প্রজন্ম ডেস্ক:
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার পর মাঠ প্রশাসনে যোগ্য ও দক্ষ কর্মকর্তা পদায়ন ও প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে সরকার। ইতিমধ্যে ৭টি জেলায় নতুন ডিসি ও এসপি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনি তফসিলের আগেই বাকি জেলা ও সব উপজেলায় নতুন ডিসি ও ইউএনওদের নিয়োগ দেওয়া হবে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যেই নতুন ডিসিদের ফিটলিস্ট চূড়ান্ত করা হবে। এবার ডিসি নিয়োগে কোনো ধরনের রাজনৈতিক সুবিধাভোগী বা বিতর্কিত কর্মকর্তাকে সুযোগ দেওয়া হবে না। কেউ ছলচাতুরী বা তথ্য গোপন করে ডিসি পদে নিয়োগ পেলে এবং পরে তা প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতিতে প্রশাসন ক্যাডারের অনেক কর্মকর্তাই নির্বাচনি দায়িত্বে থাকতে অনিচ্ছুক হওয়ায় দক্ষ কর্মকর্তা পদায়ন ও প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরানোর বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, মাঠ প্রশাসন গোছানোর জন্য সরকারের পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে দক্ষ কর্মকর্তাদের ডিসি ও ইউএনও হিসেবে নিয়োগ ও তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। এর পরেই রয়েছে বাজেট বরাদ্দ। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রয়োজন হবে অতিরিক্ত বাজেট। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জেলা প্রশাসকদের অনুকূলে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, যা মাঠ পর্যায়ের বিভিন্ন কাজে ব্যয় করা হবে। পদক্ষেপের অংশ হিসেবে ১৮ আগস্ট সিলেটের নতুন জেলা প্রশাসক (ডিসি) নিয়োগ পেয়েছেন প্রশাসনের আলোচিত ম্যাজিস্ট্রেট মো. সারওয়ার আলম।
উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা সারওয়ার আলম প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলেন। এ ছাড়া ২৫ আগস্ট ৬ জেলায় নতুন ডিসি ও এসপি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নতুন ডিসি পেয়েছে—পটুয়াখালী, কুষ্টিয়া, কুড়িগ্রাম, মেহেরপুর, নেত্রকোনা ও খুলনা। ইতিমধ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে মাঠ প্রশাসনের কার্যক্রমের জন্য কিছু কিছু নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে, যা কেন্দ্র ও মাঠ প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয় করবে। যদিও এ নির্দেশনা সময়ভেদে পরিবর্তন করা হতে পারে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে ডিসি হিসেবে যারা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন এমন ২২ কর্মকর্তাকে ফেব্রুয়ারিতে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া ২০১৮ সালে রাতের ভোটের নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করা তৎকালীন ৩৩ ডিসিকে ওএসডি করা হয়েছে। একইভাবে যারা এসপির দায়িত্বে ছিলেন, তাদেরও বাধ্যতামূলক অবসর ও ওএসডি করা হয়েছে। পাশাপাশি বিগত তিনটি নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এসব কারণে এবার অনেক কর্মকর্তাই নির্বাচনকালে ডিসি, ইউএনও এবং এসপি হতে আগ্রহী হচ্ছেন না বলে জানা গেছে। তাই এবার অবাধ ভোট করতে সৎ, নিরপেক্ষ ও সাহসী কর্মকর্তা পদায়ন সরকারের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক কর্মকর্তা মনে করেন, নির্বাচনি দায়িত্ব পালনের পর সরকার পরিবর্তন হলেই ঢালাওভাবে ওএসডি বা বাধ্যতামূলক অবসরের মতো সিদ্ধান্তের মুখে পড়তে হয়। অথবা কম গুরুত্বপূর্ণ পদে বদলি করা হয়। পদোন্নতিতেও অসুবিধায় পড়তে হয়। ফলে অনেকেই নির্বাচনি দায়িত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে চান। তবে সরকারি সিদ্ধান্ত হলে দায়িত্ব পালন ছাড়া উপায়ও থাকে না। এ কারণে কর্মকর্তাদের মধ্যেও ভোট নিয়ে একটা আতঙ্ক কাজ করছে।
অবশ্য আগামী নির্বাচনে ডিসিরা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকবেন কি না, সেটি এখনও স্পষ্ট নয়। নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানায়নি। বর্তমান আইন অনুযায়ী, জাতীয় নির্বাচনে ডিসিরা রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। এরই মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটকেন্দ্র স্থাপনে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) প্রধান করে কমিটি করার বিধান বাদ দেওয়া হয়েছে।
এ সংশোধনী এনে সম্প্রতি ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র স্থাপন এবং ব্যবস্থাপনা নীতিমালা-২০২৫’ গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে ইসি। নীতিমালায় বলা হয়েছে, ইসির নিজস্ব কর্মকর্তারাই ভোটকেন্দ্র স্থাপন করবেন। আগেও ইসির কর্মকর্তারাই এ কাজটি করতেন। কিন্তু গত নির্বাচনে প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের এ কাজে যুক্ত করেছিল ইসি, যা নিয়ে সমালোচনা সৃষ্টি হয়। এবার সেই ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে ইসির কর্মকর্তাদের হাতে।
অন্যদিকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর প্রায় ১৩ মাস পার হতে চললেও প্রশাসনে মন্ত্রণালয়ে শৃঙ্খলা ফেরেনি। তবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গত বছরের ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রশাসনের বিভিন্ন পদমর্যাদার কিছু সরকারি কর্মকর্তা বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সমাবেশ, অবস্থান ধর্মঘট, মানববন্ধন, কলমবিরতিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) পুনর্গঠন ও বিভাজনের পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনে নামা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক পদক্ষেপও নিয়েছে সরকার।
এ ছাড়া প্রশাসনের অভ্যন্তরে দীর্ঘদিনের পদোন্নতি ও পদায়নের বৈষম্য দূর করতেও কাজ শুরু করেছে। গত ১৭ বছর ধরে রাজনৈতিক কারণে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের ইতিমধ্যে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে আন্তঃবৈষম্য নিরসনে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সচিবালয়ের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে ক্যাডার-নন ক্যাডার মিলিয়ে নতুন নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশনা দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এ ব্যাপারে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সিনিয়র সচিব ও সচিব এবং বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে চিঠি পাঠিয়ে মন্ত্রণালয় বলেছে, সতর্ক না হলে প্রয়োজনে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চিঠিতে বলা হয়, প্রজাতন্ত্রের দায়িত্বশীল সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে তাদের এ ধরনের কর্মকাণ্ড ও আচরণ বিধি লঙ্ঘনের শামিল। অনেক ক্ষেত্রে তা জাতীয় নিরাপত্তা হানিকারক এবং সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালা, ২০১৮ অনুযায়ী অসদাচরণের পর্যায়ভুক্ত অপরাধ।
নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন নিশ্চিত করতে আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে পুলিশ অধিদফতর, বিজিবি, আনসার ও কোস্ট গার্ডসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একইভাবে সব জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং ওসিকে নিরপেক্ষভাবে কাজ করার প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেবে জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে দুটি পৃথক প্রস্তুতিমূলক মহড়া পরিচালনা করতে বলা হয়েছে। নির্বাচনের আগে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা থেকে সতর্ক থাকা এবং নির্বাচন-পূর্ব ও নির্বাচনকালে সব সংস্থাকে একত্রে নিরপেক্ষভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান জানিয়েছেন, জেলা প্রশাসক পর্যায়ে পরিবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যখন যে জেলায় প্রয়োজন হবে সেখানে ডিসি নিয়োগ দেওয়া হবে। বিতর্কের সুযোগ এড়াতে খুব নিবিড়ভাবে ফিটলিস্ট তৈরি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে যাদের বিরুদ্ধে অতীতে কোনো অভিযোগ নেই তাদের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পেশাদার ও সর্বোচ্চ যোগ্য লোককে বাছাই করা হয়েছে। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচন একটা চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মেনে নিয়েই অনেক ধরনের যাচাই-বাছাই করে আগে যারা অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ছিল বা প্রো-অ্যাকটিভ ছিল, ওভার অ্যাকটিভ ছিল, তারা কেউই তালিকার মধ্যে নেই এবং থাকবেন না।
নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কোনো কর্মকর্তা কোনো ব্যক্তি বা দলের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করলে তাকে প্রত্যাহার করে প্রচলিত আইনের আওতায় এনে তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান জনপ্রশাসন সচিব। বুধবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি, ইউএনও নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত। এবার যদি কেউ কারও পক্ষে বা কোনো দলের পক্ষ নেয় তা হলে প্রত্যাহার করে প্রচলিত আইনের আওতায় এনে তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, সিভিল সার্ভিসের গত তিনটি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা, এখান থেকে তাদের জন্য শক্ত বার্তা। রিটার্নিং অফিসার কারা হচ্ছে সেটা নির্ধারিত হবে তফসিল ঘোষণার পর। তখন সরাসরি যে নির্দেশনা যাবে, এর বাইরে কোনো ডিসি কাজ করতে পারবেন না বা করবেন না। তিনি বলেন, প্রশাসনে স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করছে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সোমবার এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে জনগণের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান লক্ষ্য। নির্বাচন সুষ্ঠু করতে মাঠ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য শুধু নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি যথেষ্ট নয়, মাঠ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যথাযথ প্রস্তুতি নিতে হবে। জনগণ যেন নির্ভয়ে নির্বাচন কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে ভোট দিতে পারে সেরকম পরিবেশ তৈরি করতে প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে একযোগে কাজ করতে হবে। সবার সহযোগিতায় সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভবপর হবে।
Sharing is caring!