প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৫ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৩০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৪শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

টানাপড়েনের মধ্যেই চূড়ান্ত হচ্ছে সনদ

editor
প্রকাশিত জুলাই ২৯, ২০২৫, ০১:০৮ অপরাহ্ণ
টানাপড়েনের মধ্যেই চূড়ান্ত হচ্ছে সনদ

Manual1 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট ও ঘোষণার পাশাপাশি সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ যেসব সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলো ইতিমধ্যে ঐকমত্যে পৌঁছেছে, সেগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করেই ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’-এর খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। সনদে উল্লিখিত প্রস্তাব বা সুপারিশ নির্বাচিত সরকার দুই বছরের মধ্যে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করাসহ ৭ দফা অঙ্গীকার করে এই সনদে স্বাক্ষর করবে রাজনৈতিক দলগুলো। ইতিমধ্যে এ-সংক্রান্ত একটি খসড়া প্রণয়ন করে তা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছে। ৩০ জুলাই দুপুর ১২টার মধ্যে খসড়ার বিষয়ে মতামত প্রদানের জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে দলগুলোকে অনুরোধ জানানো হয়েছে বলে কমিশন সূত্রে জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জুলাই সনদের খসড়ার ব্যাপারে ২ দিনের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের চূড়ান্ত মতামত দেবে। সেটা বিবেচনায় নিয়ে ৫ আগস্টের আগেই সনদ চূড়ান্ত করা হবে। রাজনৈতিকগুলোর নেতৃবৃন্দের স্বাক্ষরসহ জুলাই সনদ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। চলতি মাসেই জুলাই সনদে স্বাক্ষর করা সম্ভব হবে বলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন আশা করছে। দ্বিতীয় দফা সংলাপের পরও যেসব বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি, সেসব বিষয়ে কমিশন সিদ্ধান্ত জানাবে। ওইসব বিষয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ (আপত্তি) দিয়ে সনদে স্বাক্ষর করতে পারবে দলগুলো।

কী আছে খসড়া সনদে :
খসড়ায় জাতীয় সনদের শিরোনাম রাখা হয়েছে, ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’। সনদের সূচনা বক্তব্যে লেখা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত সফল ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র পুনর্গঠনের এক ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই মাহেন্দ্রক্ষণে আমরা নিম্নস্বাক্ষরকারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, জোট ও শক্তিগুলোর প্রতিনিধিরা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে রাষ্ট্রের সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন ও দুর্নীতি দমন কমিশন বিষয়ে সংস্কারের লক্ষ্যে নিম্নলিখিত বিষয়ে ঐকমত্যে উপনীত হয়েছি।’

সনদের প্রথম দফায় পটভূমিতে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের নীতিকে ধারণ করে সংগঠিত মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো গঠনের আকাক্সক্ষা বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে তৈরি হয়েছিল দীর্ঘ ৫৩ বছরেও তা অর্জন করা যায়নি। কারণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ও সংস্কৃতি বিকাশের ধারা বারবার হোঁচট খেয়েছে। বস্তুতপক্ষে, বিগত ৫ দশকে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে একদিকে টেকসই ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। অপরদিকে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো নামেমাত্র থাকলেও তা অত্যন্ত দুর্বলভাবে কাজ করেছে। বস্তুত রাষ্ট্রকাঠামোতে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের সুরক্ষা নিশ্চিতের লক্ষ্যে দলীয় প্রভাবের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর ও বিচারহীনতার সহায়ক হিসেবে পরিচালনা করা হয়েছে।

Manual3 Ad Code

২০০৯ সালে একটি দলীয় সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে ক্রমান্বয়ে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে জলাঞ্জলি দিয়ে অগণতান্ত্রিক চরিত্র ধারণ করতে থাকে। তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সমালোচকদের মানবাধিকার হরণ, গুম, খুন, নিপীড়ন-নির্যাতন, মামলা ও হামলার মাধ্যমে একটি নৈরাজ্যকর ও বিভীষিকাময় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। সমগ্র রাষ্ট্রযন্ত্রকে স্বৈরতান্ত্রিকভাবে ব্যক্তি ও গোষ্ঠী বন্দনার জন্য নিবেদিত রাখা হয়। দেড় দশকে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকার জনস্বার্থের বিরুদ্ধে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করার উদ্দেশ্যে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সংবিধানের বিকৃতি সাধন, বিভিন্ন নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন, নির্বাচনি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা, বিচার বিভাগ ও জনপ্রশাসনকে দলীয়করণ এবং দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুটপাট করে। এই পটভূমিকায় ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বিপুল ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণের ফলে এক অভূতপূর্ব সফল গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এতে শাসকগোষ্ঠীর প্রতিহিংসার শিকার হয়ে শিশু ও নারীসহ এক হাজার চারশর বেশি নিরস্ত্র নাগরিক নিহত এবং ২০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়। তাদের আত্মাহুতি ও ত্যাগের বিনিময়ে এবং জনগণের সম্মিলিত শক্তি ও প্রতিরোধের কাছে স্বৈরাচারী শাসক ও তার দোসররা পরাজিত হয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এমতাবস্থায়, জনগণের মননে রাষ্ট্রকাঠামো পুনর্গঠনের একটি প্রবল অভিপ্রায় সৃষ্টি হয়েছে। রাষ্ট্র সংস্কার বিশেষ করে সংবিধানের মৌলিক সংস্কার, নির্বাচনি ব্যবস্থার পুনর্গঠন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুশীলন, স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা এবং সুশাসিত জবাবদিহিমূলক ও দুর্নীতিমুক্ত সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, যার সদ্ব্যবহার করা আমাদের সবার পবিত্র দায়িত্ব।

Manual8 Ad Code

সনদের অঙ্গীকারনামায় বলা হয়েছে-(১) হাজারো মানুষের জীবন ও রক্ত এবং অগণিত মানুষের সীমাহীন ক্ষয়ক্ষতি ও ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত সুযোগ এবং তৎপ্রেক্ষিতে জনআকাক্সক্ষার প্রতিফলন হিসেবে দীর্ঘ ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রণীত ও ঐকমত্যের ভিত্তিতে গৃহীত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ এর পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করব।

Manual4 Ad Code

(২) সনদে দেশের শাসনব্যবস্থা তথা সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশিব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন ব্যবস্থার বিষয়ে যেসব প্রস্তাব বা সুপারিশ এই সনদে লিপিবদ্ধ রয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন, লিখন ও পুনর্লিখন এবং বিদ্যমান আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, পরিবর্তন, পরিমার্জন, লিখন, পুনর্লিখন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।

Manual1 Ad Code

(৩) সনদে দেশের শাসনব্যবস্থার বিষয়ে যেসব প্রস্তাব বা সুপারিশ এই সনদে লিপিবদ্ধ রয়েছে সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংশোধন, সংযোজন, পরিমার্জন, লিখন ও পুনর্লিখন এবং বিদ্যমান আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধন, পরিবর্তন, পরিমার্জন, লিখন, পুনর্লিখন বা নতুন আইন প্রণয়ন, প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন বা বিদ্যমান বিধি ও প্রবিধির পরিবর্তন বা সংশোধন এই সনদ গৃহীত হওয়ার পরে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের দুই বছরের মধ্যে সম্পন্ন করতে এবং এসব সংস্কার টেকসই করতে অঙ্গীকার করছি।

(৪) এই সনদ গৃহীত হওয়ার পর এতে যেসব প্রস্তাব বা সুপারিশ লিপিবদ্ধ রয়েছে, সেগুলো পরবর্তী দুই বছর মেয়াদকালের মধ্যে বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি। সনদ বাস্তবায়নের প্রতিটি ধাপে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষার পূর্ণ নিশ্চয়তা বিধান করব। (৬) সনদ বাস্তবায়নে এবং এর আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা প্রদানে আমরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। (৭) ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক তাৎপর্যকে সংবিধানে যথাযোগ্য স্বীকৃতি দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকব।

সনদের দ্বিতীয় দফায় সংস্কার কমিশন গঠন, তৃতীয় দফায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন ও চতুর্থ দফায় ঐকমত্য কমিশনের কার্যক্রম তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, গত ১২ ফেব্রুয়ারি ৬ মাস মেয়াদে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু করে। সংবিধান সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন ও দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের ছাপানো কপি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হয়। এরপর পুলিশ সংস্কার কমিশন ব্যতীত অপর ৫টি কমিশনের প্রতিবেদনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশ স্প্রেডশিট আকারে দল ও জোটের কাছে মতামতের জন্য পাঠানো হয়। এ বিষয়ে ৩৫টি দল ও জোট তাদের মতামত কমিশনের কাছে পাঠায়। প্রথম পর্যায়ে ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত ৩২টি দল ও জোটের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের ৪৪টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এরপর কমিশন অগ্রাধিকার ও গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় মোট ২০টি বিষয় নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফা আলোচনায় মিলিত হয়। এই প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে নিম্নলিখিত ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ রচিত হয়।

খসড়ায় বলা হয়েছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের উদ্যোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটের পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে, আমরা অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল ও জোটের প্রতিনিধিরা স্ব স্ব দলের পক্ষ থেকে বিদ্যমান শাসনব্যবস্থা তথা সংবিধান, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচনব্যবস্থা, জনপ্রশাসন, পুলিশি ব্যবস্থা ও দুর্নীতি দমন বিষয়ে নিম্নোল্লিখিত কাঠামোগত, আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তনের ব্যাপারে ঐকমত্যে উপনীত হয়েছি এবং এসব বিষয়কে একটি জাতীয় সনদে সন্নিবেশিত করতে সম্মত হয়েছি। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানের বীর শহিদ ও আহতদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ এবং ওই গণঅভ্যুত্থানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণকারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতার স্মারক হিসেবে আমরা এই সনদকে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ হিসেবে ঘোষণা করছি।

সনদের পঞ্চম দফায় ঐকমত্যে উপনীত হওয়ার বিষয়গুলো উল্লেখ করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আলোচনা চলমান থাকায় এখনও খসড়ায় তা উল্লেখ করা হয়নি। তবে এ পর্যন্ত ১২টি বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে বলে কমিশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। সেগুলো হচ্ছেÑতত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা চালু, কোনো ব্যক্তির প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল সর্বোচ্চ ১০ বছর, নির্বাচন কমিশন গঠনে বাছাই কমিটি গঠন, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন, স্বাধীন পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন, জরুরি অবস্থা ঘোষণা-সংক্রান্ত সংবিধানের বিদ্যমান অনুচ্ছেদ পরিবর্তন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতির নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কার, প্রধান বিচারপতির নিয়োগ প্রক্রিয়া নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমা প্রদানের জন্য আইন সংশোধন, নির্বাচনি এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণে কমিটি গঠন, বিভাগীয় পর্যায়ে হাইকোর্ট বেঞ্চ স্থাপন এবং উপজেলা পর্যায়ে অধস্তন আদালত গঠন।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই সনদে নাম ও পদবি উল্লেখ করে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিরা স্বাক্ষর করবেন। এরপর ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা এবং সর্বশেষ ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি ও প্রধান উপদেষ্টা স্বাক্ষর করবেন। জুলাই সনদ আমাদের আগামীর পথরেখা তৈরি করবে আশা প্রকাশ করে ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, জুলাই সনদকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে তৈরি করতে চায় কমিশন। এর মাধ্যমে একটি সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে পৌঁছা সম্ভব হবে। মৌলিক সংস্কারের ২০টি বিষয়ের মধ্যে ইতিমধ্যে ১২টিতে একমত হয়েছে দলগুলো। আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে এ নিয়ে একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হবে।

বিএনপির ওয়াকআউট : এদিকে রাষ্ট্রের সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি), মহাহিসাব রক্ষকের কার্যালয় এবং ন্যায়পাল নিয়োগের জন্য পৃথক ও স্বচ্ছ নিয়োগ কমিটি গঠনের প্রস্তাব নিয়ে সোমবার ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে দীর্ঘ আলোচনা হলেও একমত হতে পারেনি রাজনৈতিক দলগুলো। পূর্বের আপত্তি সত্ত্বেও এই ইস্যুতে আলোচনা শুরু হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক থেকে ওয়াকআউট করে বিএনপি। অবশ্য পরে আলোচনায় যোগ দেন বিএনপির প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপের ২০তম দিনের আলোচনা শুরু হয়। বেলা সাড়ে ১১টার দিকে সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের বিষয়ে আলোচনার প্রস্তাব উপস্থাপন করেন কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ। সে সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ জানান তাদের দল এ আলোচনায় অংশ নেবে না। আমরা কিছু সময়ের জন্য ওয়াকআউট করলাম। কারণ আমাদের বক্তব্য পরিষ্কার ছিল নির্বাচন কমিশন ছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ কমিটি করা এবং সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করলে রাষ্ট্র ও সরকার পরিচালনায় জটিলতা তৈরি হবে।

জাতির স্বার্থে বিএনপিকে এ আলোচনায় অংশ নেওয়ার অনুরোধ করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, একটি বড় দল আলোচনায় অংশ না নিলে ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব না। আলোচনায় অগ্রসর হওয়া সম্ভব না। পরে আলী রীয়াজ বলেন, বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে তারা আলোচনায় অনুপস্থিত থাকবে না। একটি রাজনৈতিক দল আলোচনায় অংশ না নিলে আলোচনা করা যাবে না, আমরা সেই সিদ্ধান্ত দিতে পারি না।

পরে সংলাপের সঞ্চালক প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার বলেন, এর আগে এক বা একাধিক দল নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে ঐকমত্য হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে সেটা হতে পারে। পরে আলোচনা শুরু হয়। দুপুর ১টায় বৈঠকে যোগ দেন স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিউল্লাহ। তবে এই ইস্যুতে সারা দিন আলোচনা হলেও একমত হতে পারেনি দলগুলো।

কী বলছে দলগুলো : ওয়াকআউটের বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, দেশে যেন আর কখনো স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদ না জন্ম নিতে পারে, সে লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগে বিএনপি সর্বোচ্চ সহযোগিতা করে যাচ্ছে। তবে নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা খর্ব করা হলে রাষ্ট্র পরিচালনায় ভারসাম্য নষ্ট হবে। তাই আমাদের পক্ষ থেকেই প্রস্তাব ছিল, কেউ যেন ১০ বছরের বেশি প্রধানমন্ত্রী থাকতে না পারেন, সেটি গৃহীত হয়েছে। আমরা আরও প্রস্তাব দিয়েছি, নির্বাচন কমিশন গঠনে একটি স্বাধীন সার্চ কমিটি গঠন করা হোক যেখানে সরকারি দল, বিরোধী দল এবং বিচার বিভাগের প্রতিনিধি থাকবে। সেটিও গ্রহণযোগ্য হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমরাই প্রস্তাব করেছি যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলে, পরবর্তীকালে সংসদ কোনো সংশোধনী আনলে তা রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের আগে গণভোটে যেতে হবে। এটি গৃহীত হওয়া মানে দেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় পদক্ষেপ।

নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি বলেন, নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি যেমন সংসদের কাছে, তেমনি জনগণের কাছেও রয়েছে। কিন্তু যদি কর্তৃত্ব না থাকে, কেবল দায়িত্ব আর জবাবদিহি থাকে, তা হলে তা কার্যকর রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যথেষ্ট নয়। সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়োগে নির্বাহী বিভাগের হাত-পা বাঁধা হলে তা ভবিষ্যতের জন্য বাধা সৃষ্টি করতে পারে। জনগণের প্রত্যাশা পূরণে নির্বাহী বিভাগকে শক্তিশালী হতে হবে, দুর্বল নয়। তিনি বলেন, সব বিষয়ে ঐকমত্য হবে এমন দাবি কেউ করেনি। দ্বিমত থাকবে, ভিন্নমত থাকবে, আর সেগুলোর মধ্য দিয়েই তো গণতন্ত্রের সংগ্রাম এগিয়ে যায়। আমরা মনে করি না, যে নোট অব ডিসেন্ট দিয়ে কাউকে ঐকমত্যে বাধ্য করা উচিত। ঐকমত্যের অর্থই হচ্ছে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে পথচলা। বিএনপি অংশ না নিলে কীভাবে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে, সেটি নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়।

জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, পিএসসি, দুদক, মহাহিসাব নিয়ন্ত্রক ও ন্যায়পাল নিয়োগ সাংবিধানিকভাবে হওয়ার পক্ষে জামায়াত। আর বিএনপিসহ কয়েকটি দল চায় নির্বাহী বিভাগ এ নিয়োগ দেবে। তাদের আশঙ্কা এতে নির্বাহী বিভাগ দুর্বল হয়ে যেতে পারে। আমরা মনে করি, এ কথা সঠিক নয়। বরং এর মাধ্যমে যোগ্য ও দক্ষ লোক নিয়োগ পাবে। তিনি বলেন, এ ধরনের বৈঠক থেকে ওয়াকআউটের কোনো সুযোগ আছে কি না, তা আমাদের জানা নেই। আমরা বলেছি, পিএসসি সাংবিধানিক হতে হবে। তারা কেন বিরোধিতা করছেন, তার মানে তারা দলীয়করণ করতে চান। এ নিয়ে দেশের জন্য ভালো হলে আর কোনো দলের সমস্যা হলে, তা জাতি মানবে না। সচিবালয়ে সারা জনম প্রেতাত্মা থাকবে, তা হবে না। আমরা প্রেতাত্মাবিহীন সচিবালয় চাই।

এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে দলনিরপেক্ষ নিয়োগের বিষয়টি বিএনপি না মানার কারণ বোধগম্য নয়। দলটি যেহেতু নির্বাচন কমিশন গঠনের প্রক্রিয়ায় একমত, তাই অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোও সাংবিধানিকভাবে নিয়োগ হওয়ার বিষয়ে একমত হওয়া উচিত। তিনি বলেন, আমরা নির্বাহী বিভাগে হস্তক্ষেপের কথা বলছি না। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরপেক্ষ রাখার কথা বলেছি। সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান স্বায়ত্তশাসিত পরিচালিত হতে হবে। সেখানে নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ থাকা উচিত না। কেন যেন বিষয়গুলো বিএনপি বুঝতে চায় না। দলীয় নিয়োগের কারণে আমাদের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো নিজস্বতা ঠিক রাখতে পারছে না। সেখানে নানা সীমাবদ্ধতা তৈরি হয়। তিনি আরও বলেন, গত দেড় দশকে নির্বাচন একতরফা হওয়ার কারণে বিএনপি ক্ষমতায় যেতে পারেনি। এ কারণে শুধু নির্বাচন কমিশনের দল নিরপেক্ষতার ব্যাপারেই তারা একমত হবে। আর বাকি যে বডিগুলো আছে, (সরকারি কর্ম কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক বা ন্যায়পাল) সেগুলোতে একমত হবে না। এটা ঠিক নয়।

কমিশন যা বলছে : সংলাপ শেষে প্রেস ব্রিফিংয়ে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, কমিশনের পক্ষ থেকে প্রাথমিক প্রস্তাবনাগুলো বারবার পরিবর্তন করা হয়। রাজনৈতিক দলগুলো যাতে একমত হতে পারে এ জন্য এমনটি করা হয়। আজকের বৈঠকে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি), মহাহিসাবরক্ষকের কার্যালয় ও ন্যায়পাল নিয়োগ এবং নারী আসনে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় অধিকাংশ দল একমত হলেও নিয়োগ কমিটির কাঠামো নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত আছে। আমরা তাদের সংশোধনীগুলো নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানাব। নারী আসনের নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে আগামীতে আলোচনা হবে। তিনি আরও বলেন, ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে খসড়া জুলাই জাতীয় সনদ রাজনৈতিক দলগুলোকে পৌঁছ দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে ৩০ জুলাই বুধবারের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোকে মতামত দিতে বলা হয়েছে।

জামায়াতের দাবি, নির্বাচন ঘিরে ষড়যন্ত্র হচ্ছে : নির্বাচন ঘিরে এক ধরনের ষড়যন্ত্র হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের বিষয়ে আপত্তি নেই। তবে এখন পর্যন্ত লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হয়নি।

তিনি আরও বলেন, কে সরকারি বা কে বিরোধী দল হবে, সেটি পরের বিষয়। আমরা দেশের জন্য কাজ করতে চাই। আমাদের আগামী নির্বাচনের ইশতেহারে দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ার ঘোষণা থাকবে এক নম্বরে। এ ব্যাপারে আমরা জিরো টলারেন্স। ইতিমধ্যে আমরা ছোটখাটো যেখানে দায়িত্ব পালন করেছি, সেখানে সে দৃষ্টান্ত রেখেছি।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual3 Ad Code