প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২১শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৬ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১লা রজব, ১৪৪৭ হিজরি

পাঁচ বছরে ৪৬ লাখ মামলার ‘গোলকধাঁধা’

editor
প্রকাশিত আগস্ট ২৫, ২০২৫, ০৮:৩১ পূর্বাহ্ণ
পাঁচ বছরে ৪৬ লাখ মামলার ‘গোলকধাঁধা’

Manual5 Ad Code

প্রজন্ম ডেস্ক:

Manual7 Ad Code

‘বেড়াজাল’ ও ‘গোলকধাঁধা’ এমন এক পরিস্থিতিকে বোঝায়, যেখানে কোনোভাবে ঢুকে গেলেও বের হওয়া খুব কঠিন। এসব পরিভাষা আইন ও বিচারাঙ্গনে উচ্চারিত হয় হামেশাই। ফৌজদারি, দেওয়ানি বা অন্য মামলার ক্ষেত্রে এসব শব্দ ব্যবহৃত হয়ে থাকে। বিচারাকাক্সক্ষী, আইনজীবী ও সংশ্লিষ্টদের অনেকেই মামলাকে এখন গোলকধাঁধা ও বেড়াজাল মনে করেন। মামলা হয়, বছরের পর বছর যায়, তারিখ পড়ে, বিচারাকাক্সক্ষীর অবর্ণনীয় দুর্ভোগ চলতেই থাকে। কিছু ব্যতিক্রম বাদে মামলার পক্ষভুক্তরা একপর্যায়ে আটকা পড়েন এ বেড়াজাল ও গোলকধাঁধায়।

২০০৭ সালের ১ নভেম্বর কাগজে-কলমে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক হয়। ওই সময় দেশের উচ্চ ও অধস্তন আদালতে বিচারাধীন বা অনিষ্পন্ন দেওয়ানি, ফৌজদারি মামলা ছিল ১৫ লাখ ৭০ হাজারের কিছু বেশি। অধস্তন আদালতগুলোতে বিচারাধীন ছিল প্রায় ১৩ লাখ মামলা। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভাগে বিচারাধীন ছিল আড়াই লাখের কিছু বেশি মামলা। প্রায় ১৭ বছর পর বিচারাধীন মামলা এখন প্রায় ৪৬ লাখ। অর্থাৎ মামলা বেড়েছে ৩১ লাখ।

প্রাপ্ত পরিসংখ্যান বলছে, প্রায় সাড়ে পাঁচ বছরে বিচারাধীন মামলা ৪০ লাখের নিচে নামেনি। মামলার সংখ্যা বাড়ার লক্ষণ দেখে বলা যায়, ২০২৬ সালের মধ্যে তা ৫০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে। আইন ও বিচার বিশ্লেষকরা তা-ই বলছেন। বাংলাদেশ কোড, লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ ও আইন কমিশনের তথ্যমতে, দেশে ১ হাজার ২০০-র কিছু বেশি দেওয়ানি, ফৌজদারি এবং অন্যান্য আইন রয়েছে। তবে ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, ভুক্তভোগীর প্রতিকার, মানবাধিকার, সমাজ ও রাষ্ট্রে শৃঙ্খলা নিশ্চিতে এসব আইনের প্রয়োগ বিষয়ে প্রশ্ন উঠছে কয়েক দশক ধরেই।

Manual7 Ad Code

বিচারাকাক্সক্ষীদের দুর্ভোগ লাঘবে, বিচার বিভাগের আধুনিকায়ন ও সংস্কার বিষয়ে অতীতে রাজনৈতিক সরকারগুলোর আন্তরিকতা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে সব মহলে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রধান বিচারপতি ও অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। কিন্তু বিচারাকাক্সক্ষীদের ভোগান্তি লাঘবে বিশেষ উদ্যোগ চোখে পড়ার মতো নয় বলে মনে করেন আইন ও বিচার বিশ্লেষকরা।

গত পাঁচ বছরের পরিস্থিতি : সুপ্রিম কোর্টের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারিতে উচ্চ ও অধস্তন আদালতে দেওয়ানি, ফৌজদারি ও অন্যান্য বিচারাধীন ৩৬ লাখ ৮৪ হাজার ৭২৮ মামলার সঙ্গে ওই বছর নতুন করে দায়ের হয় ১১ লাখ ১ হাজার ২৭১ মামলা। ৩ লাখ ৫২ হাজার ৩৩০ পুনর্জীবিত মামলাসহ ওই বছর মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ৫০ লাখ ৭২ হাজার ৩৪১। ওই বছর নিষ্পত্তি হয় ৭ লাখ ৩৯ হাজার ৫৬৩ মামলা।

২০২১ সালের দায়ের হয় ১২ লাখ ৯৩ হাজার ৪২০ মামলা। ওই বছর বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৪২ লাখ ৮ হাজার ৪২৮।

২০২২ সালে নতুন মামলা হয় ১৫ লাখ ৭১ হাজার ৬১৭টি। ওই বছর বিচারাধীন ছিল ৪১ লাখ ৯৬ হাজার ৬০৩টি মামলা।

২০২৩ সালে নতুন মামলা যুক্ত হয় ১৫ লাখ ৪২ হাজার ৫২১টি। ওই বছর বিচারাধীন মামলা ছিল ৪২ লাখ ৯৯ হাজার ৫৯৯টি।

২০২৪ সালে নতুন করে যুক্ত হয় ১৪ লাখ ৭৩ হাজার ৭৩টি মামলা। ওই বছর বিচারাধীন মামলা ছিল ৪২ লাখ ৯৯ হাজার ৫৯৯টি।

Manual1 Ad Code

পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২০ সাল থেকে ২০২৪-এর শেষ পর্যন্ত পাঁচ বছরে মামলা হয়েছে ৬৯ লাখ ৮১ হাজার ৯০২টি। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে মামলা হয়েছে ১৩ লাখ ৯৬ হাজার ৩৮০টি। এ সময়ে পুরনো ও নতুন মামলায় মিলিয়ে নিষ্পত্তি হয়েছে ৫৭ লাখ ৪৯ হাজার ৪৩০টি। গড় হিসাবে প্রতি বছর ৫০ থেকে ৬০ লাখ মামলার বিপরীতে ১১ লাখ ৪৯ হাজার ৮৮৬টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে।

কেন এ পরিস্থিতি : ধারাবাহিক প্রতিবেদনের অংশ হিসেবে এ প্রতিবেদক কর্মে থাকা ও অবসরে যাওয়া জেলা ও দায়রা জজ, অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ পদমর্যাদার ৫ জন বিচারক, উচ্চ ও অধস্তন আদালতে নিয়মিত দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা করেন এমন অন্তত ১৯ জন আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের ভাবনা আর চিন্তার সম্মিলিত পর্যবেক্ষণ হলো, ছোট আয়তনের দেশে মানুষ ক্রমেই বাড়ছে। জীবনের চাহিদা ও জটিলতা বাড়ছে। জমিজমা, আর্থিক, সামাজিক অবক্ষয়সহ নানা কারণে বাড়ছে অপরাধ প্রবণতা। এ ছাড়া আইন আদালতকে উপযুক্ত জায়গা মনে করা, কিছু মানুষের মধ্যে মামলার প্রবণতা বেড়ে যাওয়া, অনেক ক্ষেত্রে ভিন্ন বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মিথ্যা অভিযোগের মামলা, বিগত সময়ে বিচার বিভাগ নিয়ে রাজনৈতিক সরকারগুলোর আন্তরিকতার ঘাটতি, মামলার জট নিরসনে বাস্তবিক কোনো মহাপরিকল্পনা না হওয়া, পরিকল্পনা বা আইন প্রণয়নে আইন ও বিচারসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের না রাখা প্রভৃতি এর বড় কারণ। পাশাপাশি বিচারক স্বল্পতা, আধুনিক যুগে ব্রিটিশ আমলের পুরনো আইন, ঘন ঘন শুনানি মুলতবি, অবকাঠমো সংকট, অধস্তন ও উচ্চ আদালতে একটির পর একটি আইনি ধাপ, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বা এডিআরের কম প্রয়োগ এবং বিচারকাজে প্রযুক্তির ব্যবহারের ঘাটতি প্রভৃতি এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়।

Manual3 Ad Code

আগামী এক বা দুই দশকেও নেতিবাচক এ পরিস্থিতি থেকে রেহাই পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে মনে করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) সভাপতি অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। তিনি বলেন, ‘প্রধান বিচারপতি বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। সরকারের অনেক সিদ্ধান্তই আসছে। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে আইনের সংশোধনসহ কিছু সংস্কার হয়েছে। কিন্তু বিচারাকাক্সক্ষীদের দ্রুত ও ন্যায়বিচার নিয়ে তেমন কিছু করার নেই।’ তিনি বলেন, ‘সমস্যাটা কয়েক দশকের। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটা মহাপরিকল্পনার প্রয়োজন ছিল। কেন জট বাড়ে, প্রতিকার কী, কেন ধীরগতি, এসব চিহ্নিত করে সিদ্ধান্ত নেওয়া যেত।’ মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘যখন যে সরকার ক্ষমতায় আসে তারা বিরোধী মত ও পথের লোকদের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়। কিন্তু বিচারাঙ্গনে সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ। তাদের মামলার অগ্রগতি নিয়ে সরকারগুলোর কোনো মাথাব্যথা থাকে না।’

সার্বিক বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ শাহজাহান সাজু মনে করেন, ‘মামলা ব্যাপকহারে বাড়লেও বিচারক ও অবকাঠামো বাড়েনি। মামলার সংখ্যা অনুযায়ী তিন থেকে পাঁচ হাজার বিচারক প্রয়োজন। বিশেষ কোনো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাও নেওয়া হয়নি।’ তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ব্যতিক্রম কিছু না ঘটলে আগামী বছরের মধ্যে অনিষ্পন্ন মামলা ৫০ লাখ ছাড়িয়ে যাবে এবং এটি একটি অশনিসংকেত। বিলম্বিত বিচারের কারণে সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।’

শাহজাহান সাজু বলেন, ‘বিচার চাইতে যারা আদালতে আসেন তাদের বেশিরভাগই স্বল্প শিক্ষিত, গরিব কিংবা দরিদ্র শ্রেণির। অনেকে আইনের মারপ্যাঁচ বোঝেন না। শুধুই টাকা খরচ করেন। মামলা করতে গিয়ে দরিদ্র ও ঋণগ্রস্ত হন। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে পারিবারিক, সামাজিক ও জীবনের সবক্ষেত্রে।’

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual6 Ad Code