প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৪ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৩শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

বিমানের ভাড়া: ডলারে ‘মধু’, টাকায় ‘টালবাহানা’

editor
প্রকাশিত নভেম্বর ২৩, ২০২৪, ০৯:১৫ পূর্বাহ্ণ
বিমানের ভাড়া: ডলারে ‘মধু’, টাকায় ‘টালবাহানা’

Manual4 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

• মন্ত্রণালয় ও বেবিচকের নির্দেশনা মানছে না বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স

• ডলারের বিনিময় হারেও বেশি টাকা নিচ্ছে বলে অভিযোগ

 

বিশ্বের প্রায় সব দেশে স্থানীয় মুদ্রায় উড়োজাহাজের ভাড়া নির্ধারণ হয়। এতে যাত্রীরা সব সময় তুলনামূলক কম ভাড়ায় চলাচল করতে পারেন। পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রেও তাই। ডলারের দাম বাড়া বা কমা টিকিটের দামে কোনো প্রভাব ফেলে না। কিন্তু বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স দীর্ঘদিন ডলারে টিকিটের দাম নির্ধারণ করে চলেছে। এতে গত চার বছরে টিকিটের গড় দাম বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ।

 

চার বছর আগে ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় হার (১ ডলার) ছিল ৮০ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ১২০ টাকা। ডলারের বিপরীতে টাকার এই ওঠা-নামায় ভাড়া বৈষম্যের শিকার বিমানের সেবা গ্রহণকারীরা।

 

এই বৈষম্য দূর করতে এক বছরের বেশি সময় আগে বিমানকে নির্দেশনা দিয়েছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। তারপরও ডলারের পরিবর্তে টাকায় ভাড়া নির্ধারণে টালবাহানা করছে বিমান। অভিযোগ আছে, উল্টো সরকার নির্ধারিত ডলারের বিনিময় হারের চেয়ে বেশি টাকা নিচ্ছে সংস্থাটি।

 

 

Manual8 Ad Code

ডলারে ভাড়া নির্ধারণে যত বিপত্তি

 

ঢাকার শাহজাদপুরে ট্রাভেল এক্সপার্ট অ্যাভিয়েশন সার্ভিসেসের স্বত্বাধিকারী আলমগীর হোসেন বলেন, ২০২০ ও ২০২১ সাল পর্যন্ত ঢাকা থেকে মালয়েশিয়া যাওয়া-আসার ভাড়া ছিল ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার মধ্যে। এখন একই রুটের সর্বনিম্ন ভাড়া ৪১ হাজার টাকা। দুই বছর আগে থাইল্যান্ডের ভাড়া ছিল ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। এখন এই রুটের ভাড়া ৩০ থেকে ৩২ হাজার টাকা। ভারতের কলকাতার ভাড়া ছিল ৬ হাজার টাকা, এখন তা সর্বনিম্ন ৯ হাজার ২০০ টাকা। এ ভাড়া বাড়ার প্রধান কারণ ডলারের সঙ্গে টাকার বিনিময় হার।

Manual5 Ad Code

তিনি বলেন, এয়ারলাইন্সগুলো সাধারণত ভাড়া বাড়ায় না। যেমন এখন যদি কোনো ব্যক্তি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ঢাকায় আসার টিকিট কাটেন তখন তিনি ৮০ টাকা হারে ডলার মূল্য পাবেন। একই ব্যক্তি যখন ঢাকা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের টিকিট কিনবেন, তখন ১২০ টাকা হারে ডলার মূল্য দিতে হয়। এতে দেখা যায়, একই গন্তব্যের টিকিট দুই দেশে গড়ে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা কম বেশি হয়। তাই টাকায় টিকিট নিশ্চিত হলে এ সমস্যার সমাধান হবে। দেশে ডলারের মজুত বাড়বে।

 

ডলারের পরিবর্তে টাকায় ভাড়া নির্ধারণ করলে কীভাবে যাত্রী ও ব্যবসায়ীদের ব্যয় কমবে তা জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফা) সূত্র উদাহরণ হিসেবে জানায়, ঢাকা থেকে সৌদি আরবের রিয়াদে ভ্রমণে যাত্রী ভাড়া ৫শ ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় ৬০ হাজার টাকা (১২০ টাকা হারে)। এই দরে কোনো যাত্রী এবং ট্রাভেল এজেন্সি টিকিট বুকিং দিয়ে পরদিন টাকা পেমেন্ট করতে গেলে ঘটে বিপত্তি। তখন দেখা যায়, ডলার রেট ১২১ টাকা বা তার বেশি দেখায়। একইভাবে পণ্য পরিবহনে বিপত্তি ঘটে। গ্রাহকের পণ্য পরিবহন আজকের দামে বুকিং দিলে দেখা যায় পরদিন ডলারের বিনিময় হার পরিবর্তন হয়ে যায়। ফলে যে দামে পণ্যের বুকিং রেখেছেন, তার চেয়ে বেশি পেমেন্ট করতে হয়।

 

Manual3 Ad Code

 

কথার বরখেলাপ করছে বিমান

 

তবে বিমানের এ কথায় আস্থা নেই বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাফা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ট্র্যাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) নেতাদের। তাদের অভিযোগ, পণ্য (কার্গো) ও যাত্রী পরিবহন ভাড়া দেশীয় মুদ্রায় অর্থাৎ টাকায় নির্ধারণের সিদ্ধান্ত কার্যকরে বিমান বারবার সময় পুনঃনির্ধারণ করছে।

 

বাফার সভাপতি কবির আহমেদ বলেন, ‘ডলার আর টাকার বৈষম্য নিয়ে মন্ত্রণালয়কে বহু চিঠি দিয়েছি। এক বছরের বেশি সময় আগে মন্ত্রণালয় বিশ্বের অন্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দেশীয় মুদ্রায় ভাড়া নির্ধারণে প্রজ্ঞাপন জারি করে। কিন্তু তা বাস্তবায়নে বিমান বারবার সময়ক্ষেপণ করেছে। আমরা মনে করি, বিমান বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। এ ধরনের অনৈতিক ও অব্যবসায়ীমূলক কাজ তাদের মানায় না।’

 

 

ডলারে ‘মধু’, টাকায় ‘টালবাহানা’

 

তিনি অভিযোগ জানিয়ে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা বিমান মানবে না কেন। বিষয়টি আমরা খোঁজ নিয়েছি। বিমান ডলারের বিনিময় হারের ওপর থেকে কিছু আয় করে, যা মোট এয়ারলাইন্স ব্যবসার মাত্র ৯ থেকে ১১ শতাংশ। বাকি গড়ে ৯০ শতাংশ ব্যবসা করছে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো। এতে যাত্রী ও ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এখন বিমান টাকায় ভাড়া নির্ধারণ করলে দেশি-বিদেশি সব এয়ারলাইন্সকে একই নিয়মে চলতে বাধ্য করবে বেবিচক।’

Manual5 Ad Code

 

গত ২১ অক্টোবর বাংলাদেশ থেকে পণ্য (কার্গো) ও যাত্রী পরিবহন ভাড়া দেশীয় মুদ্রায় নির্ধারণে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বরাবর ফের চিঠি দিয়েছে বাফা। চিঠিতে ডলারের বিনিময় হারে টাকার বৈষম্য তুলে ধরা হয়। চিঠিতে বলা হয়, বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে আকাশপথে পণ্য ও যাত্রী পরিবহন ভাড়া ডলারে নির্ধারিত হয়। এটা বিশ্বব্যাপী প্রচলিত রীতির ব্যত্যয়। কারণ, পৃথিবীর অন্য দেশে, এমনকি বাংলাদেশের প্রতিবেশী সার্ক সদস্যভুক্ত দেশগুলোতেও আন্তর্জাতিক পরিবহন ভাড়া স্থানীয় মুদ্রায় উল্লেখ করা হয়। যদিও একসময় বাংলাদেশে টাকায় পরিবহন ভাড়া নির্ধারণ এবং উল্লেখ করা হতো।

 

চিঠিতে আরও বলা হয়, করোনা পরবর্তীসময়ে দেশে ক্রমেই ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য কমতে থাকে। এতে আকাশপথে ভাড়া পরিশোধে যাত্রী এবং ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হতে থাকে। এমন অবস্থায় দেশি-বিদেশি এয়ারলাইন্সে ডলারের পরিবর্তে টাকায় ভাড়া নির্ধারণে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানায় বাফা ও আটাব। পরে ২০২৩ সালের ১৬ এপ্রিল আকাশপথের ভাড়া পরিশোধে যাত্রী ও ব্যবসায়ীদের অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় কমাতে দেশীয় মুদ্রায় যাত্রী ও পরিবহন ভাড়া নির্ধারণে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রণালয়।

একইভাবে ২০২৩ সালের ২৮ মে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) একই নির্দেশনা দেয়, যা ২০২৩ সালের ১ জুলাই থেকে কার্যকর করার কথা ছিল। কিন্তু বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ওই নির্দেশনা কার্যকর করার তারিখ পাঁচবার পরিবর্তন করেছে। সবশেষ ২০২৫ সালের ১৬ জানুয়ারি থেকে তা বাস্তবায়নের দিন নির্ধারণ করেছে বিমান। এই তারিখটাও পরিবর্তন হওয়ার আশঙ্কা করছেন বাফা ও আটাবের সংশ্লিষ্টরা।

আটাবের সভাপতি আবদুস সালাম আরেফ বলেন, ‘বিশ্বের প্রায় সব দেশে স্থানীয় মুদ্রায় এয়ারলাইন্সে যাত্রী ও পণ্য পরিবহন ভাড়া নির্ধারণ হয়। কিন্তু বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম। এখানে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার পরও কোনো কাজ হয় না। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে যাত্রী ও ব্যবসায়ীদের ওপর। অথচ বিমানের যাত্রী ও পণ্যের ভাড়া টাকায় নির্ধারণ করা জরুরি। এটা করা হলে ডলারের সঙ্গে ভাড়া ওঠা-নামা বন্ধ হবে। বিমানের সঙ্গে কম ভাড়ায় যাত্রী ও পণ্য পরিবহনে অন্য এয়ারলাইন্সের প্রতিযোগিতা কাজ করবে।’

বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া বলেন, ভাড়া নির্ধারণ মন্ত্রণালয় ও বিমানের বিষয়। যাত্রীদের জন্য যেটা ভালো সেটা তারাই ঠিক করবে। আমাদের সঙ্গে যদি বিমানের কথা হয়, তখন বিষয়টি তাদের ইতিবাচকভাবে দেখার কথা বলবো।

 

 

ডলারের বিনিময় হারেও ‘কারচুপি’ বিমানের

 

বাফা সূত্র জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী সোনালী ব্যাংকে মার্কিন ডলারের সঙ্গে বাংলাদেশ টাকার প্রযোজ্য বিনিময় হার নির্ধারণ করবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। কিন্তু যখন মার্কিন ডলারের সঙ্গে বাংলাদেশ টাকার বিনিময় হার কমে যায়, অর্থাৎ যখন বিনিময় হার নিজেদের পক্ষে থাকে, তখন বিমান দেশের এবং দেশের ফ্রেইট ফরওয়ার্ডারদের স্বার্থ চিন্তা না করে নিজেদের স্বার্থে মাসের পর মাস বিনিময় হার পুনঃনির্ধারণ করতো না। শিপিং ব্যবসায় নিয়োজিত শিপিং লাইনগুলো কখনো ব্যাংকের দৈনিক বিনিময় হার, কখনো বা তাদের ইচ্ছামতো বিনিময় হার ব্যবহার করে।

 

বাফা জানায়, যদি কোনো নির্দিষ্ট তারিখে বিমান ডলারের বিনিময় হার টাকা ১১৯ দশমিক ৯৮ নির্ধারণ করে, আর বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত ডলারের সঙ্গে টাকার বর্তমান বিনিময় হার ১১৯ টাকা হয় তাহলে বাফার সদস্যদের প্রতি ডলারে ৯৮ পয়সা লোকসান দিতে হয়। একদিকে বিদেশি বিমান সংস্থাগুলো, যাদের মার্কেট শেয়ার প্রায় ৮৫ শতাংশ, তারা দেশের শত শত কোটি টাকা বিদেশে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে, অপরদিকে দেশের ফ্রেইট ফরওয়ার্ডার ও ট্রাভেল এজেন্টরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ সমস্যা সমাধানে বিমানের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করলেও কোনো সমাধান হয়নি।

 

যা বলছে বিমান ও মন্ত্রণালয়

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানের পরিচালক (বিপণন ও বিক্রয়) আশরাফুল আলম কোনো মন্তব্য করেননি। তিনি বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ বিভাগ) বোসরা ইসলামের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।

ডলারের পরিবর্তে টাকায় ভাড়া নির্ধারণ বিষয়ে মন্ত্রণালয় ও বেবিচকের ওই নির্দেশনা কবে নাগাদ বাস্তবায়ন হবে, তা জানতে চাইলে বিমানের মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ বিভাগ) বোসরা ইসলাম বলেন, ‘২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে বিমানে যাত্রী ও পণ্যের ভাড়া ডলারের পরিবর্তে টাকায় নির্ধারণ করা হবে। এ নিয়ে বিমানের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কাজ করছেন।’

বারবার কথার বরখেলাপ ও ডলারের দামে কারচুপির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান।

পরে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক উপসচিব বলেন, টাকায় ভাড়া নির্ধারণ নিয়ে সব এয়ারলাইন্সের প্রতিনিধিদের নিয়ে মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করা হয়েছিল। তখন সবার সম্মতিতে ডলার বাদ দিয়ে টাকায় ভাড়া নির্ধারণের সিদ্ধান্ত হয়। তবে এ কাজটি করতে গেলে অর্থ মন্ত্রণালয়সহ আরও বেশকিছু দপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করতে হয়। বিষয়গুলো চলমান। তবে ঠিক কবে নাগাদ এ সিদ্ধান্ত বিমান বাস্তবায়ন করবে তা সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাবে না।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual8 Ad Code