প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৯শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৪ঠা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৮শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ কঠিন

editor
প্রকাশিত নভেম্বর ১৯, ২০২৫, ০৩:১১ অপরাহ্ণ
শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ কঠিন

Manual5 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সাজাপ্রাপ্ত বন্দি হস্তান্তর বিষয়ে একটি চুক্তি আছে। সরকার এ চুক্তির আওতায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দ-প্রাপ্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফেরত চাইবে। সরকার মনে করছে, চুক্তি অনুযায়ী এমন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত বন্দিকে ফেরত দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিটি) থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাওয়ার পর কূটনৈতিক চ্যানেলে এ বিষয়ে ভারতকে অনুরোধ করা হবে।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সাজাপ্রাপ্ত বন্দি হস্তান্তরের চুক্তি থাকলেও ভারতের রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে বর্তমানে দেশটির রাজধানীতে সরকারি ব্যবস্থায় অবস্থানরত শেখ হাসিনাকে ফেরত আনা বাংলাদেশ সরকারের জন্য বেশ কঠিন হবে। ভারত এ ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপণ ও ফেরত না দেওয়ার অজুহাত হিসেবে চুক্তিতে থাকা ফাঁকফোকর কাজে লাগাতে পারে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘দুই দেশের প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর কথা ভারতের। কিন্তু এসব চুক্তিতে নানারকম ফাঁকফোকর রয়েছে বিশ্ব জুড়ে, যা গলিয়ে কোনো দেশের যদি সদিচ্ছা না থাকে, তাহলে তারা প্রত্যর্পণের এ অনুরোধ নাও রাখতে পারে।’

 

 

Manual6 Ad Code

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয়ে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে আশ্রয় নেন। সেখানে তার অবস্থানসহ দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয়কে কেন্দ্র করে দুই দেশের সম্পর্ক তিক্ততায় গড়িয়েছে। গত ডিসেম্বরে তাকে ফেরত চেয়ে বাংলাদেশ কূটনৈতিকপত্র দেয়। পত্র পাওয়ার কথা স্বীকার করলেও ভারত তাকে গত প্রায় এক বছরে ফেরত দেয়নি।

Manual1 Ad Code

সম্পর্কের এ টানাপড়েনের মধ্যে গত সোমবার ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) মূলত ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্ট মাসে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদন্ড দেয়। এরপর ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তাকে অবিলম্বে ফেরত দিতে ভারতের প্রতি আবারও আহ্বান জানায়। আইসিটির রায়ের পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছে, তাতে দিল্লিতে অবস্থানরত শেখ হাসিনাকে ফেরত দেওয়ার বিষয়ে কিছুই বলা নেই।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, এ বিষয়ে ভারতকে শিগগির কূটনৈতিকপত্র পাঠানো হবে।

অধ্যাপক মো. মাহবুবুর রহমান মনে করেন, হাসিনাকে ফেরত আনার বিষয়টি এখন শুধু আইনগত দিকে সীমিত নেই। এটি বরং কূটনৈতিক কৌশল ও আন্তর্জাতিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ কতটা কূটনৈতিক কৌশল প্রয়োগ করতে পারবে, সেটিই এখন দেখার বিষয়।

জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে সরকারি সংস্থা ও আওয়ামী লীগের নৃশংসতায় ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় কমপক্ষে ১ হাজার ৪০০ মানুষ নিহত হয়। এ সংস্থাটিসহ বিশ্বের অনেক দেশ ও মানবাধিকার সংস্থা মৃত্যুদ-ের বিপক্ষে। অধ্যাপক মাহবুব মনে করেন, এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিকভাবে শেখ হাসিনাকে ফেরত পাওয়ার বিষয়ে ভারতের ওপর কতটা চাপ তৈরি করতে পারবে, সেটিও এক ধরনের চ্যালেঞ্জ।

প্রত্যর্পণ চুক্তির ফাঁকফোকর : দুই দেশ অপরাধ দমন, তথ্য বিনিময় ও আইন প্রয়োগে পারস্পরিক সহযোগিতা জোরদার করা ও অপরাধীদের পালিয়ে যাওয়া প্রতিরোধ করার জন্য ২০১৩ সালে প্রত্যর্পণ চুক্তি সই করে। পরে তা সংশোধন করা হয় ২০১৬ সালে।

সই হওয়া চুক্তি অনুযায়ী, শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ সম্পর্কিত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারায় বলা আছে, যাকে হস্তান্তরের জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে, তার বিরুদ্ধে ‘রাজনৈতিক অভিযোগ’ হলে সেই অনুরোধ খারিজ করা যাবে। তবে একই সঙ্গে যদি দন্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তি হত্যা, গুম, বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো ও সন্ত্রাসবাদের মতো অপরাধের জন্য দায়ী হন, তাহলে রাজনৈতিক বিষয়টি এখানে গুরুত্ব পাবে না।

শেখ হাসিনাকে দায়ী করে আইসিটি মৃত্যুদন্ডের যে রায় দিয়েছে, তাতে হত্যা, গণহত্যা, গুম ও নির্যাতনসহ নানা অভিযোগ প্রমাণিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, চুক্তির ওই ধারা অনুযায়ী শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে ভারতের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ফলে এ রায়কে ‘রাজনৈতিক’ আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের অনুরোধ উড়িয়ে দেওয়ার আইনগত সুযোগ ভারতের নেই।

২০১৬ সালে চুক্তিটি সংশোধনের পর প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়া সহজ হয়। ২০১৩ সালের চুক্তিতে কোনো ব্যক্তিকে দোষী প্রমাণের যাবতীয় কাগজপত্র দেওয়ার বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু সংশোধিত চুক্তির ১০(৩) ধারায় বলা আছে, কোনো অভিযুক্তের হস্তান্তর চাওয়ার সময় অনুরোধকারী দেশকে সেসব অভিযোগের পক্ষে কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ পেশ না করলেও চলবে। শুধু সংশ্লিষ্ট আদালতের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পেশ করলেই সেটিকে বৈধ অনুরোধ হিসেবে ধরা হবে।

এরপরও অনুরোধ-প্রাপক দেশেও যদি ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো ‘প্রত্যর্পণযোগ্য অপরাধে’র মামলা চলে, তাহলে সেটা দেখিয়ে অন্য দেশের অনুরোধ খারিজ করার সুযোগ রয়েছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, বর্তমানে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ভারতে কোনো মামলা না থাকায় এ শর্তটি তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না। অর্থাৎ, প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে এমন যতগুলো ধারা বা শর্ত রয়েছে, তার একটি ছাড়া সবই এখন বাংলাদেশের পক্ষে রয়েছে। এ ক্ষেত্রেও হাসিনাকে বাংলাদেশে ফেরত দেওয়ার জন্য ভারতের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।

Manual8 Ad Code

তবে ভারত শেখ হাসিনাকে ফেরত দিতে যদি না চায়, তাহলে চুক্তির একটি ধারা ‘ব্যবহার’ করার সুযোগ আছে। ধারাটি হলো যদি অনুরোধ-প্রাপক দেশের মনে হয় ‘অভিযোগগুলো শুধু ন্যায়বিচারের স্বার্থে, সরল বিশ্বাসে আনা হয়নি,’ তাহলে দেশটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে প্রত্যর্পণের অনুরোধ নাকচ করার সুযোগ নিতে পারে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারত যদি শেখ হাসিনাকে ফেরত দিতে না চায়, তাহলে এই একটিমাত্র ধারার দোহাই দিয়ে বলতে পারে শেখ হাসিনা ‘প্রতিহিংসার শিকার’ হয়েছেন এবং বাংলাদেশে যে বিচার প্রক্রিয়া, তা সঠিক ও সুষ্ঠু হয়েছে বলে তারা মনে করছে না। আর সে কারণে তাকে হস্তান্তর করা সম্ভব নয়।

বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানিম হোসেন শাওন বলেন, বিশ^ জুড়েই দ্বিপক্ষীয় এ ধরনের চুক্তিতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর নিজস্ব কিছু ব্যাপার বা ফাঁকফোকর থাকে। যেটি নির্ভর করে দুই দেশের রাজনৈতিক সম্পর্কের ওপর। চুক্তি থাকলেও এমন ক্ষেত্রে এক দেশ আরেক দেশকে বাধ্য করতে পারে না। তিনি বলেন, শেখ হাসিনাকে ফেরত আনার বিষয়টি পুরোপুরি ভারতের সদিচ্ছার ওপর ওপর নির্ভর করছে।

তানিম হোসেন শাওন বলেন, ভারত এখন বাংলাদেশের সঙ্গে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক হিসাব করবে। সেখানে ভারত যদি দেখে এ প্রত্যর্পণে ভবিষ্যতে তারা লাভবান হবে, তবে তারা বাংলাদেশের অনুরোধ বিবেচনা করলেও করতে পারে। আর যদি দেখে তাদের লাভ হয় না, তাহলে এ অনুরোধ না রক্ষা করে কালক্ষেপণসহ নানা কৌশল অবলম্বন করতে পারে; এমনকি প্রত্যর্পণের অনুরোধ নাকচও করে দিতে পারে।

 

স্থানীয় বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনাকে ফেরত না দিলে ভারতকে বলতে হবে যে কেন তারা তাকে বাংলাদেশে পাঠাবে না। তা না হলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো ভারতকে দোষীদের আশ্রয়দাতা হিসেবে সমালোচনা করতে পারে।

দুই দেশের বিশ্লেষকরা মনে করেন, শেখ হাসিনার মৃত্যুদ-ের রায় ও তাকে প্রত্যর্পণের বিষয়টি শুধু একটি আইনগত ইস্যু নয়। এটি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এক বড় কূটনৈতিক পরীক্ষাও। ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও অন্য সীমান্তবর্তী রাজ্যেও এর প্রভাব পড়তে পারে।

বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী আলজাজিরাকে বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদকালে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের টানাপড়েন থেকেই যাবে। তারা বারবার বলতে থাকবে, ভারত হাসিনাকে ফেরত দিচ্ছে না।

Manual5 Ad Code

তিনি মনে করেন, আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নতুন সূচনা হতে পারে। যদিও নির্বাচনে হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। বিএনপিসহ অন্য বড় রাজনৈতিক শক্তিও ভারতের সমালোচক। তবু নির্বাচিত নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করাটা ভারতের জন্য স্বস্তির হবে।

ভারতের ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বলেন, হাসিনার বিষয়ে ভারত জটিলতার মধ্যে পড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের ভারতের প্রতি ক্ষোভকে তারা উপেক্ষা করতে পারে না। তিনি বলেন, স্বাভাবিকভাবেই নয়াদিল্লি চাইবে, ভবিষ্যতে কোনো না কোনোভাবে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় ফিরুক। হাসিনা ভারতের জন্য সবসময়ই সর্বোত্তম পছন্দ। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ভারতকে মানতে হবে, বাংলাদেশে হাসিনাকে আর কখনো সুযোগ দেওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এর পরিবর্তে ভারতের উচিত, ঢাকার অন্য রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual2 Ad Code