প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২০শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৫ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৯শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

গুজবে ভয়াবহ বিপর্যয়ের শঙ্কা

editor
প্রকাশিত জুলাই ২৬, ২০২৫, ০৮:২৪ পূর্বাহ্ণ
গুজবে ভয়াবহ বিপর্যয়ের শঙ্কা

Manual7 Ad Code

 

ব্যাহত হচ্ছে মামলার তদন্ত কার্যক্রম

 

Manual1 Ad Code

গুজবের কারণে আসল ঘটনাও বিশ্বাস করছে না অনেকে

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

কিছুতেই রোধ করা যাচ্ছে না গুজব। কোনো ঘটনা ঘটলেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এমনও তথ্য শেয়ার বা ভিডিও আপলোড করছে তার বেশিরভাগ পুরনো বা অন্য দেশের ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা। যার লেশমাত্র সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে না। গুজবের কারণে মামলার তদন্তকাজও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তদন্ত করে প্রকৃত ঘটনা উদঘাটন করলেও অনেকেই তা বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না।

সম্প্রতি আলোচিত বেশিরভাগ ঘটনার ক্ষেত্রেই সবচেয়ে গুজব রটানো বেশি হচ্ছে। ২০১২ সালে চাঞ্চল্যকর সাগর-রুনি হত্যাকা- নিয়ে নানা ধরনের অপপ্রচার করায় এখনো এ ঘটনার আসল রহস্য উদঘাটনই করা যাচ্ছে না। বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনার বেলায়ও একই ধরনের অপকর্ম চালিয়েছে একটি বিশেষ চক্র। এ ছাড়া শেখ হাসিনার দেশে ফেরা নিয়েও ছড়ানো হচ্ছে গুজব।

সর্বশেষ উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হলে তুমুল অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এসব ঘটনার কারণে মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনাটি নিয়ে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। যদিও সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শীর্ষকর্তারা গুজবকে উড়িয়ে দিয়েছেন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নানা গুজব বেশি হচ্ছে বলে পুলিশ সদর দপ্তরের একটি গোপন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তাছাড়া ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর আগেও নানা ধরনের অপপ্রচার চালানো হয়েছে। তবে এসবের মাত্রা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এতে ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। প্রতিবেদনটি সরকারের হাইকমান্ডের কাছে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি গত বৃহস্পতিবার অপপ্রচারকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে ইউনিট প্রধান রেঞ্জ ডিআইজি ও জেলার পুলিশ সুপারদের বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।

Manual4 Ad Code

সংশ্লিষ্টরা জানায়, দেশ-বিদেশে গুজব রটনাকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুরুপের তাস বানিয়েছে। যে যার খুশি অনুযায়ী নানা তথ্য তৈরি করে ফেসবুকসহ নানা যোগাযোগে প্রচার করছে। দেশে কোনো ঘটনা ঘটলেই গুজবকারীদের তৎপরতা বেড়ে যাচ্ছে। গত ২১ জুলাই উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হলে নানা অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। লাশ কমানো, পাইলট মারা যায়নি, নাশকতা চালানো, পাইলটকে মোটা অঙ্কের অর্থ দিয়ে বিমান বিধ্বস্ত করানো, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে বোমা হামলাসহ একাধিক ঘটনা ঘটবে বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব রটানো হচ্ছে। আরেকটি চক্র অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে নানা বিষয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এসব গুজবকারীকে চিহ্নিত করতে পুলিশের সবকটি ইউনিট ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন মাঠে নেমেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা ধরনের অপপ্রচার চালানোর ঘটনা বেড়ে গেছে, তা সত্য। যারা এসব অপকর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের আইনের আওতায় আনতে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে কিছু গ্রুপকে আমরা শনাক্ত করেছি। দেশের বাইরে থেকেও নানা রকমের অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। অপপ্রচারকারীদের রুখতে পুলিশের সবকটি ইউনিট সক্রিয় আছে।

ইসলামের দৃষ্টিতে গুজব সামাজিক ব্যাধি ও কঠিন গুনাহ বলে মনে করেন উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টর জামে মসজিদের খতিব মো. লুৎফর রহমান। তিনি বলেন, ইসলামের দৃষ্টিতে গুজব একটা বড় ধরনের গুনাহ। মাইলস্টোনে ঘটনা নিয়ে যেসব অপপ্রচার হচ্ছে, তা সত্যি কষ্ট দিচ্ছে। এসব মিথ্যা অপবাদ বন্ধ না করলে যারা করছেন তাদের কবিরা গুনাহ হবে। গুজবের কারণে আসল ঘটনাও ভিন্ন খাতে চলে যাওয়ার শঙ্কা থাকে। আল্লাহ সবাইকে হেদায়েত দিক এ কামনা করছি।

আইনজীবীরা বলছেন, অপপ্রচার বন্ধ করতে দ্রুত কনটেইন সরাতে হবে। সরকার কঠোর না হলে বড় ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার শঙ্কা থেকেই যাবে।

মাইলস্টোনের দুর্ঘটনা নিয়ে বেশি অপবাদ : মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান দুর্ঘটনার পর ব্যাপক হারে গুজব ছড়ানোর প্রমাণ পেয়েছেন ফ্যাক্ট চেকাররা। অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির উদ্দেশ্যে, সবচেয়ে বেশি ভুয়া তথ্য ছড়ানো হয় মৃতের সংখ্যা নিয়ে। পুরনো ঘটনার ভিডিও ছড়িয়ে দাবি করা হয়, সেগুলো নতুন। এর প্রভাব কতটা; তার বড় উদাহরণ খোদ শিক্ষার্থীরা।

ফ্যাক্ট চেকাররা বলছেন, সবচেয়ে বেশি মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হয় মৃতের সংখ্যা নিয়ে। জামালপুরে চুরি যাওয়া কঙ্কাল ফের কবর দেওয়ার ভিডিও, মাইলস্টোনের শিক্ষার্থীর বলে অপপ্রচার চলে। এ ছাড়া ছড়ানো হয় বিমান বিধ্বস্তের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভিডিও আর ছবি। এখনো নানাভাবে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। বিশেষ করে লাশ গুম করা নিয়ে বেশি গুজব হচ্ছে।

শিক্ষার্থীদের উত্তেজিত করতে নানা কৌশল : শিক্ষার্থীদের উত্তেজিত করতে, দেশ এবং দেশের বাইরে থেকে নানা অপতথ্য ছড়ানো হয়। মঙ্গলবার মাইলস্টোন ক্যাম্পাসে অবরুদ্ধ দুই উপদেষ্টাকে উদ্ধারের সময় পুলিশের গুলিতে তিনজন নিহত হয় বলেও প্রচার করা হয়। ‘অ্যানোনিমাস মেইন পেজ’ নামে ফেসবুক পেজের একটি পোস্টও, যেখানে ‘দুর্ঘটনার ভবিষ্যদ্বাণী’ ছিল বলে বিভ্রান্তি ছড়ায় অনেকের মধ্যে। এ বিভ্রান্তিতে অনেকে ধোঁয়াশায় পড়েন, এটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র বা সুপরিকল্পিত হামলা কি না। সরকারি সংস্থা, গণমাধ্যম, স্বতন্ত্র, ফ্যাক্ট চেকাররা তথ্য যাচাই করে স্পষ্টভাবে জানাচ্ছেন, এসব প্রচার মূলত মিথ্যা, ভিত্তিহীন এবং উদ্দেশ্যমূলক। তবু এসব গুজব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অতি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি করছে এবং দুর্ঘটনাজনিত শোককে রাজনৈতিক বা ষড়যন্ত্রমূলক রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা দেখা যাচ্ছে।

Manual2 Ad Code

দুর্ঘটনার দিনই একটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়, যাতে দেখা যায় একটি যুদ্ধবিমান একটি বিল্ডিংয়ে বিধ্বস্ত হচ্ছে, সঙ্গে সঙ্গে আগুন ধরে যাচ্ছে এবং ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। ভিডিওর ক্যাপশনে দাবি করা হয় এই ভিডিওটি ২১ জুলাই মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার মুহূর্তের দৃশ্য। রিউমার স্ক্যানার টিম ভিডিওটির উৎস অনুসন্ধান করে জানতে পারে এটি কোনো সংবাদমাধ্যম, প্রত্যক্ষদর্শী, নিরাপত্তা ক্যামেরা বা মোবাইল ফোনে ধারণ করা বাস্তব ভিডিও নয়, বরং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) ব্যবহার করে তৈরি একটি ভুয়া ভিডিও।

দুর্ঘটনার দিনই ফেসবুকে আরেকটি পোস্ট ভাইরাল হয়, যেখানে একজন তরুণীর ছবি দিয়ে বলা হয়, তিনি একজন প্রশিক্ষিত পাইলট এবং এই বিমান বিধ্বস্তের ঘটনাকে ‘সুপরিকল্পিত একটি মিলিটারি-পি আর অপারেশন’ বলে উল্লেখ করেন। এটি নিছক দুর্ঘটনা নয়, বরং জনগণের মনোযোগ অন্যদিকে ঘোরানোর কৌশল। পরে ফ্যাক্টওয়াচ অনুসন্ধান করে জানতে পারে, এই তরুণীর নাম রোকেয়া দেশাই এবং তিনি একজন ভারতীয় নাগরিক। তিনি বাংলাদেশের এই বিমান দুর্ঘটনা সম্পর্কে কোথাও কোনো মন্তব্য করেননি। তার ছবি এবং পরিচয় ব্যবহার করে বাংলাদেশে গুজব ছড়ানো হয়েছে সম্পূর্ণ মিথ্যা দাবির ভিত্তিতে।

Manual7 Ad Code

বিশ্লেষকরা যা বললেন : ফ্যাক্ট চেকার এডিটর ইয়ামিন সাজিদ বলেন, সোশ্যাল মিডিয়ায় যেসব অপতথ্য ছড়ানো হয়েছে, তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকারক যেটা হয়েছে সেটা হচ্ছে লাশের সংখ্যা নিয়ে। চুরি হয়ে যাওয়া কঙ্কালকে দেখানো হয়েছে, দগ্ধ শিক্ষার্থীদের দেহাবশেষ লুকিয়ে কবর দেওয়া হচ্ছে। এটা পুরোটাই অপতথ্য।

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আশরাফুল আলম বলেন, ‘শাস্তি দৃশ্যমান হচ্ছে না বলেই এটা হচ্ছে। এটা করতে হবে। আইন সবসময় সচল। সরকারের এগুলো বন্ধ করার উপায় আছে, জনগণেরও উপায় আছে আইনের আশ্রয় নিয়ে এসব গুজব বন্ধ করার।’

আইএসপিআরও বলছে গুজব ছড়ানো হচ্ছে : মাইলস্টোনে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক গুজব ছড়ানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামি উদ দৌলা চৌধুরী। গত বুধবার সংবাদকর্মীদের কাছে পাঠানো এক বার্তায় এ তথ্য জানানো হয়।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামি উদ দৌলা চৌধুরী বলেন, সম্প্রতি লক্ষ করা যাচ্ছে, মাইলস্টোন মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক গুজব ছড়ানো হচ্ছে। অনেকেই না বুঝে এসব গুজবে বিশ্বাস করছেন। ঘটনার পরপরই কোনো পূর্ব নির্দেশনা ছাড়াই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ প্রচেষ্টার মাধ্যমে দ্রুত সাড়া দিয়েছে, যেমনটি সবসময় করে থাকে। আমাদের সন্তানদের বিষয়ে কোনো তথ্য গোপন করার ইচ্ছা বা প্রয়াস আমাদের নেই। আমি নিজে এবং আইএসপিআর টিম সরাসরি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলাম। আইএসপিআরের পরিচালক হিসেবে আমি স্পষ্টভাবে ঘোষণা করছি, যেকোনো গণমাধ্যম চাইলেই এ বিষয়ে তদন্ত করতে পারে, সেনাবাহিনীসহ যে কাউকে ইন্টারভিউ করতে পারে বা সংশ্লিষ্ট যেকোনো স্থান পরিদর্শন করতে পারে। আমরা সর্বোচ্চ সহায়তা দিতে প্রস্তুত আছি এবং আপনাদের যেকোনো প্রয়োজনে সর্বাত্মকভাবে সহযোগিতা করব।

কীভাবে গুজব ছড়ানো হচ্ছে : পুলিশের তথ্য বলছে, গুজব সাধারণত কিছু অযাচাইকৃত তথ্য বা গল্প, যা মৌখিক বা লিখিত যোগাযোগের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এ গল্পগুলো আংশিক সত্য বা মিথ্যা হতে পারে, তবে মানুষের কৌতূহলজনক তথ্য শেয়ার ও আলোচনা করার প্রবণতার কারণে এগুলো মানুষের কাছে অধিকমাত্রায় আকর্ষণীয় হয়। গুজব পরিচিতদের সম্পর্কে জাগতিক গসিপ থেকে শুরু করে স্বনামধন্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আরও গুরুতর অভিযোগ বা ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব পর্যন্ত হচ্ছে। গুজব প্রায়ই প্রোপাগান্ডা হিসেবে জনমতকে প্রভাবিত বা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য, একটি নির্দিষ্ট মতাদর্শের প্রচার করতে বা বিরুদ্ধ পক্ষের সুনামকে কলঙ্কিত করতে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এটি জনসাধারণের অনুভূতি এবং আচরণকে ম্যানিপুলেট করতে কৌশলগতভাবে অতিরঞ্জিত বা মিথ্যা তথ্য মিশিয়ে মানুষের ক্রিয়াকলাপকে কাজে লাগিয়ে তাদের এমন সিদ্ধান্ত নিতে পরিচালিত করে, যা তারা অন্যথায় নাও করতে পারে। যেকোনো সংকট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অর্থনৈতিক মন্দার সময় গুজব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক এবং উদ্বেগকে বাড়িয়ে জনসাধারণের মাঝে অস্থিরতা সৃষ্টিতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে।

কয়েকটি ঘটনা নিয়ে গুজব : বাংলাদেশসহ পার্শ্ববর্তী একটি দেশে জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে ফেসবুকে গুজব সৃষ্টির মাধ্যমে অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করা হয়। পদ্মা সেতু নির্মাণে শিশুদের মাথা লাগবে এমন গুজব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিলে সারা দেশে ছেলেধরা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। রাজধানীর বাড্ডায় তসলিমা রেনু নামে এক নারীকে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পরে জানা যায় সন্তানের স্কুল ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যের খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন তিনি। এ ছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে গুজব ছড়িয়ে পড়লে লবণের দামেও অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ও মানুষের প্রয়োজনের অধিক পরিমাণে লবণ কেনার হিড়িক পড়ে যায়। করোনা মহামারী ও ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দাকে পুঁজি করে একটি গুজব ছড়িয়ে পড়লে অনেক গ্রাহক আতঙ্কিত হয়ে তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে জমানো টাকা তুলে ফেলেন। পরে এ তথ্যটি মিথ্যা প্রমাণিত হলে গ্রাহকরা তাদের ভুল বুঝতে পারেন।

গুজব ছড়ানোর কৌশল : সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চিত্রকর্ম, কার্টুন, পোস্টার, পুস্তিকা, চলচ্চিত্র, রেডিও, টিভি, ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ সাইবার স্পেসে বিভিন্নভাবে গুজব ছড়ানো হয়ে থাকে। বর্তমানে সাধারণত ছবি এডিট করে অহরহ গুজব ছড়ানো হয়ে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে আসল ছবিতে ভিন্ন স্থান ও সময় যুক্ত করে ছবির প্রেক্ষাপট বদলে ফেলা হয়। জনগণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় এমন বিষয়বস্তু নিয়ে মিথ্যা ও চটকদার ভিডিও তৈরি করে গুজব ছড়ানো হয়। এ ছাড়া পুরনো ভিডিওতে বর্তমান সময়ের কথা ব্যবহার করে নতুন ঘটনার জন্ম দেওয়া এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ব্যবহার করে একজনের চেহারায় তার আর্টিফিশিয়াল ভয়েস যুক্ত করে ডিপ ফেইক প্রযুক্তির মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুন একটি ভুয়া ভিডিও তৈরি করে গুজব ছড়ানো হয়। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এড়িয়ে সংবাদের প্রসঙ্গ বদলে ফেলে বানোয়াট তথ্যকে সত্য বলে প্রচারের মাধ্যমেও গুজব ছড়িয়ে থাকে। বিভিন্ন সময় স্বনামধন্য বিশেষজ্ঞের বক্তব্যের ভুল বা বিকৃত অনুবাদ ও মতামত উপস্থাপনের মাধ্যমে গুজব ছড়ানো হয়ে থাকে। মূলধারার গণমাধ্যম থেকে কাল্পনিক উদ্ধৃতি, সত্য খবর পাল্টে ফেলা, অখ্যাত গণমাধ্যম বা ব্লগের খবর ব্যবহার করে কোনো গবেষণার ফলাফলের ভুল ব্যাখ্যা ও অকার্যকর তুলনার মাধ্যমেও গুজব ছড়ানো হয়ে থাকে।

প্রতিরোধ করতে না পারলে বিপর্যয়ের শঙ্কা : দিনে দিনে গুজব বেড়েই চলছে। দেশ-বিদেশ থেকেই এসব অপপ্রচার হচ্ছে বলে পুলিশের একটি গোপন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যারা এসব গুজবে সম্পৃক্ত আছে তাদের খুঁজে বের করতে না পারলে বড় ধরনের ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা আছে। বাংলাদেশের মানুষ খুব আবেগপ্রবণ। তারা সহজেই সবকিছু বিশ্বাস করে। এ প্রসঙ্গে পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরের বলেন, গত বৃহস্পতিবার পুলিশের সবকটি ইউনিট প্রধান, রেঞ্জ ডিআইজি ও জেলার পুলিশ সুপারদের কাছে গুজব প্রতিরোধের বিষয়ে একটি নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। তাছাড়া আমরা বিটিআরসির সঙ্গেও কথা বলেছি। গুজব প্রতিরোধ করতে না পারলে বড় ধরনের বিপদ ঘটার সম্ভাবনা আছে। বিষয়টি সরকারকে অবহিত করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, গুজবের কারণে অনেক মামলার তদন্ত সঠিকভাবে করা সম্ভব হচ্ছে না। ব্যক্তিজীবনে একজন ব্যক্তির চরিত্র ও কাজ সম্পর্কে মিথ্যা গুজব তাদের সুনামকে কলঙ্কিত করতে পারে, যা তাদের জন্য দীর্ঘস্থায়ী মানসিক কষ্টের কারণ হতে পারে। একটি মিথ্যা গুজব পারস্পরিক ব্যক্তি পর্যায়ের সম্পর্ককে নষ্ট করে। একটি পরিবারের মধ্যে গুজব ছড়ানোর ফলে সম্পর্কে টানাপড়েন, পারিবারিক কলহ এবং মানসিক অশান্তি হতে পারে। সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি, গোষ্ঠী ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে গুজব ছড়ানো হলে তা সামাজিক সম্প্রীতি এবং সংহতি ব্যাহত করতে পারে। বিশেষ করে রাজনীতি বা ধর্মের মতো সংবেদনশীল বিষয়গুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত গুজব সমাজকে মেরূকরণের দিকে নিয়ে যেতে পারে, যা অনেক সময় সামাজিক নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করে। একটি নির্দিষ্ট শ্রেণি বা গোষ্ঠী সম্পর্কে মিথ্যা গুজব তাদের বৈষম্য, বর্বরতা এমনকি সহিংসতার দিকে নিয়ে যেতে পারে।

গুজব প্রতিরোধের উপায় : র‌্যাবের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বায়নের এ যুগে সোশ্যাল মিডিয়া এবং অন্যান্য অনলাইন প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে গুজব বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। গুজবের ক্ষতিকারক প্রভাব মোকাবিলার জন্য নিজেকে সচেতন হতে হবে এবং অন্যকেও সচেতন করতে হবে। জনসাধারণকে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য এবং গুজবের মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ে সাহায্য করতে মিডিয়া লিটারেসি শিক্ষাদানে স্কুল-কলেজ এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলো এমন প্রোগ্রাম গ্রহণ করতে পারে, যা তাদের সমালোচনামূলক চিন্তার দক্ষতা এবং ফ্যাক্ট চেকিংয়ের কৌশল শেখাবে। দেশপ্রেম, ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার আলোকে সোশ্যাল মিডিয়ার দায়িত্বশীল ব্যবহার এ প্ল্যাটফর্মগুলোর মাধ্যমে মিথ্যা তথ্যের বিস্তাররোধে সহায়তা করতে পারে। এ ছাড়া গঠনমূলক ও উন্মুক্ত আলোচনাকে উৎসাহিতকরণ গুজবের বিস্তার কমাতে সাহায্য করতে পারে। গুজব প্রতিরোধে গণমাধ্যমকে কোনো সংবাদ প্রচার বা প্রকাশের আগে তার সত্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে দায়িত্বশীলভাবে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করা উচিত।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code