প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২১শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৬ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১লা রজব, ১৪৪৭ হিজরি

পাচার হওয়া টাকা কি আদৌ ফেরানো যাবে

editor
প্রকাশিত আগস্ট ২৪, ২০২৫, ০৯:১৪ পূর্বাহ্ণ
পাচার হওয়া টাকা কি আদৌ ফেরানো যাবে

Manual2 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

Manual5 Ad Code

 

ক্ষমতাচ্যুত হাসিনা সরকারের আমলে ২০০৯ সাল থেকে পাচার হয়েছে প্রায় ২৮ লাখ কোটি টাকা। এ ছাড়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার সম্পদের সন্ধান পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল (সিআইসি)। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত পাঁচটি দেশের সাতটি শহরে অনুসন্ধান চালিয়ে এই তথ্য পেয়েছে সরকার। এখন প্রশ্ন, পাচার হওয়া এই অর্থ সরকার কি আদৌ ফেরাতে পারবে?

 

ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, হংকং, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক, দুদক, এনবিআর, সিআইডির দল কাজ করছে। প্রধান ভূমিকা পালন করছে দুদুক।

 

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন বলেছেন, পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনা একটি জটিল প্রক্রিয়া। বাস্তবতা হলো, এ পর্যন্ত বিগত কোনো সরকারের আমলেই বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনা সম্ভব হয়নি। বরাবরই কাগুজে বাঘের হুঙ্কার দিয়েছে দুদক, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, এনবিআর ও সিআইডি। আদতে তারা কি টাকা ফেরাতে পারবে?

 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে অনেক আগেই বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে একাধিক চুক্তি করে। এ সংক্রান্ত বিভিন্ন এজেন্সি রয়েছে। তবে দেশ থেকে বিভিন্ন সময় পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে দুর্নীতি দমন কমিশনের একাধিকবার চেষ্টা করেও সফল হয়নি। বরং দুদকের অভিজ্ঞতার ঘাটতি রয়েছে। তবে শুধু দুদককে দোষ দিলেই হবে না, এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে অনেক সংস্থা।

২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার ক্ষেত্রে দুদকের সাফল্য মাত্র একটি। তিন দফায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার প্রয়াত পুত্র আরাফাত রহমান কোকোর পাচার করা টাকা সিঙ্গাপুরের একটি ব্যাংক থেকে ফেরত আনে দুদক।

 

এদিকে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আর্থিক খাতের রাঘববোয়াল, আমলা ও মধ্যস্বত্বভোগীরা বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার করেছেন। ইতিমধ্যে বিদেশে পাচার হওয়া হাজার কোটি টাকার ১১টি এবং ২০০ কোটি টাকার ১০১ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। টাকার খোঁজে দুর্নীতি দমন কমিশন জোরেশোরেই মাঠে নেমেছে।

 

গত সাড়ে ১৫ বছর ধরে ডলার সংকট, ভঙ্গুর অর্থনীতি, মূল্যস্ফীতিসহ নানা টানাপড়েনে রয়েছে দেশের অর্থনীতি। এই টানাপড়েনের অন্যতম কারণ বিদেশে টাকা পাচার। বৈশ্বিক বাণিজ্যভিত্তিক কারসাজি, হুন্ডি, চোরাচালানসহ বিভিন্ন পন্থায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার করা হয়েছে লাখ লাখ কোটি টাকা। এই টাকা ফেরত আনতে দুদককে সহযোগিতা করছে বিভিন্ন সংস্থা। গত ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেছে দুদক। আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী-এমপিসহ শতাধিক প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে সংস্থাটি। দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটের অনুসন্ধানে এদের বেশিরভাগের বিরুদ্ধেই অর্থ পাচারের প্রাথমিক সত্যতা মিলেছে।

 

Manual4 Ad Code

সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেছেন, বিদেশে পাচার হওয়া টাকা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক, দুদক, এনবিআর, সিআইডির দল কাজ করছে। এটি খুবই একটা বিস্তৃত একটা কাজ। এটি করতে কয়েক বছর লেগে যাবে। এখানে আইনি অনেক জটিলতা আছে।

 

Manual2 Ad Code

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, পাচার হওয়া টাকা উদ্ধারে বাংলাদেশ সরকার চাইলে এখনই দেশি-বিদেশি আইনজীবী নিয়োগ করতে পারে। দেশ থেকে বিভিন্ন দেশে পাচার করা টাকা উদ্ধারে যেসব ডকুমেন্টস দরকার ছিল, তার জন্য যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। এখন সরকার চাইলেই মামলা করতে পারবে। মামলা পরিচালনার জন্য ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক ল ফার্ম যোগাযোগ করেছে। এখানে ১০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে আগ্রহী তারা। এসব ফার্ম পাচার টাকা উদ্ধারের পর সেখান থেকে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত পার্সেন্টেজ নেবে তারা। বাকি টাকা সরকারকে বুঝিয়ে দেবে।

 

পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনা একটি জটিল প্রক্রিয়া উল্লেখ করে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন বলেন, আমরা চেষ্টা করছি। আমাদের আদালতের পাশাপাশি যেসব দেশে টাকা পাচার হয়েছে, সে দেশের আদালতে যদি আমরা প্রমাণ করতে পারি, তা হলে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। তবে টাকা পাচারকারীদের সঙ্গে কোনো সমঝোতা নয়। দুদক আইনে এগুলো ফৌজদারি অপরাধ।

 

বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরাতে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে ৭১টি মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন। এর মধ্যে মাত্র ২৭টি এমএলএআরের জবাব পেয়েছে সংস্থাটি। পাচারের অর্থ ফেরানোসহ দুর্নীতিবিষয়ক সমস্যা নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধি দল গত বছরের ১ অক্টোবর দুদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে। এর আগে একই বিষয়ে আলোচনার জন্য গত ২৬ সেপ্টেম্বর এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ২৪ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন দুদকের শীর্ষ কর্মকর্তারা।

 

গত ১০ সেপ্টেম্বর ইউনাইটেড ন্যাশনস অফিস ফর ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম (ইউএনওডিসি) এবং গত ৯ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) সঙ্গে বৈঠক করে। এ ছাড়া গত বছরের ৮ সেপ্টেম্বর অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে টাস্কফোর্স গঠন করার কথা বলেন। পরে গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরত আনা এবং ব্যবস্থাপনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরকে সভাপতি করে আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্স পুনর্গঠন করেছে সরকার।

Manual8 Ad Code

 

এদিকে গত বছরের ১ নভেম্বর অর্থনীতি নিয়ে তৈরি শ্বেতপত্র প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তুলে দেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। ওই প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। বর্তমান বাজারদরে (প্রতি ডলারের দাম ১২০ টাকা) এর পরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা। এই হিসাবে প্রতি বছর গড়ে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। প্রতি বছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সাপেক্ষে পাচারের পরিমাণ ৩ দশমিক ৪ শতাংশ।

 

দুদকের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছে দুদক। এ ছাড়া পাচার হওয়া টাকা উদ্ধারে সংস্থাটির সফলতা আছে। মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত কার্যক্রম, আইন ও আমাদের সক্ষমতা এফবিআইকে জানানো হয়েছে। এ ছাড়া যৌথ টাস্কফোর্স পুনর্গঠন হয়েছে। সরকারের বিশেষ টাস্কফোর্সে বাংলাদেশ ব্যাংক, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), দুর্নীতি দমন কমিশন, অর্থ বিভাগ, এনবিআর, অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ইত্যাদি সংস্থার প্রতিনিধিরা রয়েছেন। এ ছাড়া দুদকের সঙ্গে এফবিআইসহ একাধিক বিদেশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে।

 

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার ক্ষেত্রে সাফল্য মাত্র একটি। সেটি খালেদা জিয়ার পুত্র আরাফাত রহমান কোকোর পাচার করা টাকা। ‌এর বাইরে আর কোনো সরকারই পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে পারেনি। আসলে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনা অনেকটা জটিল বিষয়। এখানে শুধু দুদকের ওপর ছেড়ে দিলেই হবে না। এর সঙ্গে জড়িত জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), পুলিশের অপরাধী তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ)। ফলে প্রতিটি সংস্থাকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।

 

ড. ইফতেখার আরও বলেন, টাকা পাচার করা যেহেতু অপরাধ, সে কারণে আইনি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আদালতের নির্দেশনা থাকতে হবে। যেসব দেশে টাকা পাচার হয়েছে, সে দেশগুলোর সঙ্গে চুক্তি করতে হবে। ইতিমধ্যে কিছু চুক্তি হয়েছে। আরাফাত রহমান কোকোর পাচার করা টাকা ফেরত আনতে সময় লেগেছিল সাত বছর। এখন পতিত আওয়ামী লীগের আমলে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে সাত বছর লাগবে না তার বেশি সময় লাগবে সেটি বলা মুশকিল।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code