প্রজন্ম ডেস্ক:
নির্বাচন কমিশনের তফসিল ঘোষণার ২৪ ঘণ্টা পার হওয়ার আগেই ঢাকা-৮ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান বিন হাদি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। মোটরসাইকেলে এসে প্রকাশ্যে তাকে গুলি করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে আছেন এই জুলাইযোদ্ধা। নির্বাচনী প্রচারণায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে উদ্বেগ-আতঙ্ক বিরাজ করছে। তফসিলের একদিনের মাথায় এ ধরনের ঘটনায় উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে ভোটের মাঠে। রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারাও উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন- এই ঘটনা নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশের জন্য এলার্মিং। প্রধান উপদেষ্টাও হামলাকারীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও অপরাধীদের ধরতে তৎপরতা শুরু করেছেন। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলেছেন- এটি এলার্মিং এবং সারা দেশের প্রার্থীদের মধ্যে নেতিবাচক বার্তা যাবে। তাই সরকারকে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত ও প্রার্থীদের নিরাপত্তার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
এর আগেও প্রার্থীদের ওপর গুলির ঘটনা ঘটেছে। গত ৫ই নভেম্বর নির্বাচনী জনসংযোগে চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী ও চান্দগাঁও) আসনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ও চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপি’র আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ গুলিবিদ্ধ হন। এ ঘটনায় সরোয়ার হোসেন নামের এক সন্ত্রাসী নিহত হয়েছেন।
পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র এআইজি (মিডিয়া) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন বলেন, এ ধরনের ক্ষেত্রে কোনো প্রার্থী যদি নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন তবে সংশ্লিষ্ট থানায় বললে তাকে নিরাপত্তা দেয়া হবে। এ ছাড়া প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের কিছু নির্দেশনা দেয়া আছে। সেভাবেই দেশব্যাপী নিরাপত্তা ব্যবস্থা সাজানো হচ্ছে। ঢাকা-৮ আসনে যে ঘটনা ঘটেছে সেটি নিয়ে ইতিমধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশ কাজ শুরু করেছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দীর্ঘদিন পর অনেকটা ভিন্ন পরিবেশে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। যেখানে ভোটের মাঠে প্রায় সব দল অংশগ্রহণ করছে। এজন্য প্রতিটি আসনে প্রার্থীদের একাধিক প্রতিদ্বন্দ্বী রয়েছেন। তাই নির্বাচনে জয়-পরাজয় খুব সহজে নিশ্চিত হবে না বলে প্রার্থীরা মনে করছেন। তাই আগে থেকেই প্রার্থীরা নিজের অবস্থান জানান দেয়া, প্রচারণা ও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের কৌশলী মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনে যুগ যুগ ধরে প্রার্থীরা তাদের পেশিশক্তির প্রদর্শন করে থাকেন। নিজেদের শক্তি সামর্থ্যের জানান দিতে গিয়ে অনেক ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম দেন। এবারের নির্বাচনে সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা শঙ্কা তৈরি করেছে গণ-অভুত্থ্যানের পর থানা ও ফাঁড়ি থেকে লুট হওয়া পুলিশের অস্ত্র। এসব অস্ত্র এখন রাজনৈতিক নেতাকর্মী থেকে শুরু করে দাগি, জেল পলাতক ও শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কাছে। এ ছাড়া গণ-অভ্যুত্থানের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দুর্বলতা অরক্ষিত সীমান্ত দিয়ে দেদারছে দেশে অবৈধ অস্ত্র প্রবেশ করেছে। জুলাই আন্দোলনে দেশের কারাগার ভেঙে শীর্ষ সন্ত্রাসী, জঙ্গি, চরমপন্থিসহ বিভিন্ন বড় অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীরা পালিয়েছে। তাদের অনেককে এখনো আটক করা যায়নি। পাশাপাশি জামিনেও অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী বের হয়ে তাদের পুরনো রাজত্ব ফিরে পেয়েছেন। কেউবা ফিরে পাওয়ার লড়াই করছেন। এক্ষেত্রে তারা বড় রাজনৈতিক দলের নেতাদের ছায়াতলে কাজ করছেন। ইতিমধ্যে বিভিন্ন ইস্যুতে সন্ত্রাসীরা তাদের অবস্থান জানান দিয়েছে। ঢাকার আদালত চত্বরে এক সন্ত্রাসীর নির্দেশে আরেক সন্ত্রাসীকে গুলি করে হত্যাসহ একাধিক খুনখারাবির ঘটনা ঘটেছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচনে শীর্ষ ও দাগী সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন প্রার্থীর হয়ে প্রভাব বিস্তার করবে। অনেক প্রার্থী সন্ত্রাসীদের লালন করছেন। সুযোগমতো তাদের কাজে লাগানো হবে। এ ছাড়া অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি থাকায় নির্বাচনী প্রচারণায় প্রার্থীদের নিরাপত্তা শঙ্কায় ভোগাবে। তাই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে শুধু মৌখিক নয় কঠোর পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, এই ঘটনা থেকে সতর্ক হয়ে যেতে হবে। ঢাকার মতো শহরে যেখানে নিরাপত্তা চাদর থাকে, যেখানে এত এত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য কাজ করে- সেখানে যদি প্রার্থীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন তবে সেটি স্বাভাবিক না। দেশের অন্যান্য স্থানে এত নিরাপত্তা থাকে না। সেখানে কি হতে পারে সেটি অনুমান করা যায়। তিনি বলেন, প্রার্থীরা নিজেরাই নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ পুলিশ তো সবসময় তাকে পাহারা দিয়ে রাখবে না। কোনো প্রার্থীর যদি নিরাপত্তা হুমকি থাকে তবে সেটি থানায় জানিয়ে রাখবে আর সাবধানে চলাফেলা করতে হবে। প্রতিপক্ষ কি আচরণ করছে সেটিও খেয়াল রাখতে হবে। প্রচারণায় নামার আগে কোন এলাকায় যাবে সেই এলাকা সম্পর্কে আগেভাগে জেনে মাঠে নামতে হবে। তিনি বলেন, সরকারকেও পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ ইতিমধ্যে ঘটনা ঘটা শুরু হইছে। এরকম যদি আরও ঘটনা ঘটে তবে নির্বাচনের পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাবে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক বলেন, তফসিল ঘোষণার পরপরই সম্ভাব্য প্রার্থী গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনার মধ্যদিয়ে অন্য প্রার্থীদের মধ্যে আতঙ্কের একটা মেসেজ যাবে। অনেকদিন ধরে কিছু চ্যালেঞ্জের কথা বলা হচ্ছে। তার মধ্যে অপরাধী ও সন্ত্রাসীদের হাতে অবৈধ অস্ত্র রয়েছে। কারাগার ভেঙে ও জামিনে অনেক অপরাধী বাইরে বের হয়েছে। এ ছাড়া এমন অভিযোগও আছে একটি গোষ্ঠী অপরাধী তৈরি করছে নির্বাচনে অস্থিরতা করার জন্য। তিনি বলেন, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া দরকার সেগুলো আমরা দ্রুততার সঙ্গে দেখছি না। যদি দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া না হয় তবে যারা নির্বাচন প্রতিহত করার চেষ্টা করছে তারা সেটি করবে। কোথাও বোমা বিস্ফোরণ করবে, কোথাও ককটেল ছুড়বে। এসব ক্ষেত্রে শুধু মৌখিক নির্দেশনায় হবে না। প্রার্থী ও জনগণ বাস্তবায়ন দেখতে চায়। অপরাধী যে দলেরই হোক বা যত বড় অপরাধী হোক তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। এই ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। সবাই একটি ভালো নির্বাচন চায়। কিন্তু একটি ভালো নির্বাচন করার জন্য যে পূর্বশর্ত থাকে সেগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়ে আছি। তিনি বলেন, এই ঘটনা অন্যান্য প্রার্থীদের জন্য উদ্বেগ ও আতঙ্কের হবে। চট্টগ্রামের এক প্রার্থী জনসংযোগে নেমেই গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। ওই ঘটনার পর নির্বাচনী প্রচারণা কিছুদিনের জন্য থেমে গিয়েছিল। কারণ এটি অন্য প্রার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল। হাদির ঘটনায় প্রার্থীদের মধ্যে আরও বেশি আতঙ্ক কাজ করবে।
মানবাধিকার কর্মী নুর খান লিটন বলেন, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার একদিন পার না হতেই একজন সম্ভাব্য প্রার্থীকে গুলি করা স্বাভাবিক কোনো খবর না। এ ঘটনা মানুষের মধ্যে এক ধরনের আশঙ্কা জন্ম দিতে পারে। প্রার্থীরাও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেন। নিজেদের নিরাপদ নাও ভাবতে পারেন। কিছুদিন আগে চট্টগ্রামেও প্রার্থীর ওপর গুলির ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়াও সারা দেশে বিচ্ছিন্নভাবে গুলি করে হত্যার ঘটনাও আমরা দেখেছি। তিনি বলেন, সবকিছুই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। নির্বাচনের সময় সম্ভাব্য প্রার্থীর ওপর গুলির ঘটনা ছোট করে দেখার কিছু নাই। এটি আইনশৃঙ্খলার দুর্বলতার দিক প্রকাশ করে। সরকারের উচিত এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য কঠোর ব্যবস্থা নেয়া। যদি এসব বহমান থাকে তবে আগামী নির্বাচন অনেকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং দেশ সংকটের মধ্যে পড়বে।
Sharing is caring!