প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১১ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৬শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২০শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

বিএনপি-জামায়াত তিক্ততা: নির্বাচনি কৌশল নাকি নৈতিক দ্বন্দ্ব

editor
প্রকাশিত ডিসেম্বর ১১, ২০২৫, ১২:৫৪ অপরাহ্ণ
বিএনপি-জামায়াত তিক্ততা: নির্বাচনি কৌশল নাকি নৈতিক দ্বন্দ্ব

Manual5 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে তিক্ততা তীব্র হচ্ছে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে। পুরোনো দুই মিত্র একে অপরের বিরুদ্ধে লাগাতার বক্তব্য দিচ্ছে। যেটা নিয়ে তৈরি হচ্ছে আলোচনা-সমালোচনা। এর আঁচ পড়ছে তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যেও।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই দ্বন্দ্বের মূলে রয়েছে নির্বাচনি কৌশল ও রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘এটা এক ধরনের রাজনৈতিক প্রচারণা আগামী নির্বাচন ঘিরে। সেখানে পরস্পর পরস্পরের শত্রু। আমাদের বুঝতে হবে যে এটা কিন্তু একটা কম্পিটিশন এবং সেখানে তারা পরস্পর পরস্পরের শত্রু। পরস্পর পরস্পরকে ঘায়েল করার চেষ্টা করছে। এটাই স্বাভাবিক।’

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলতাফ পারভেজ বলেন, ‘নির্বাচন এখন এক ধরনের যুদ্ধের মতো। এবারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছে বিএনপি ও জামায়াত। যেহেতু বিএনপি-আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই, তাই এবার বিএনপি জামায়াতকে মোকাবিলা করতে বাধ্য। ফলস্বরূপ, উভয় দলই একে অপরের দুর্বল দিক লক্ষ্য করে আঘাত করার চেষ্টা করছে।’

‘এর মাধ্যমে ভোটে জনগণকে দুই ধারায় বিভক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ভোটের মাঠে এমন ট্যাগিং ও বিভাজন দেখা যায়। এগুলো আরও বাড়তে পারে।’

তবে এটা কতটুকু নীতিগত আর কতটুকু কৌশল সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।

আলতাফ পারভেজ বলেন, ‘নীতিগতভাবে হলে ভালো, সেক্ষেত্রে তাদের আত্মসমালোচনা করতে হবে, যে অতীতে এই দলকে বিকশিত হওয়ার ক্ষেত্রে তারা ভূমিকা রেখেছে। আর কৌশলগত হলে, সেটা দুর্ভাগ্যজনক। আমার মনে হয়, এটা অনেকখানি কৌশলগত অবস্থান।’

 

এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, ‘জামায়াতের ইতিহাসের দিকে তারেক রহমান ইতোমধ্যে ইঙ্গিত দিয়েছেন। অথচ সে ইতিহাস জেনেই বিএনপি জামায়াতকে জোটে নিয়েছিল এবং মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীসহ দুজন জামায়াত নেতার মন্ত্রিসভায় জায়গা হয়েছিল।’

তিনি বলেন, ‘জামায়াতও বিএনপির সমালোচনা করছে, তাদের চাঁদাবাজ বলছে, অথচ বিএনপি দুর্নীতিগ্রস্ত জেনেই তো তারা দলটির ছায়াতলে ছিল, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে মন্ত্রিসভায়ও জায়গা নিয়েছিল।’

 

ফলে এই দুই দল যে সমালোচনা করছে তা নীতিগত হলে উভয়েরই আত্মসমালোচনা আগে করা উচিত বলে মন্তব্য করেন তিনি।

 

ড. সাব্বির উল্লেখ করেন, ‘বহুদিন ধরে বিএনপির ছায়াতলে জামায়াত রাজনীতি করে আসছিল। জামায়াতের রিহ্যাবিলিটেশন বাংলাদেশিরা রাজনীতিতে বিএনপির হাত ধরে। বিএনপি মনে করে যে জামায়াত সব সময় তাদের সঙ্গে থাকবে।’

“এদিকে জামায়াত সম্ভবত এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে নিজের রাজনীতি করার চেষ্টা করছে। এটা দোষের কিছু নয়। এটা তারা করতেই পারে। মানে, বিএনপির প্রভাব মুক্ত হয়ে তারা আলাদাভাবে রাজনীতিটা করতে চেষ্টা করছে। তখন সম্ভবত বিএনপি এটা সহজভাবে নিতে পারছে না। কারণ ইতোমধ্যে জামায়াত তৃণমূল পর্যায়েও অনেক শক্তিশালী হয়ে গেছে। বিভিন্ন আসনে বিএনপির শক্ত প্রতিদ্বন্দী জামায়াত। সুতরাং, এটাও একটা কারণ যে কারণে ‘বিএনপি জামায়াতকে ঘায়েল করবেই’ তার দুর্বল পয়েন্টে,” মনে করেন তিনি।

‘তবে এটা এমন হবে না যে এটা একেবারে বাদ বিচার না করে, এটা এমন জায়গায় যাবে না যা পরস্পর পরস্পরকে একদম উৎখাত করার চেষ্টা করবে। এ ধরনের একটা ভায়োলেন্ট টার্ন নেবে না,’ বলেন ড. সাব্বির।

বিএনপি-জামায়াতের চলমান রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপট

সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী পারস্পরিক সমালোচনা ও ইঙ্গিতপূর্ণ বক্তব্যের মাধ্যমে নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান প্রকাশ করছে। জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান সিলেটে অনুষ্ঠিত আট দলের বিভাগীয় সমাবেশে অভিযোগ করেন, একদল দখলদারত্ব ও চাঁদাবাজিতে লিপ্ত হয়ে জনগণের আস্থা হারিয়েছে, আরেক দলও একই পথে এগোচ্ছে।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মন্তব্যটি মূলত আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে করা।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জামায়াতের অতীত কর্মকাণ্ডের উদাহরণ টেনে গত শনিবার এক অনলাইন বক্তৃতায় বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা দেশের স্বার্থের বিপরীতে কাজ করে অসংখ্য মানুষের জীবননাশ করেছিল। তিনি সম্প্রতি বিএনপিকে লক্ষ্য করে জামায়াতের করা দুর্নীতির অভিযোগকেও অযৌক্তিক উল্লেখ করেন।

 

দুই দলের শীর্ষ নেতাদের বাহাস এই দুজনেই সীমাবদ্ধ নেই। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর গত ১১ নভেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ে এক বক্তৃতায় বলেন, ‘জামায়াতের টিকিট কাটলেই কি কেউ বেহেশতে যেতে পারবে? যারা এসব মুনাফেকি করে, তাদের কাছ থেকে আমাদের সাবধান থাকতে হবে।’

এরপর ২০ নভেম্বর খুলনায় এক অনুষ্ঠানে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘বিএনপি এখন আওয়ামী লীগের ভাষায় কথা বলছে। তারা বর্তমানে মাহফিলে বাধা দেয়, মা–বোনদের তালিম প্রোগ্রামে বাধা দেয়। এটি করে তারা জামায়াতকে নয়, মূলত ইসলামকে বাধাগ্রস্ত করছে।’

Manual3 Ad Code

দুই দলের মধ্যে বিরোধ নতুন নয়। স্বাধীনতার পর জামায়াত রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হয় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের শাসনামলে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পরও বিএনপি সরকার গঠন করেছিল জামায়াতের সমর্থনে। ২০০১ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি সরকারের অংশ হিসেবে জামায়াতের সংসদ সদস্যরা মন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করেন। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগ সরকারের সময় দুই দলের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয় এবং জোট ভেঙে যায়।

 

বর্তমানে দুই দলের মতবিরোধ আরও প্রকট। ২০২৪ সালের আগস্টে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করে নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণা করলে জামায়াত অসন্তোষ প্রকাশ করে। এছাড়া নির্বাচন পদ্ধতি ও সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে দুই দলের অবস্থান প্রায়শই ভিন্ন।

Manual8 Ad Code

এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির বিরুদ্ধে জামায়াত চাঁদাবাজি, দখল ও দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে। বিএনপি পাল্টা আক্রমণে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস উল্লেখ করে সমালোচনা করছে। কয়েকটি এলাকায় এই উত্তেজনা সাময়িক সংঘর্ষেও রূপ নিয়েছে।

Manual1 Ad Code

 

‘মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মকে ভোট কৌশল হিসেবে ব্যবহার’

আসন্ন নির্বাচন সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধ ও ধর্মকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, মুক্তিযুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের অবদান অনস্বীকার্য হলেও স্বাধীনতা সংগ্রাম কেবল এক দলেই সীমাবদ্ধ ছিল না, এটি পুরো জাতির গণযুদ্ধে রূপ নিয়েছিল। তাই এটি কোনো দলের একার সম্পদ নয়।

Manual5 Ad Code

তবে দীর্ঘ সময় ধরে আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করেছে। এবার যখন বিএনপি একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের ভূমিকার বিষয়টি স্মরণ করাচ্ছে, তখন প্রশ্ন উঠছে, এটি কি কেবল ইতিহাসকে তুলে ধরা, নাকি নির্বাচনি কৌশল হিসেবে মুক্তিযুদ্ধকে ব্যবহার করার প্রয়াস?

রাজনীতি বিশ্লেষক ড. সাব্বির এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘এটি অস্বাভাবিক নয় এবং মুক্তিযুদ্ধের কথা বলা এটাও তো তাদের ভোট নেওয়ার একটা স্ট্র্যাটেজি হতে পারে। এটা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না যে তারা আওয়ামী লীগের ভোট নিতে চাচ্ছে। এই চেষ্টা সবাই করবে। তারা করবে কেন? জামায়াতও করছে। জাতীয় পার্টিও করবে, যদি তারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। খুবই একটা পরিচিত কৌশল।’

আলতাফ পারভেজ অবশ্য মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ধর্মকেও যোগ করেন। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের গৌরবের জায়গা, আত্মবিশ্বাসের জায়গা, বড় অর্জনের জায়গা। বাংলাদেশের অস্তিত্ব আর মুক্তিযুদ্ধ একাকার হয়ে গেছে। কিন্তু বিগত সময়ে যেটা হয়েছে, সেটা হলো মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ব্যাপক ব্যবসা হয়েছে।’

আলতাফ পারভেজেরে মতে, ‘আরেকটা বিষয় হলো ধর্ম। আমাদের এখানে ৯০ শতাংশ মানুষের ধর্ম ইসলাম, ১০ শতাংশ মানুষের ধর্ম হিন্দু বা অমুসলিম। বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান কিছু আছে। ধর্মবিশ্বাসের ব্যাপার থাকার কথা। কিন্তু ধর্ম নিয়েও এখানে রাজনৈতিক ব্যবসা-বাণিজ্য হয়েছে।’

তিনি ইতিহাসের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, ‘১৯৪৭-এ পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে। তখন জামায়াত পাকিস্তান আন্দোলনের চরম বিপক্ষে ছিল, মুসলিম লীগের এমনকি জিন্নাহরও বিপক্ষে। সেটাও ধর্মের নামে ব্যবহার করেছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও তারা ধর্ম ব্যবহার করেছে। অন্যদিকে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা একজন বড় মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডার, তবে মুক্তিযুদ্ধের ব্যবসাটা ওরা ভালো করে করেনি। এটা একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা।’

মুক্তিযুদ্ধকে ভোটের কৌশল হিসেবে ব্যবহার না করে এটাকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রাখাকে শ্রেয় মনে করেন আলতাফ পারভেজ। তাছাড়া ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা, ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের, ১৯৯০ ও ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের চেতনারও পরিপন্থি বলে মন্তব্য করেন তিনি।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual5 Ad Code