প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৫ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৩০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৪শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

জাতীয় সনদে থাকবে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রায় অর্ধশত ইস্যু

editor
প্রকাশিত জুলাই ২৬, ২০২৫, ০৯:০৩ পূর্বাহ্ণ
জাতীয় সনদে থাকবে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রায় অর্ধশত ইস্যু

Manual3 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

রাষ্ট্র সংস্কারের ইস্যুগুলোতে রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গত ১২ ফেব্রুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় সাত সদস্যের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। বিগত সাত মাসে সংস্কারের ইস্যুগুলো নিয়ে এই কমিশন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশনের দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। গত ৩ জুন থেকে চলছে ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্যায়ের বৈঠক। গত ২৩ জুলাই পর্যন্ত দুই দফায় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মোট ৯৫টি ইস্যুতে কমিশন আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেছে ৬৩টি। এ পর্যায়ে আলোচনায় দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হওয়া রাষ্ট্র সংস্কারের প্রায় অর্ধশত ইস্যু নিয়ে জাতীয় সনদ বা জুলাই সনদের পাণ্ডুলিপি তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছে কমিশন।

কমিশন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দুই দফা আলোচনায় এ পর্যন্ত রাষ্ট্র সংস্কারের মোট ৪৩টি মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে দলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এসবের মধ্যে প্রথম দফা বৈঠকে দলগুলোর মধ্যে ঐক্য হয় ৩৩টি ইস্যুতে। আর দ্বিতীয় দফায় অনুষ্ঠিত কমিশনের ১৮টি বৈঠকে এ পর্যন্ত ১০ মৌলিক ইস্যুতে দলগুলো একমত হয়েছে।

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দায়িত্ব গ্রহণের পর ঐকমত্য কমিশন প্রথম দফায় ১৯ মে পর্যন্ত ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ৪৫টি বৈঠক করে। এসব বৈঠকে সংস্কার কমিশনগুলোর প্রস্তাব থেকে বাছাই করা গুরুত্বপূর্ণ ৭৮টি ইস্যুতে দলগুলোর মধ্যে আলোচনা হয়। এসব বৈঠকে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা হবে ‘বাংলা’, বাংলাদেশের নাগরিকরা বাংলাদেশি হিসেবে পরিচিত হবেন, সংবিধানবিষয়ক অপরাধ ও সংবিধান সংশোধনের সীমাবদ্ধতাবিষয়ক অনুচ্ছেদ ৭ক এবং ৭খ বিলুপ্ত করা, সংবিধানে যুক্ত হবে- বাংলাদেশ একটি বহু-জাতি, বহু-ধর্মী, বহু-ভাষী ও বহু সংস্কৃতির দেশ; যেখানে সকল সম্প্রদায়ের মানুষের সহাবস্থান ও যথাযথ মর্যাদা নিশ্চিত করা হবে, সংবিধানের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগে বর্ণিত মৌলিক অধিকারসমূহের তালিকা সংশোধন ও নাগরিকদের অধিকার সম্প্রসারণ করাসহ ৩৩টি বিষয়ে দলগুলো একাত্মতা প্রকাশ করে।

Manual7 Ad Code

আলোচনায় প্রথম দফায় অমীমাংসিত কিছু মৌলিক ইস্যুতে জুন মাসে ২৮টি দল ও দুটি জোটের প্রতিনিধিদের নিয়ে দ্বিতীয় দফা বৈঠক আয়োজন করে ঐকমত্য কমিশন। এ দফায় গত ২৩ জুলাই পর্যন্ত দলগুলো ১০টি ইস্যুতে একমত হতে পেরেছে। সেগুলো হলো- সংবিধান সংশোধন, সংবিধানের ৭০ নং অনুচ্ছেদ সংশোধন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নির্ধারণ, নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সম্পর্কিত বিধান, বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ-প্রক্রিয়া, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে না থাকার বিধান, নির্বাচন কমিশন গঠন-প্রক্রিয়া ও জরুরি অবস্থা ঘোষণা।

Manual6 Ad Code

এ ছাড়া পূর্বনির্ধারিত আরও দুটি বিষয় (নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ সম্পর্কিত প্রস্তাব এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব) এখনো আলোচনার জন্য উত্থাপন করতে পারেনি কমিশন।

অন্যদিকে কমিশন বৈঠকে বারবার আলোচনার পরও দলগুলোর মধ্যে এখনো মতানৈক্য রয়েছে সাত মৌলিক ইস্যুতে। সেগুলো হলো- তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা, রাষ্ট্রের মূলনীতি পুনর্বিন্যাস, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট (উচ্চকক্ষের গঠন, সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি), রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল নির্দিষ্টকরণ, সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটি এবং সংসদে নারী আসন নির্ধারণ।

Manual3 Ad Code

এসব ইস্যু এখনো সুরাহা না হওয়ার জন্য দলগুলো পরস্পরকে দায়ী করছে; যা শুধু আলোচনার প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করছে বলে অভিযোগ অনেকের।

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হলে রাষ্ট্রব্যবস্থার মৌলিক খাতগুলোতে সংস্কারের দাবি ওঠে। অক্টোবরে রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে সরকার প্রথমে ছয়টি এবং পরে আরও পাঁচটিসহ মোট ১১টি বিষয়ে কমিশন গঠন করা হয়।

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় সাত সদস্যের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সহসভাপতির দায়িত্ব পান সংবিধান সংস্কার কমিশনপ্রধান অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ।

কমিশনের অন্য সদস্যরা হলেন জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরী, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের সদস্য বিচারপতি এমদাদুল হক, দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান ও পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন। এই কমিশনের দায়িত্ব হলো- রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার প্রস্তাবগুলোর বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো এবং একটি ‘জাতীয় সনদ’ প্রণয়ন করা।

১৫ ফেব্রুয়ারি কার্যক্রম শুরু করে ছয় মাসের জন্য দায়িত্ব নেয় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। প্রাথমিক পর্যায়ে গঠিত ছয় সংস্কার কমিশনের মধ্যে পুলিশ সংস্কার কমিশন ছাড়া বাকি পাঁচটি কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনের ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি ইস্যুতে মতামত চেয়ে ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে সুপারিশ আকারে পাঠানো হয়। লক্ষ্য, সংস্কার প্রস্তাবগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা। এরপর ৩৩টি দল ও জোট কমিশনকে তাদের লিখিত মত জানায়। গত ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত এসব দল ও জোটের সঙ্গে কমিশন ৪৫টি বৈঠক করে।

Manual5 Ad Code

আলোচনার সুবিধার্থে ও ঐক্য প্রতিষ্ঠায় কয়েকটি দলের সঙ্গে একাধিক দিনও বৈঠক করে কমিশন। তার পরও সাংবিধানিক অনেক মৌলিক ইস্যুতে দলগুলোর মধ্যে রয়ে যায় মতানৈক্য। এরপর অমীমাংসিত গুরুত্বপূর্ণ ১৯টি ইস্যুতে ঐক্য গড়ার লক্ষ্যে দ্বিতীয় দফায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে বৈঠকের উদ্যোগ নেওয়া হয়। গত ২ জুন দ্বিতীয় ধাপের বৈঠক উদ্বোধন করেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের চেয়ারম্যান প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এরপর গত ৩ জুন থেকে এ পর্যন্ত ১৮টি বৈঠকে ১০টি মৌলিক ইস্যুতে ঐক্য গড়া সম্ভব হলেও এখনো সাতটি বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য বিরাজ করছে। এ ছাড়া আলোচনার টেবিলে উঠতে পারেনি আরও দুটি ইস্যু।

রাষ্ট্র সংস্কারের ইস্যুগুলোতে আলোচনার অগ্রগতি সম্পর্কে ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ জানান, গত মার্চ মাস থেকে রাষ্ট্র সংস্কারের ইস্যুগুলোতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। দ্বিতীয় দফায় অমীমাংসিত ইস্যুগুলোকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে কমিশন দফায় দফায় বৈঠক করেছে। এ ছাড়া গত সাত মাসে দুই দফায় প্রায় ১০০ ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশন ৬৩টি আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেছে। এ পর্যন্ত সব মিলিয়ে ৪৩টি ইস্যুতে দলগুলো একমত হয়েছে। আগামী কয়েক দিনে আরও তিন থেকে পাঁচটি ইস্যুতে ঐক্যের সম্ভাবনা রয়েছে। কমিশনের আশা, সব মিলিয়ে প্রায় অর্ধশত বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।

জাতীয় সনদ প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চাইলে অধ্যাপক রীয়াজ বলেন, ‘সনদ তৈরির জন্য আমাদের প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে। আগামী ৩১ জুলাই শেষ হবে আমন্ত্রিত ৩০টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে আমাদের দ্বিতীয় দফা বৈঠক। লক্ষ্য, এর মধ্যেই আলোচনা শেষ করে জাতীয় সনদের পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা (পাণ্ডুলিপি) চূড়ান্ত করা। এরপর সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষরের জন্য হয়তো আরও দু-তিন দিন লাগতে পারে।

রাষ্ট্র সংস্কারের কতটি ইস্যু জাতীয় সনদে যুক্ত করা হবে- এমন প্রশ্নে অধ্যাপক রিয়াজ জানান, দুই দফা বৈঠকে রাষ্ট্র সংস্কারের যতটি ইস্যুতে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হবে, সেসব বিষয়ই জাতীয় সনদের পাণ্ডুলিপিতে যুক্ত করা হবে।

সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, জাতীয় কমিশনের কার্যকালের মেয়াদ শেষ হবে আগামী ১৫ আগস্ট।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual4 Ad Code