প্রজন্ম ডেস্ক:
আলেচিত জুলাই সনদ নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলোর সরব উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ দেখা গেছে। দ্বিতীয় পর্বে দীর্ঘ ২৩ দিন কমিশন ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করে। জুলাই স্পিরিট ধারণ করে ১৯টি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ঐকমত্য কমিশন। আটটিতে একমত পোষণ করেছে আলোচনায় অংশ নেওয়া ৩০টি দলই। ১১টি পরিবর্তনে দ্বিমত জানিয়েছে বিএনপিসহ একাধিক দল। দ্বিমত জোরালো করতে ওয়াক আউটও করেছে অনেক দল।
মানা না মানার ভেতর দিয়ে জুলাই সনদ খসড়া চূড়ান্ত করা হলেও সনদে স্বাক্ষর নিয়ে গড়িমসি ও অস্বস্তির আভাস পাওয়া যাচ্ছে রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য-বিবৃতিতে। জুলাই স্পিরিট ধারণ করা দলগুলোর ভেতরে এই ওই থাকা না থাকা নিয়ে রয়েছে আলোচনা। সনদে স্বাক্ষর নিয়ে নানান নেতিবাচক আলোচনা পাওয়া গেছে।
ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেন, গত ৩ জুন থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত দ্বিতীয় ধাপের ২৩ দিনের সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে ১৯টি বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত দেয় কমিশন। যার মধ্যে ৮টি বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য হয়। বাকি ১১টিতে বিভিন্ন দলের ‘নোট অব ডিসেন্ট’ থাকবে।
এদিকে জুলাই সনদ ঘিরে সারা দেশের মানুষ এক ধরনের কৌতূহলপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কী থাকবে জুলাই সনদে? দলগুলো স্বাক্ষর করবে কি না? এসব নানা প্রশ্ন ও সনদ ঘোষণা ঘিরে উত্তাপ ছড়াবে আগস্ট মাস। জুলাই সনদ ঘোষণার দাবিতে আজ রবিবারের এনসিপির কর্মসূচি থেকে কী আসবে? এ নিয়েও রয়েছে আলোচনা। এনসিপি আগে থেকে বলে আসছে এবং এখনো বলছে, সনদে এই-ওই থাকতে হবে। তাদের এমন জোরালো দাবিও উত্তাপ সৃষ্টি করছে। আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম জুড়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা অডিও-ভিডিওর উপস্থিতি ‘ভীতির কারণ’ হয়ে উঠছে। সরকারি গোয়েন্দা সংস্থা এসবির সতর্ক থাকার বার্তা ও সামনের চার-পাঁচ দিন কঠিন সময় প্রেস সচিবের এমন বক্তব্য উত্তাপের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
জানা গেছে, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলো জানিয়েছে, সনদ স্বাক্ষরের চূড়ান্ত মুহূর্তে এসে বড় ও পুরনো দলগুলোর ভেতরে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও অস্বস্তি কাজ করছে। ঐকমত্য কমিশনের সভায় ইনিয়ে-বিনিয়ে সেসব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও অস্বস্তির কথা প্রকাশ করলেও রাজনৈতিক দলের সেসব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও অস্বস্তি সনদ প্রণয়ন আটকাতে পারেনি। গত ৩১ জুলাই খসড়া চূড়ান্ত করতে সক্ষম হয়েছে ঐকমত্য কমিশন। এখন সনদে স্বাক্ষরের চূড়ান্ত দিনক্ষণ ও আনুষ্ঠানিকতা সন্নিকটে। সরকারের একাধিক উপদেষ্টা ও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ৫ আগস্ট চূড়ান্ত সনদ ঘোষণার দিনক্ষণ জানিয়েছেন।
সনদে স্বাক্ষরের ব্যাপারে বিএনপির শীর্ষ এক নেতা বলেন, নির্বাচন বিলম্বিত হোক তা চায় না বিএনপি। একমাত্র নির্বাচন আদায়ের স্বার্থে অস্বস্তি রেখেও নানা ইস্যূতে আপসের রাজনীতি করছে ক্ষমতাপ্রত্যাশী বিএনপি। তার মানে ভবিষ্যৎ রাজনীতি কলুষিত করে এমন আপসের রাজনীতি করবে, তাও নয়। তিনি বলেন, কমিশনের সভায় গিয়েছি, ঐকমত্য যেমন জানিয়েছি, দ্বিমতও জানিয়েছি। ভবিষতে দায় না নিতে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ রেখেছি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শেষ মুহূর্তে এসে স্বাক্ষর প্রশ্নে গড়িমসি করার আভাস পাওয়া যাচ্ছে বড় দল বিএনপির কাছ থেকে। পুরনো দল জাসদ, বাসদ, কমিউনিস্ট পার্টসহ চেনা একাধিক দলের নেতাদের বক্তব্য-বিবৃতিতেও আছে স্বাক্ষর নিয়ে গড়িমসির আভাস।
এদিকে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘সংস্কারের কাজ নির্বাচিত সরকারের হাতে ছেড়ে দেব না। নির্বাচন জুলাই সনদের ভিত্তিতে হবে। পরে সনদের ভিত্তিতেই জাতীয় সংসদ গঠিত হবে।’ গতকাল শনিবার এনসিপির অস্থায়ী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এমন মন্তব্য করেন দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
নাহিদ ইসলাম বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্রের খসড়া চূড়ান্ত করে তা আগামী ৫ আগস্ট বিকেল ৫টায় জাতির সামনে উপস্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। এ সিদ্ধান্তকে এনসিপি স্বাগত জানায়।
তবে ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ অবশ্যই সংবিধানের প্রস্তাবনা ও তফসিলে উল্লেখ করে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিতে হবে। একই সঙ্গে ওইদিনের মধ্যেই জুলাই সনদ প্রকাশেরও দাবি জানিয়ে আসছি আমরা। তবে ঐকমত্য কমিশন এখনো ‘নোট অব ডিসেন্ট’ সম্পর্কিত বিষয়গুলোর সমাধান জানায়নি।
তিনি বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্রের জন্য সরকারকে স্বাগত জানাই। তবে ৫ আগস্টের মধ্যে জুলাই সনদের বিষয়েও সুরাহা হতে হবে। জুলাই সনদের বিষয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঐকমত্য হয়েছি। বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিশ্চিত হয়েই আমরা স্বাক্ষর করব। অবশ্যই এর আইনি ভিত্তি থাকতে হবে।
জুলাই ঘোষণাপত্র ৫ আগস্টের মধ্যে ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। গত শুক্রবার রাত ১২টার দিকে এক ফেসবুক পোস্টে এ তথ্য জানান তিনি। নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে মাহফুজ আলম লেখেন, ‘জুলাই ঘোষণাপত্র এখন বাস্তবতা। ৫ আগস্টের মধ্যেই ঘোষিত হবে ঘোষণাপত্র। ঘোষণাপত্র ইস্যুকে গণআকাক্সক্ষায় বাঁচিয়ে রেখে এটা বাস্তবায়নের পথ সুগম করার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।
‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ আসছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। গত শুক্রবার রাতে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে এ কথা জানান তিনি।
উপদেষ্টা আসিফ ওই ফেসবুক পোস্টে ৩৬ জুলাই আন্দোলনে শিল্পীদের রাজপথের ভূমিকা তুলে ধরেন। তিনি লেখেন, ‘হত্যার বিচার ও চলমান দমন-পীড়ন বন্ধের দাবিতে রাজপথে নামেন শিল্পীরা। বেলা ১১টায় সংসদ ভবনের সামনে মানববন্ধনের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি থাকলেও খামারবাড়ী মোড়ে পৌঁছালে পুলিশ তাদের পথ আটকে দেয়। বাধা পেরিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে স্লোগান দিতে দিতে তারা পৌঁছান ফার্মগেট। যেখানে ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে রাজপথেই প্রতিবাদ চালিয়ে যান।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভবিষ্যৎ রাজনীতির কথা ভেবে সনদ স্বাক্ষরে গড়িমসি করার রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করেছে তারা। এসব দলের একাধিক নেতা বলেন, বর্তমান সময়কে রাজনৈতিক ইতিহাসে সংকটকালীন সময় হিসেবে চিহ্নিত করা থাকবে। সংকটকালীন সময় ধরে রাজনৈতিক দলগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সায় দিয়ে এলেও স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে এগুলোর পরিণাম কী হবে সেটা ভাবতে হচ্ছে তাদের। ভবিষ্যৎ চিন্তায়, রাজনীতিতে টিকে থাকার প্রশ্নে বড় ও পুরনো দলগুলো পড়েছে দ্বিধায়। চূড়ান্ত সনদে স্বাক্ষর ইতিহাসের কালো অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হয় কি না, সে ভীতিতে পড়েছে তারা।
স্বাক্ষর প্রশ্নে কমিউনিস্ট পার্টি সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, চূড়ান্ত সনদ ঘোষণা করুক তারপর দেখা যাবে স্বাক্ষর করব কি করব না। সুনির্দিষ্ট হয়ে আসুক। তারপর কারা সই করবে, কারা করবে না সেটি আসবে। তিনি বলেন, এখনো তো অনিশ্চিত।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, মুক্তিযুদ্ধ ও একাত্তর প্রশ্নে আপস নয়, এটাই বিএনপির মূল। এখানে ব্যত্যয় ঘটেছে কি না, চূড়ান্ত ঘোষণা এলে বোঝা যাবে। তাছাড়া সংস্কার তো আমাদের দাবি। বিএনপি সংস্কারের ৩১ দফা ঘোষণা করেছে।
জুলাই সনদকে একটি অর্জন বলে দাবি করেছেন নাগরিক ঐক্যের প্রধান নেতা মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি বলেন, এখানে ঐকমত্যের কোনো বিকল্প নেই।
৩০টি দল ও জোটের ঐকমত্য হওয়া ৯টি বিষয় হল ১. সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব; ২. নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ; ৩. রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সম্পর্কিত বিধান; ৪. জরুরি অবস্থা ঘোষণা; ৫. সংবিধান সংশোধন; ৬. প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল; ৭. পুলিশ কমিশন গঠন-সংক্রান্ত প্রস্তাব; ৮. নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ সম্পর্কিত প্রস্তাব।
ভিন্নমতের সুযোগ রেখে সিদ্ধান্ত দেওয়া ১১টি বিষয় হচ্ছে ১. সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন; ২. নারী প্রতিনিধিত্ব; ৩. বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ ও সুপ্রিম কোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ; ৪. প্রধান বিচারপতি নিয়োগ (নির্বাচনের ইশতেহারে জ্যেষ্ঠ দুজন বিচারপতি থেকে পরবর্তী প্রধান বিচারপতি করা হবে এমনটা বলা দল বিজয়ী হলে করতে পারবে। বিএনপি আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ দুই বিচারপতি থেকে প্রধান বিচারপতি করার পক্ষে); ৫. প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকা; ৬. সরকারি কর্ম কমিশন, দুদক, সিঅ্যান্ডএজি এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান সংবিধানে সংযোজন করা এ প্রস্তাবের আংশিক নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে দলগুলো একমত হয়েছে; ৭. উচ্চকক্ষ গঠন; ৮. রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতি; ৯. রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব; ১০. তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিষয়ে উত্থাপিত সমন্বিত প্রস্তাবের ৮, ৯, ১১ এবং ১২ ক্রমিক নম্বরের প্রস্তাবসমূহ; ১১. রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি।
Sharing is caring!