প্রজন্ম ডেস্ক:
পাসপোর্ট-ভিসা অন্যের। নাম-ঠিকানা বা ছবি- সবকিছুই অন্য একজনের। অথচ ইতালির ভিসাসংবলিত অন্যের সেই পাসপোর্ট ব্যবহার করেই উড়োজাহাজের দরজার কাছে প্রায় পৌঁছে যান তাজিমুর (২৮) নামে এক ব্যক্তি। বিমানবন্দরের কয়েক ধাপের যাচাই প্রক্রিয়া বা নিরাপত্তাচৌকি পেরিয়ে ফ্লাইটে ওঠার চেষ্টাকালে সর্বশেষ বোর্ডিং গেটে গিয়ে ধরা পড়েন তিনি।
গত ২৮ অক্টোবরের এই ঘটনায় বিমানবন্দরের সংশ্লিষ্টদের মাঝে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। কেবল এ ঘটনা নয়, সম্প্রতি এমন কিছু ভয়ানক-উদ্বেগজনক ঘটনা ঘটেছে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরসহ একাধিক বিমানবন্দরে।
গত ২ নভেম্বর শাহজালাল বিমানবন্দরে যুক্তরাজ্যের (ইউকে) ভুয়া ই-ভিসা দিয়ে চেক-ইন ও বোর্ডিং পাস নেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বিজি-২০৭ ফ্লাইটের মো. ফাহাদ হোসেন নামে এক যাত্রী। তিনি ভুয়া ভিসা দিয়েই ইমিগ্রেশনও সম্পন্ন করেন। কিন্তু আটকে যান উড়োজাহাজে ওঠার আগ মুহূর্তে বোর্ডিং গেটে। সংশ্লিষ্টরা তাকে আটক করে আইনগত পদক্ষেপ নেন। সর্বশেষ গত ৭ নভেম্বর রাতে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের একটি উড়ন্ত উড়োজাহাজে বসে ভয়ানক মাদক ‘এলএসডি’, সিরিঞ্জসহ ধরা পড়েন এক যাত্রী। ওই যাত্রী উড়োজাহাজের টয়লেটের ভেতর ২৫ মিনিটের বেশি সময় ধরে অবস্থান করছিলেন। সন্দেহজনক হলে দরজায় বারবার কড়া নাড়েন কেবিন ক্রুরা। অনেক পর যাত্রী খুললেও তখন তার বেসামাল অবস্থা। একপর্যায়ে কেবিন ক্রুদের ওপর চড়াও হন। কিছু সময় চলে ধস্তাধস্তি। এরই মধ্যে চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়ন করা বিমানের আন্তর্জাতিক ফ্লাইটটি (বিজি-৬১৮) ঢাকায় অবতরণ করে। পরে ভয়ানক মাদক এলএসডি, সিরিঞ্জসহ ওই যাত্রীকে বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বিভাগ আটক করে।
এসব ঘটনার বাইরেও সম্প্রতি বিমানবন্দরের ভেতর ভুয়া কাস্টমস কর্মকর্তা চক্রের বিচরণ, ডিউটিরত আনসার সদস্যের মোবাইল চুরি করে পালানোর চেষ্টাসহ একাধিক ঘটনা উঠে এসেছে গণমাধ্যমের খবরে। এতে প্রশ্ন উঠেছে, বিমানবন্দরের কয়েক ধাপের তল্লাশি ও নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে। কয়েক ধাপের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে যেখানে উড়োজাহাজের দরজায় পৌঁছাতে হয়, সেখানে কীভাবে এমন সব ঘটনা ঘটছে, তা নিয়েও সন্দেহ-সংশয় দেখা দিয়েছে সংশ্লিষ্টদের মাঝে।
এ প্রসঙ্গে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ ও বিমান পরিচালনা বোর্ডের সাবেক সদস্য কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, ‘আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের ক্ষেত্রে অন্তত তিনটি স্তরে যাচাই বা পরীক্ষার পর যাত্রীরা উড়োজাহাজে গিয়ে বসতে পারেন। যেমন- প্রথমে টিকিট ও পাসপোর্ট-ভিসা দেখে যাচাই করে বোর্ডিং পাস দিয়ে থাকেন উড়োজাহাজ সংস্থার কর্মীরা। দ্বিতীয় ধাপে ইমিগ্রেশনের সূক্ষ্ম ও প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবস্থা আরও নিখুঁতভাবে যাচাই করে থাকে। সর্বশেষ তৃতীয় ধাপে বোর্ডিং গেটে সব যাচাই করে ফ্লাইটে নেওয়া হয়। ফলে এগুলোর কোথাও অবহেলা, আঁতাত বা দুর্বলতা না থাকলে কারও পক্ষে এতগুলো স্তর পার করার সুযোগ নেই।’
কাজী ওয়াহিদুল আলম আরও বলেন, ‘অনেক দিন ধরেই নিরাপত্তা-জালের দুর্বলতা প্রকাশ পাচ্ছে। যেগুলো ধরা পড়ছে, সেগুলো হয়তো কোনোভাবে জানা যাচ্ছে। এগুলো হচ্ছে বলেই অনেক দেশ এখন বাংলাদেশিদের ভিসা দিচ্ছে না। অবৈধ অভিবাসন, নানা রকম প্রতারণা, মিথ্যা তথ্যসহ নানা কারণে বাংলাদেশের পৃথিবী ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে। এই অবৈধ অভিবাসন চক্রের কারণে একদিকে যেমন বৈধ অভিবাসীপ্রত্যাশীরা বিপদে পড়ছেন, তেমনি দেশের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে।’
তথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ২৮ অক্টোবর রিয়াজুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তির পাসপোর্ট ও ভিসা ব্যবহার করে তাজিমুর (২৮) নামে এক ব্যক্তি বিজি-৩৫৫ ফ্লাইটে ওঠার চেষ্টা করেন। অন্যের পাসপোর্ট-ভিসা দেখিয়েই ওই ব্যক্তি বিমানবন্দরে প্রবেশ, লাগেজ চেকিং এলাকা, বোর্ডিং পাস সংগ্রহ করেন। তবে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন না করেই বোর্ডিং গেটে চলে যান। সেখানে চেকিংয়ের সময় বিষয়টি ধরা পড়ে। অন্যের পাসপোর্ট তিনি কীভাবে পেলেন বা ইমিগ্রেশন সম্পন্ন না করেও কীভাবে তার পরের ধাপে পৌঁছালেন, তা নিয়ে ধূম্রজালের সৃষ্টি হয়। এ ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে ইমিগ্রেশনসহ কয়েক ধাপের নিরাপত্তা ও যাচাই প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বশীলতা বা ভূমিকা নিয়ে।
অন্যের পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে বিদেশযাত্রার চেষ্টাকারী তাজিমুর হবিগঞ্জের বানিয়াচং থানার লোহাজুরী গ্রামের রহমত আলীর ছেলে। আটকের পর তার বিরুদ্ধে বিমানবন্দর থানায় একটি মামলা করেন বিমানের নিরাপত্তাকর্মীরা। ওই মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও বিমানবন্দর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আবু সায়েম মো. আব্দুর রহমান বলেন, গ্রেপ্তার তাজিমুর জিজ্ঞাসাবাদে কীভাবে তিনি অন্যের পাসপোর্ট পেয়েছেন এবং তাকে সহায়তাকারীসহ দালালের বিষয়ে অনেক তথ্য দিয়েছেন। তদন্তের স্বার্থে এ বিষয়গুলো এখনই বিস্তারিত বলা যাচ্ছে না। তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই করে পরে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিমানবন্দরের অন্য একটি সূত্রে জানা যায়, গত ২ নভেম্বর বিমান বাংলাদেশের বিজি-২০৭ ফ্লাইটে মো. ফরহাদ হোসেন নামে যাত্রী যুক্তরাজ্যের ভুয়া ই-ভিসা নিয়ে বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনও সম্পন্ন করেছিলেন। এরপর তিনি সর্বশেষ বোর্ডিং গেটে গেলে কর্মরত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের কর্মকর্তাদের তল্লাশিতে ভুয়া ই-ভিসার বিষয়টি ধরা পড়ে। এ ঘটনায় সেদিনই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের কর্তব্যরত কর্মকর্তা ইমিগ্রেশন পুলিশ বরাবর একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি নম্বর-৯৩) করেন। এরপর ভুয়া ই-ভিসার তথ্যসহ যাত্রী ফরহাদ হোসেনকে ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়।
বিমানবন্দরের একধিক কর্মকর্তা জানান, যারা যুক্তরাজ্যের ই-ভিসা পান, তাদের ‘ইউকে ভিআর’ অ্যাকাউন্ট থাকে। ওই অ্যাকাউন্টে প্রবেশ করলে তাদের অবস্থা (স্ট্যাটাস) দেখা যায়। অথবা ইউকে ভিআর অ্যাকাউন্টে আগে থেকে লগ-ইন (প্রবেশ) করা থাকলে একটি শেয়ার কোড জেনারেট হয়, ওই কোড নাম্বার সেখানে প্রবেশ করালে ওয়েবসাইটে সব তথ্য দেখা যায়। যেমন- ভিসার সময়সীমা, ভিসা ইস্যু, মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখসহ পাসপোর্ট ও ভিসাগ্রহীতার যাবতীয় তথ্য দেখা যায়। কিন্তু যাদের ভিসা ভুয়া, তারা এটি দেখাতে পারেন না। অনেক সময় কেবল ‘কিউআর’ কোড তৈরি করে শুধু নাম ও ছবি প্রদর্শন করেই প্রতারকরা অপৎতপরতা চালিয়ে থাকে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) ইমিগ্রেশন শাখার অতিরিক্ত ডিআইজি মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘ভিন্ন কৌশলে দু-একটি ঘটনা ঘটতে পারে। তবে সাধারণত ইমিগ্রেশন চ্যানেল ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ নেই। তার পরও কোনো ঘটনা ঘটে থাকলে সেটার বিস্তারিত না জেনে মন্তব্য করা সম্ভব নয়। এগুলো জেনে পরে বলতে পারব।’ আসাদুজ্জামান আরও বলেন, ‘বোর্ডিং গেটেও আমাদের (ইমিগ্রেশন) লোকজন থাকে। ফলে কেউ কোনো প্রতারণা বা অপকৌশল চালিয়ে কিছু ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করলে অনেক সময় আমরা সেই গেট থেকেও আটক করে থাকি।’
সার্বিক বিষয়ে কথা বলতে গত শনিবার সন্ধ্যায় ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এস এম রাগিব সামাদকে একাধিকবার কল করলেও এবং খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।
Sharing is caring!