প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৪ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৩শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

পারিবারিক সহিংসতায় বাড়ছে খুন

editor
প্রকাশিত জুলাই ৩০, ২০২৫, ০১:৪৯ অপরাহ্ণ
পারিবারিক সহিংসতায় বাড়ছে খুন

Manual1 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

ময়মনসিংহের ভালুকা পৌর শহরের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম। ৪০ হাজার টাকা ধার করে জেলে থাকা ছোট ভাই নজরুল ইসলামকে ছাড়িয়ে আনেন তিনি। এর কিছুদিন পরে পারিবারিক কলহের জেরে সেই রফিকুলের স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়েকে গলাকেটে হত্যা করে পালান নজরুল। এ ঘটনা গত ১৪ জুলাইয়ের।

সাইকেল কেনার টাকার জন্য খালার বাসায় যায় ১৪ বছরের কিশোর গোলাম রব্বানী খান ওরফে তাজ। খালার অগোচরে তিন হাজার টাকা চুরির সময় ধরা পড়ে সে। মাকে বলে দিতে চাওয়ায় টেবিলে রাখা ছুরি দিয়ে প্রথমে বড় খালাকে, পরে সেজো খালাকেও ছুরিকাঘাত করে। গত ৯ মে রাজধানীর শেওড়াপাড়ায় দুই খালাকেই হত্যা নিশ্চিত করে পালিয়ে যায় ১৪ বছরের এ কিশোর।

 

 

২৮ মে ঢাকার মিরপুরে পরকীয়া প্রেমিকের হাতে খুন হন স্বামী ও স্ত্রী। মিরপুরের একটি বাড়িতে নাজমুল হাসান পাপ্পু ও দোলনা আক্তার দোলাকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে গাউস মিয়া নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে। পুলিশ জানায়, নিহত দোলা তার স্বামী পাপ্পুর সঙ্গে মিরপুরের ওই বাড়িতে সাবলেট হিসেবে ভাড়া থাকতেন। কিছুদিন আগে গাউস মিয়া প্রবাস জীবন শেষ করে দেশে এসে দোলার সঙ্গে পরকীয়া প্রেমে জড়িয়ে পড়েন। পরে বিয়ে নিয়ে দোলার সঙ্গে মনোমালিন্য হলে দোলা ও তার স্বামীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করেন গাউস।

সামাজিক ও পারিবারিক দ্বন্দ্ব-কলহের কারণে অবলীলায় এভাবে খুন হচ্ছে মানুষ। অধিকাংশই ঘটনাই ঘটছে শিক্ষিত পরিবারে। বাবা-মায়ের হাতে সন্তান, সন্তানের হাতে বাবা-মা, পরকীয়ার কারণে স্বামীর হাতে স্ত্রী, স্ত্রীর হাতে স্বামী, সম্পত্তির জেরে এক ভাই আরেক ভাইকে হত্যা করছে। প্রায় প্রতিটি ঘটনাই তুচ্ছ কোনো কারণে ঘটছে। একটি ঘটনার নৃশংসতা ছাড়িয়ে যাচ্ছে আরেকটিকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটা শুধু আইনশৃঙ্খলার অবনতির দৃষ্টান্ত নয়, দেশে আইনের শাসনের ঘাটতি ও সামাজিক অসুস্থতারও লক্ষণ।

 

 

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, সমাজবিজ্ঞানী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, সামাজিক অনুশাসন ও মূল্যবোধের অবক্ষয়, মাদকাসক্তি, অনৈতিক সম্পর্ক, সহনশীলতার অভাব, দ্রুত বিত্তশালী হওয়ার প্রবণতা, নিঃসঙ্গ জীবনযাপন, আত্মকেন্দ্রিকতা, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতার মনোভাব, অসচ্ছলতা ইত্যাদি কারণে ঘটছে এসব ঘটনা।

এ ধরনের অপরাধ কমাতে হলে পরিবারের পাশাপাশি সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে। সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস বাড়ানোর কথাও বলছেন তারা। প্রযুক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানবিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে সবাইকে আরও মনোযোগী হতে হবে।

 

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, গত জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ, এপ্রিল ও মে- এই পাঁচ মাসে সারাদেশে খুনের ঘটনায় মামলা হয়েছে এক হাজার ৫৮৭টি। এর মধ্যে কয়েক বছর আগের কিছু মামলাও রয়েছে।

 

পুলিশের তথ্যানুযায়ী, বছরে মোট হত্যাকাণ্ডের ৪০ শতাংশ হয় পারিবারিক কলহের কারণে। নিরপরাধ শিশুরাও স্বামী-স্ত্রীর বিরোধের কারণে হত্যার শিকার হয়। ২০২৫ সালের প্রথম পাঁচ মাসে সারাদেশে এক হাজার ৫৮৭টি খুনের ঘটনা ঘটে। এ সময়ে রাজধানীতে ১৬৮ জন খুন হয়। অধিকাংশ খুনের কারণই পারিবারিক।

 

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রতিদিন গড়ে খুন হচ্ছে ১০ থেকে ১২ জন। এর অধিকাংশই পারিবারিক ও সামাজিক কারণে। আর এর প্রধান শিকার নারী ও শিশু।

ঢাকা মহানগরে গত পাঁচ বছরে খুনের মামলা হয়েছে এক হাজার ১০৬১টি। ২০২০ সালে ২১৯টি, ২০২১ সালে ১৬৬টি, ২০২২ সালে ১৭২টি, ২০২৩ সালে ১৬৫টি এবং ২০২৪ সালে মামলা হয়েছে ৩৩৯টি।

 

এসব হত্যাকাণ্ডের বড় একটি অংশ ঘটেছে পারিবারিক কলহ ও দ্বন্দ্বে। হত্যাকাণ্ডের পরিসংখ্যানে ঢাকাই শীর্ষে। তবে আয়তন বিবেচনায় ঢাকার জনসংখ্যাও সর্বাধিক।

শুধু ঢাকা নয়, পুরো দেশেই পারিবারিক কলহ আর দ্বন্দ্বের কারণে হত্যা বাড়ছে। গত মে মাসে সারাদেশে খুনের মামলা হয়েছে ৩৪১টি।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, ২০২৪ সালে স্বামীর হাতে খুন হন ১৮০ জন নারী, স্বামীর পরিবারের সদস্য দ্বারা ৪০ জন, নিজের পরিবারের সদস্য দ্বারা ৫৮ জন এবং আত্মহত্যা করেন ১৭৪ জন নারী।

 

২০২৩ সালে স্বামীর হাতে খুন হন ২০৭ জন নারী, স্বামীর পরিবারের সদস্য দ্বারা খুন ৫৩ জন, নিজের পরিবারের সদস্য দ্বারা খুন ৩২ জন এবং আত্মহত্যা করেন ১৪২ জন নারী। ২০২২ সালে স্বামীর হাতে খুন হন ২০৬ জন নারী, স্বামীর পরিবারের সদস্য দ্বারা খুন ৪৪ জন, নিজের পরিবারের সদস্য দ্বারা খুন ৪২ জন এবং আত্মহত্যা করেন ৯৭ জন নারী। ২০২১ সালে স্বামীর হাতে খুন হন ২২৪ জন নারী, স্বামীর পরিবারের সদস্য দ্বারা খুন ৭৩ জন, নিজের পরিবারের সদস্য দ্বারা খুন ৭৫ জন এবং আত্মহত্যা করেন ১৪২ জন নারী। ২০২০ সালে স্বামীর হাতে খুন হন ২৪০ জন নারী, স্বামীর পরিবারের সদস্য দ্বারা খুন ৭১ জন, নিজের পরিবারের সদস্য দ্বারা খুন ৫৬ জন এবং আত্মহত্যা করেন ৯০ জন নারী।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, গত পাঁচ বছরে স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন ১০৫৭ জন নারী। আত্মহত্যা করেন ৬৪৫ জন।

 

জমি নিয়ে বিরোধে খুন

সামাজিক যে অপরাধগুলো সংঘটিত হচ্ছে তার বেশিরভাগই অর্থ-সম্পদ কেন্দ্র করে। একটা সময় ছিল যখন পরিবারের মধ্যে সম্পদ ভাগাভাগি হতো না। কিন্তু পরিস্থিতি বদলেছে। জমি কেন্দ্র করে এখন সামাজিক অপরাধ বেশি সংঘটিত হচ্ছে।

 

মানসিক সমস্যাও হত্যাকাণ্ডের কারণ

১৮ জুন ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলায় নিজ ঘরের মেঝেতে মাটিচাপা দেওয়া অবস্থায় দুই বছর বয়সী এক শিশুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। হত্যার পর মাটিচাপা দেন শিশুটির বাবা নুরুল আমিন (৩০)। পরে জানা যায়, বাবা দীর্ঘদিন ধরে মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন।
মাদকাসক্তির কারণে খুন

লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলায় পারিবারিক কলহের জেরে হজরত আলীকে তার মাদকাসক্ত ছেলে মো. মামুন ধারালো অস্ত্র দিয়ে মাথায় আঘাত করেন। এতে ঘটনাস্থলেই হজরত আলীর মৃত্যু হয়। জানা যায়, মাদকাসক্তির কারণে মামুনের সঙ্গে তার বাবার প্রায়ই বাগবিতণ্ডা হতো।

Manual8 Ad Code

 

পরকীয়ার জেরে খুন

পাশ্চাত্য সংস্কৃতি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মানুষের নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় বাড়িয়ে দিচ্ছে। মানুষ পরকীয়াসহ অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছে। হয়ে উঠছে প্রতিশোধপরায়ণ। গত ১৪ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পরকীয়ার জেরে স্বামীর হাতে স্ত্রী শারমীন আক্তার (২৪) এবং তার দুই শিশুসন্তান রওজা (৫) ও নওরিন (৩) হত্যার শিকার হয়।

 

এ রকম ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে যাওয়ায় সামাজিক অবক্ষয়কেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি এসব ঘটনার পেছনে প্রযুক্তিনির্ভর জীবন, সহমর্মিতার অভাব, টিভি সিরিয়ালে ক্রাইম সিন দেখে হত্যায় উৎসাহিত হওয়া এবং ব্যক্তিনির্ভর জীবন গড়ে ওঠাকে দায়ী করা হচ্ছে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে সামাজিক বন্ধন দৃঢ় করা, একে অপরকে ছাড় দেওয়ার মনোভাব গড়ে তোলা এবং সামাজিক সংগঠনগুলোকে সক্রিয় করতে হবে।

ঢাকা আহছানিয়া মিশন স্বাস্থ্য সেক্টরের সিনিয়র সাইকোলজিস্ট রাখী গাঙ্গুলী বলেন, ‘আমরা নিজেদের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করতে পারি না অথবা শিখি না। সমাধান কোথায় অথবা কোন জায়গায় স্ট্রেস লেভেল বাড়ছে তা আমরা বুঝি না। এতে একটি একটি করে সমস্যা আমাদের স্ট্রেসকে ক্রমাগতভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছে। স্ট্রেস বাড়তে বাড়তে ধারণক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। যখনই ধারণক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে তখনই উপচে পড়ছে।’

Manual5 Ad Code

পারিবারিক সহিংসতার পেছনে মাদকের একটি বড় প্রভাব রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘মাদকাসক্ত ব্যক্তিরাও সহিংসতার ঘটনা ঘটায়। না জেনে, না বুঝে এমন কিছু আচরণ তারা করে যা সমাজসিদ্ধ নয়। যৌথ পরিবার থেকে একক পরিবার বাড়ছে। যখনই একক পরিবার আবির্ভূত হলো তখনই সন্তানকে স্বার্থপর হতে শেখাচ্ছি আমরা। আমরা ভাগ করে খাবার খাচ্ছি না। কষ্টগুলো ভাগ করছি না। একাকিত্বকে অনুভব করছি আমরা।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও অপরাধ বিশ্লেষক ড. মো. তৌহিদুল হক বলেন, ‘অনৈতিক সম্পর্ক, মাদকাসক্তি, পারিবারিক কলহের জের, জমি নিয়ে বিরোধ এবং নৈতিক অবক্ষয় থেকে সামাজিক অপরাধ ঘটছে। এর মূল কারণ— আইনের সঠিক প্রয়োগ না থাকা। আইন প্রয়োগের জায়গাটি অনেক দুর্বল। এই মুহূর্তে নীতি-নৈতিকতা, আদর্শ ও মূল্যবোধের যে চরম অবক্ষয় ঘটেছে, সেটা রোধ করতে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে কঠোর হতে হবে।’

অর্থনৈতিক চাপ ও অনিশ্চয়তাকেও সহিংসতা বাড়ার বড় কারণ মনে করেন অনেকে। অপরাধ বিশ্লেষক মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ওমর ফারুক বলেন, ‘পারিবারিক সম্পর্কের জায়গাটা দিন দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এর বেশ কিছু কারণ আছে। এর মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক সংকট, সুস্থ পারিবারিক বিনোদনের অভাব, তথ্য-প্রযুক্তির অপব্যবহার। মনস্তাত্ত্বিক জায়গা থেকে পরস্পরের সঙ্গে বন্ধনের জায়গায় ঘাটতি হচ্ছে।’

Manual2 Ad Code

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘পারিবারিক সহিংসতা কমাতে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন আইন হয়েছে। শুধু আইন হলেই হবে না, আইনের প্রয়োগ দরকার। শুধু মেয়েরাই সহিংসতার শিকার হয় তা নয়। পুরুষ ও নারী উভয়েই সহিংসতার শিকার হয়। তথ্য-প্রযুক্তির যুগে পরকীয়া অনেক বেশি বেড়েছে। মানুষের মধ্যে যে ধৈর্যশীলতা থাকা দরকার তা নেই। নৈতিকতা, মূল্যবোধ কমে গেছে। এসব মানসিক অস্থিরতা পারিবারিক সহিংসতার মূল কারণ।’

তিনি বলেন, ‘বিয়ের পর ছোটখাটো বিষয় নিয়ে যে ঝামেলা তৈরি হয় সেটা মেটানোর জন্য মাঝে যে লোকগুলো থাকে তারা সমাধানে এগিয়ে আসে না। বরং দুজনের মধ্যে আরও ইন্ধন জোগায়। এ কারণে পারিবারিক সহিংসতা বেড়ে যায়।’

Manual1 Ad Code

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর বলেন, ‘পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক মূল্যবোধের কারণে অপরাধ ঘটছে। খুনোখুনিসহ নৃশংস অপরাধের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি পুলিশ সদর দপ্তর থেকে মাঠপর্যায়ে সচেতনতামূলক সভা করতে নির্দেশ দেওয়া আছে। এসব সভায় পুলিশ ওইসব অপরাধের আইন ও শাস্তির বিষয়ে সবাইকে অবগত করে। তারপরও এখানে সমাজের ভূমিকা সবচেয়ে জরুরি। পাশাপাশি অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে পুলিশের নিয়মিত কার্যক্রম চলমান।’

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual4 Ad Code