প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৫ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৩০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৪শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

শীর্ষে বাংলাদেশ: মানব পাচারে হারাচ্ছে হাজার মানুষের স্বপ্ন

editor
প্রকাশিত জুলাই ৩০, ২০২৫, ০১:২৮ অপরাহ্ণ
শীর্ষে বাংলাদেশ: মানব পাচারে হারাচ্ছে হাজার মানুষের স্বপ্ন

Manual7 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

Manual4 Ad Code

পাচার হয়ে প্রতিনিয়ত হারিয়ে যাচ্ছে হাজারও মানুষের স্বপ্ন। কেউ উন্নত জীবনের মোহে আবার কেউ দারিদ্র্যের কশাঘাত থেকে মুক্তির স্বাদ পেতে প্রলোভন ও প্রতারণার ফাঁদে পড়ছেন। ৫ থেকে ১৫ লাখ টাকা দিয়ে ইউরোপ যাওয়ার স্বপ্নে ভয়ংকর ও বিপৎসংকুল পথে পা বাড়াচ্ছেন। কিন্তু স্বপ্নের ইউরোপে পৌঁছান মাত্র ১১ ভাগ বাংলাদেশি। বাকি ৮৯ ভাগের দেহ-মন-স্বপ্ন মিলিয়ে যাচ্ছে সীমানার বাইরে, নিঃশব্দে। মানব পাচারকারীদের হাত থেকে এদের নিষ্কৃতি সহজেই মেলে না। মিললেও অর্থ, স্বপ্ন সব শেষ হয়ে যায়। আর এভাবেই বিশ্বে মানব পাচারের শীর্ষ দেশের তকমা পেয়েছে বাংলাদেশ।

ইউরোপের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা ফ্রন্টেক্সের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের শুরু থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে ৬ হাজার ৫৮৬ জন বাংলাদেশি মানব পাচারকারীদের মাধ্যমে বিভিন্ন রুট দিয়ে ইউরোপে ঢোকার চেষ্টা করেছেন। এই সংখ্যাটা ২০২৪ সালে ছিল ১৫ হাজার ৭৭১ জন, ২০২৩ সালে ছিল ১৫ হাজার ৫০৬, ২০২২ সালে ছিল ১৭ হাজার ১০১ এবং ২০২১ সালে ছিল ৯ হাজার ২০৮ জন। এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশিরা লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে সবচেয়ে বেশি ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করেন। ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই পথে অন্তত ৭০ হাজার ৯০৬ জন বাংলাদেশি ইউরোপে প্রবেশ করেন।

এদিকে বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে মানব পাচারের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ সদস্যদেশগুলো। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ইউরোপের বিভিন্ন দেশ অবৈধ বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য উদ্বেগ জানিয়ে দ্রুত প্রত্যাবাসনের চাপ দিচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, স্পেন, মাল্টা, গ্রিস, অস্ট্রিয়াসহ অন্যান্য দেশ। বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ইতালির সঙ্গে আলাদা চুক্তি হয়েছে। সম্প্রতি ইতালির পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মারিয়া ত্রিপদির ঢাকা সফর করেন। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে বৈঠকের সময় তিনি সে দেশে অবৈধভাবে অবস্থানকারী বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনতে তাগাদা দেন।

Manual3 Ad Code

ব্র্যাকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ইউরোপের দিকে সবচেয়ে বেশি মানব পাচারের শিকার হয়েছেন বাংলাদেশিরা। এই সময়ের মধ্যে সমুদ্রপথে ৯ হাজার ৭৩৫ জন পাচার হয়ে তালিকার শীর্ষে রয়েছে বাংলাদেশ। একই সময়ে ৪ হাজার ৩৪৮ জন পাচার হয়ে তালিকার দ্বিতীয় অবস্থানে আছে ইরিত্রিয়া। ৩ হাজার ৫৫৬ জন পাচার হয়ে তালিকার তৃতীয় অবস্থানে আছে মিসর। এ ছাড়া চতুর্থ অবস্থানে পাকিস্তান। সে দেশ থেকে ২ হাজার ৬২৫ জনকে পাচার করা হয়েছে। ৫ম অবস্থানে আছে ইথিওপিয়া ১ হাজার ৪৩০ জন, ১ হাজার ৮৬ জন পাচার হয়েছে সিরিয়া থেকে। তালিকায় সে দেশের অবস্থান ষষ্ঠ। ৭ম অবস্থানে আছে সুদান ১ হাজার ২০ জন, ৮ম অবস্থানে আছে সোমালিয়া ৯৬৭ জন, ৯ম অবস্থানে গিনি ৭২৪ জন এবং দশম অবস্থানে আছে আলজেরিয়া ৫৬১ জন।

Manual2 Ad Code

ব্র্যাকের প্রতিবেদনে বলা হয়, পাচারকারীরা ৩টি বড় রুট এবং ১৮টি ছোট রুট দিয়ে বাংলাদেশিদের ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাচার করে। বড় রুটগুলোর মধ্যে রয়েছে ভূমধ্যসাগর, পূর্ব ভূমধ্যসাগর ও পশ্চিম ভূমধ্যসাগর। এ ছাড়া ছোট রুটগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ থেকে ভারত-পাকিস্তান-আফগানিস্তান-ইরান-তুরস্ক হয়ে ইউরোপের গ্রিস, ভারত-পাকিস্তান-ইরান-তুরস্ক হয়ে গ্রিস, দুবাই-বাহরাইন-তুরস্ক-লিবিয়া-ইতালি, দুবাই-তুরস্ক-লিবিয়া হয়ে ইতালি এবং দুবাই-লিবিয়া হয়ে ইতালি পৌঁছানোর রুট ব্যবহার করে মানব পাচারকারীরা। এ ছাড়া বাংলাদেশ থেকে তুরস্ক হয়ে গ্রিস, ইরাক-তুরস্ক-গ্রিস, তুরস্ক হয়ে গ্রিস, দুবাই-সুদান-লিবিয়া-ইতালি, দুবাই-তুরস্ক-জর্ডান-মিসর-লিবিয়া-ইতালি, ওমান-দুবাই-পাকিস্তান-ইরান-তুরস্ক-গ্রিস ও ওমান-তুরস্ক-গ্রিসে যাওয়ার রুটে মানব পাচার হয়। এর বাইরে শ্রীলঙ্কা-কাতার-তুরস্ক-লিবিয়া হয়ে ইতালি, সৌদি আরব-ইরাক-সিরিয়া-তুরস্ক-গ্রিস, দুবাই-ইরান-তুরস্ক-গ্রিস, রাশিয়া-ইউক্রেন-হাঙ্গেরি-স্লোভেনিয়া-ইতালি, ইরান-আজারবাইজান-আরমেনিয়া-তুরস্ক-গ্রিস এবং বাংলাদেশ থেকে সাইপ্রাস। এসব রুটে মানব পাচারকারীরা প্রলোভন দিয়ে মাসের পর মাস এক দেশ থেকে আরেক দেশে বাংলাদেশিদের পাচার করে। কিন্তু স্বপ্নের ইউরোপে পৌঁছার সৌভাগ্য হয় মাত্র ১১ ভাগের। বাকি ৯০ ভাগের মধ্যে কারও সলিলসমাধি হয় ভূমধ্যসাগরে নৌকা ডুবে। কেউবা আটক থাকেন বিভিন্ন দেশের ডিটেনশন সেন্টারে। অমানবিক নির্যাতন ও মুক্তিপণের শিকার হন আবার কেউ কেউ। তাদের পরিবার-পরিজন মাসের পর মাস আশা-নিরাশায় দিন গুনতে থাকে, কখন ফোন আসবে ইউরোপ পৌঁছানোর। যারা পৌঁছান তাদের পরিবারে হাসির দেখা মেলে, আর যাদের মৃত্যু ঘটে বা মুক্তিপণের শিকার হন, তাদের পরিবারে কান্না ও শোকের কালো ছায়া নেমে আসে। হাসি-কান্নার এই যাত্রা বন্ধ আর হয় না কোনো দিন।

জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের ২৫ লাখ মানুষ সাগরপথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপে গিয়েছেন। এভাবে যেতে গিয়ে প্রায় ২২ হাজার মানুষ সাগরে ডুবে প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে অনেক বাংলাদেশি আছেন।

Manual6 Ad Code

অর্থনৈতিক কারণে বাংলাদেশ থেকে মানব পাচারের অন্যতম ঝুঁকি বিবেচনায় দারিদ্র্য এবং পর্যাপ্ত আয়ের সুযোগ না থাকাকে চিহ্নিত করা হয়। ফলে বাংলাদেশের মানুষ শুধু মানব পাচারের শিকারই হচ্ছেন না, বরং ঝুঁকিপূর্ণ কাজেও যোগ দিচ্ছেন। আর এ থেকে উত্তরণের লোভ দেখিয়ে পাচারকারীরা দুর্বল মানুষগুলোর সরলতার সুযোগ নিচ্ছে।

ব্র্যাকের মাইগ্রেশন অ্যান্ড ইয়ুথ প্ল্যাটফর্মের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান জানান, গত কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ মানব পাচারে শীর্ষে অবস্থান করছে। মানব পাচারকারীদের প্রলোভনে পড়ে ঝুঁকিপূর্ণ পথে স্বপ্নের দেশে পৌঁছানোর আগেই প্রতিবছর অন্তত ৫০০ বাংলাদেশির মৃত্যু ঘটে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সব জেলার লোক কিন্তু এভাবে ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা করেন না। শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নোয়াখালী, কুমিল্লাসহ সুনির্দিষ্ট কিছু এলাকার লোকজন এভাবে ইউরোপে যায়। আমাদের গবেষণায় উঠে এসেছে যে, দালালরা এসব এলাকার অভিভাবক ও তরুণদের ভালো চাকরি আর ইউরোপের প্রলোভন দেখাচ্ছে, যেটি বাস্তবসম্মত নয়। কাজেই সাধারণ মানুষ ও বিদেশগামীদের সবার আগে সচেতন হতে হবে।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual8 Ad Code