য দেয়। এই গরমিলের বিষয়ে সায়েদুর রহমান বলেন, সংখ্যাটায় খুব বেশি পীড়াপীড়ির কিছু নেই। বিভ্রান্তি দূর হতে আমাদের একটু সময় দেন। তিনি বলেন, লুবনা হাসপাতালের রেজিস্ট্রিতে কোথাও কোনো মৃত নেই। কিন্তু তারা মুখে বলছেন সেখানে দুজন শিশু ব্রট ডেড ছিল, যাদেরকে তাদের অভিভাবকরা নিয়ে এসেছেন। ওই দুজন আসলে পরবর্তীতে আমাদের কোনো হাসপাতালে আসেননি বিধায় ওই দুজনের রেকর্ড পাওয়া যাচ্ছে না।
সিএমএইচের একজন এবং উত্তরা আধুনিক হাসপাতালের একজন মৃত্যুর তথ্য নিয়েও পার্থক্য থাকার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, উত্তরা আধুনিকে, সেখান থেকে একজনকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সিএমএইচে। সেটি নিয়ে আইএসপিআরের সঙ্গে আমাদের তথ্যের পার্থক্য হয়েছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বিষয়ক বিশেষ সহকারী সায়েদুরের ভাষ্য, ‘তথ্যের পার্থক্যগুলো দূর হতে হয়তো একটু সময় লাগবে। যেহেতু মৃতদেহ এবং দেহাবশেষ নিয়ে আমাদের কিছু পার্থক্য আছে।’
আইএসপিআরের তথ্যে আহতের সংখ্যা ১৬৫ জন বলা হচ্ছে, সে বিষয়ে সায়েদুরের ভাষ্য, উত্তরা আধুনিকে ৬০ জন, লুবনাতে ১৩ জন ছিল তালিকায়। যাদের বেশিরভাগকে পরে অন্য হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। রেকর্ড কিপিং এবং মুভমেন্টের কারণে এই ‘ডুপ্লিকেশন’ হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
Sharing is caring!