প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৫ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৩০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৪শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

সয়াবিন তেলের বাজারে নৈরাজ্য

editor
প্রকাশিত ডিসেম্বর ৮, ২০২৪, ০২:৫৫ অপরাহ্ণ
সয়াবিন তেলের বাজারে নৈরাজ্য

Manual2 Ad Code

 

Manual3 Ad Code

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

বোতলজাত সয়াবিন তেল বাজার থেকে উধাও বললেই চলে। পাঁচ-ছয়টি দোকান ঘুরে মিলছে একটিতে, তাও দাম গুনতে হচ্ছে বেশি। খোলা সয়াবিন ও পাম তেলেও একই অবস্থা। বোতলজাত তেল না থাকায় গত কয়েকদিনে খোলা তেলের দাম প্রতি লিটারে বেড়েছে ৩৫ টাকা পর্যন্ত। কেউ কেউ আবার তেল কেনায় জুড়ে দিচ্ছেন শর্ত।

হঠাৎ কেন এমন সংকট- জানতে চাইলে মুখ খুলছে না সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। তারা কথা বলছেন না কোনো গণমাধ্যমের সঙ্গে। সরকারি নিয়ন্ত্রক সংস্থাও স্পষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারছে না। তবে বিভিন্ন সূত্র জানায়, বিশ্ববাজারে তেলের দাম বেড়েছে। এখন তেল বিক্রি করে লোকসান গুনতে হচ্ছে কোম্পানিগুলোকে। যে কারণে তেলের দাম বাড়াতে প্রস্তাব করেছে সরবরাহকারীরা। তবে সরকার দাম বাড়াতে চায় না।

 

পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সাধারণ মানুষ ও সরকারকে চাপে ফেলতে কোম্পানিগুলো কৃত্রিম সরবরাহ সংকট তৈরি করেছে বলে মনে করেন খুচরা বিক্রেতা ও ভোক্তারা।

দেশের বাজারে ভোজ্যতেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে বর্তমান সরকার দুই দফায় আমদানি শুল্ককর কমালেও এর কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়েনি বাজারে। প্রতি কেজি ভোজ্যতেল আমদানিতে শুল্ক-কর ১০ থেকে ১১ টাকা কমেছে। কিন্তু সরকার শুল্ক-কর কমালেও আমদানি বাড়েনি, বরং বাজারে বোতলজাত তেলের সংকট তৈরি হয়েছে।

Manual1 Ad Code

 

 

বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা যায়, সাধারণ মানুষ তেল নিয়ে চরম অস্বস্তিতে রয়েছে। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এক থেকে দুই লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল বাজার থেকে রীতিমতো উধাও হয়ে গেছে। ক্রেতারা যে দু-একটি বোতল পাচ্ছেন, তারও দাম রাখা হচ্ছে বেশি। আবার কোনো কোনো বিক্রেতা আটা ও লবণ না কিনলে তেল দিচ্ছেন না।

ঢাকার মধুবাগ এলাকায় প্রায় দশটি দোকান ঘুরে সেখানে একটি দোকানে বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি হতে দেখা গেছে। একটিতে ছিল খোলা সয়াবিন। ওই এলাকার ভাই ভাই স্টোরের মাজহার হোসেন বলেন, ‘কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা তেলের অর্ডার নিচ্ছে না। প্রায় দুই সপ্তাহ বাজার থেকে কিছু কিছু বোতল কিনে নিয়মিত ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছি। এখন সেটাও নেই।’

 

তিনি জানান, বোতলজাত তেল না থাকায় খোলা সয়াবিন ১৮৫ টাকা লিটার বিক্রি হচ্ছে, যা দুদিন আগে ১০ টাকা ও দুই সপ্তাহ আগে প্রায় ২০ টাকা কম ছিল।

 

অন্যদিকে ওই এলাকায় আরকে স্টোরে রয়েছে কয়েক বোতল সয়াবিন। প্রতি লিটার তেল সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৬৭ টাকা, ২ লিটার ৩৩৪, ৫ লিটার ৮১৮ দাম লেখা থাকলেও বিক্রি হচ্ছে ৩ থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বেশি দামে।

 

দোকানের স্বত্বাধিকারী রকি বলেন, এ তেল এনেছি জোর করে। ওরা আমার কাছেই গায়ের দাম নিয়েছে। আমি লিটারে ৩ টাকা বাড়িয়ে বিক্রি করছি।

ক্রেতা-বিক্রেতাদের ভিন্ন অভিজ্ঞতাও হচ্ছে। মধ্যবাড্ডা এলাকার কিছু বড় মুদি দোকানে তেল মিললেও আটা, লবণ না কিনলে তেল বিক্রি করা হচ্ছে না। একটি দোকানে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় তিনজন ক্রেতাকে তেল নিতে গেলে অন্য দুটি পণ্যও কিনতে হবে বলে ফেরত যেতে দেখা যায়। বিক্রেতার কাছে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, কোম্পানি আটা ও লবণ ছাড়া তেল দিচ্ছে না। এখন আমরা যদি শুধু তেল বিক্রি করি তাহলে এত আটা ও লবণ কীভাবে বিক্রি করবো। তেল নিতে গেলে আমাদের যেমন কিনতে হচ্ছে, ক্রেতাকেও কিনতে হবে। এখানে আমাদের কিছু করার নেই।

 

শুধু মধুবাগ, মধ্যবাড্ডা নয় রামপুরা, হাজিপাড়া, মালিবাগ ও মৌচাক এলাকা ঘুরেও তেলের সংকট ও বেশি দামে তেল বিক্রি করতে দেখা গেছে। কোথাও কোথাও এক লিটার তেলের দাম ২০০ টাকাও হাঁকতে দেখা গেছে খুচরা বিক্রেতাদের।

এদিকে বেশিরভাগ সুপারশপেও তেলের সংকট দেখা গেছে। রামপুরা স্বপ্ন সুপারশপে কোনো সয়াবিন তেল ছিল না। সেখানে ম্যানেজার বিপ্লব শিকদার জানান, স্বপ্নের ডিপোতেই তেল দিচ্ছে না সরবরাহকারী কোম্পানিগুলো। যে কারণে আউটলেটে তেল আসেনি শুক্রবার।

খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের দাবি, গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ভোজ্যতেল পরিশোধন কোম্পানিগুলো বোতলজাত সয়াবিন তেল সরবরাহ করছে না। যতটুকু আসছে তা চাহিদার তুলনায় খুবই কম। এখন যা বিক্রি হচ্ছে সেটা খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীদের মজুত তেল।

অন্যদিকে অধিকাংশ বিক্রেতার দাবি, রমজান সামনে রেখে কোম্পানিগুলো এখন থেকেই বাজারে সরবরাহ কমিয়ে বোতলজাত সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছে। এ নৈরাজ্য কোম্পানিগুলোর নতুন নয়। পতিত সরকারের সময় এ পন্থায় কেম্পানিগুলো প্রতি বছর রোজার আগে দাম বাড়িয়েছে। এখনো তাই হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা এও বলছেন, শুল্ককর কমানোর ফলে ভোজ্যতেলের আমদানি বাড়ার কথা, উল্টো আমদানি কমেছে। বর্তমানে বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়তি বলে সরবরাহকারী কোম্পানি যে দাবি করছে তাও যুক্তিযোগ্য নয়।

এ বিষয়ে তেল সরবরাহকারী একাধিক কোম্পানির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেও তাদের আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বেশ কয়েকদিন ধরেই তারা গণমাধ্যমে মন্তব্য করছেন না।

Manual7 Ad Code

অভিযোগ রয়েছে, অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার আশায় শত শত কার্টন সয়াবিন তেল মজুত করে এখনকার কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে। আবার তারাই বিক্রয় প্রতিনিধিদের দিয়ে গুজব ছড়িয়েছে যে, বাজারে তেল নেই। এরপর সয়াবিন তেল সরবরাহ দিচ্ছে না।

 

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘কোম্পানিগুলো তেল সরবরাহ বন্ধ রেখে ভোক্তাদের সঙ্গে নৈরাজ্য করছে। তাদের সরবরাহ ও মজুত খতিয়ে দেখা দরকার।’

রোববার (৮ ডিসেম্বর) বাজারে তেলের সরবরাহ সংকট ঠেকাতে মাঠে নেমেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের একটি টিম। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বাজার তদারকিতে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন।

Manual3 Ad Code

 

বাজারে সংকট তৈরি করে গত বৃহস্পতিবার ভোজ্যতেল পরিশোধন কোম্পানিগুলো বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনে এক সভায় জানান, আসন্ন রমজান উপলক্ষে যে পরিমাণ সয়াবিন তেল আমদানি হওয়ার কথা (ঋণপত্র খোলা), তা স্বাভাবিক পর্যায়ে রয়েছে। তবে বিশ্ববাজারের দামের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে দেশের বাজারেও ভোজ্যতেলের দাম সমন্বয় করা প্রয়োজন।

এ বিষয়ে ট্যারিফ কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মইনুল খান বলেন, ‘তারা (কোম্পানিগুলো) দাম বাড়াতে চায়। তবে এ বিষয়টি আমরা দেখছি। তাদের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা যাচাইয়ে ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএমএবি) ও ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি কমিটি করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বসবো।’

তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমরা মনিটরিং করছি। প্রকৃত আমদানি পরিস্থিতি ও আন্তর্জাতিক বাজারের তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তারা যে কারণে তেলের এ পরিস্থিতি তৈরি করেছে তাদের প্রতিটি ফ্যাক্টর চেক করা হবে।’
গুটিকয়েক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ

গত ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পরে ভোজ্যতেল শিল্পে কিছু পরিবর্তন এসেছে। এ বাজারের একটি বড় অংশীদার এস আলম গ্রুপ তেল সরবরাহ থেকে সরে গেছে। বর্তমানে ভোজ্যতেলের বাজারে ১০ প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। তবে নিয়ন্ত্রণ টিকে গ্রুপ, সিটি গ্রুপ, মেঘনা গ্রুপ ও বসুন্ধরার কাছে। এ চার কোম্পানি আমদানি করা ভোজ্যতেলের বাজারের সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ করছে।

দেশে এখন বছরে ৩০ লাখ টন ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে। যার দুই-তৃতীয়াংশ এসব কোম্পানি আমদানি করছে। বাকিটা দেশে উৎপাদন ও অন্য কোম্পানি আনছে। ফলে ভোজ্যতেলের বাজারে চলমান সংকটে এ চার কোম্পানিকে দায়ী করছেন কেউ কেউ।

 

সরকার কী বলছে?

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় স্বীকার করছে যে এখন চাহিদার তুলনায় দোকানে পর্যাপ্ত সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বলছে, সরবরাহকারী কোম্পানির পাশাপাশি পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা মিলে তেল মজুত রেখে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে পারে।

অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান বলেন, ‘ভোক্তা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের তেল নিয়ে কঠোর অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আমাদের ছয়টি টিম মাঠে কাজ করছে।’

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual6 Ad Code