প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৪ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৩শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

টার্গেট ব্যক্তিকে অপহরণে থাকত অভিনব প্রযুক্তি

editor
প্রকাশিত ডিসেম্বর ১৬, ২০২৪, ০৯:৩২ পূর্বাহ্ণ
টার্গেট ব্যক্তিকে অপহরণে থাকত অভিনব প্রযুক্তি

Manual4 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

প্রযুক্তির সাহায্যে অভিনব কায়দায় টার্গেট ব্যক্তিদের গোপনে অপহরণ করা হতো। অপকর্মে জড়িতদের যেন পরবর্তী সময়ে শনাক্ত করা না যায়, সে জন্য গুম প্রক্রিয়ার ব্যাপ্তি ছিল কয়েকটি স্তরে। আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি দল টার্গেট ব্যক্তিকে উঠিয়ে নিত। আরেক দল আটক রেখে নির্যাতন করত। নির্যাতনের পর তাদের তুলে দেওয়া হতো অপর একটি দলের কাছে। শেষ দলটি কঠিন শর্তে কাউকে মুক্তি দিত, ফৌজদারি মামলা দিয়ে কাউকে কারাগারে পাঠিয়ে দিত, আবার কাউকে অভিনব কৌশলে হত্যা করত। সব অপকর্মই হতো গভীর রাতে। অপহরণ, আটক, নির্যাতন, হত্যা ও মুক্তি- এই পাঁচটি ভাগে সুপরিকল্পিতভাবে গুমের ঘটনা ঘটানো হয়েছে। কাউকে গুম করার ক্ষেত্রে দুই ধরনের পদ্ধতি ব্যবহার করা হতো। অনেক সময় প্রথমে কাউকে আটক-নির্যাতন করে অন্যদের নাম আদায় করা হতো। এরপর নাম পাওয়াদেরও ধরে এনে নির্যাতন করা হতো। এভাবে তাদের সবাইকে গুম করা হতো। রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তি বা শীর্ষস্থানীয় নেতার সরাসরি নির্দেশেও গুম ও নির্যাতন করা হতো।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশনের জমা দেওয়া অন্তর্বর্তী প্রতিবেদনের প্রকাশযোগ্য অংশে নির্মম নির্যাতনের এ ভয়াবহ তথ্য পাওয়া গেছে। প্রতিবেদনে গুমের ঘটনায় শেখ হাসিনাকে দায়ী করা হয়েছে। একই সঙ্গে গুমের ঘটনায় জড়িত র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র‌্যাব) বিলুপ্তির সুপারিশ করা হয়েছে।

র‌্যাব বিলুপ্তির সুপারিশ প্রসঙ্গে পুলিশের সাবেক আইজি নূর মোহাম্মদ বলেন, “এই জাতীয় প্রতিষ্ঠান নিয়ে সব সময়ই ভালো বা মন্দ আলোচনা হয়ে থাকে। র‌্যাব ‘মিক্সড ফোর্সেস’ (বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বয়ে) কাঠামোর একটি ইউনিট। এ ক্ষেত্রে বর্তমানে র‌্যাবের ক্ষেত্রে মন্দ আলোচনার পাল্লা ভারী। গুম-ক্রসফায়ার প্রশ্নে র‌্যাব বিলুপ্তির সিদ্ধান্ত সরকারের ওপর নির্ভর করবে। কিন্তু তার আগে র‌্যাব বিলুপ্ত করলে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে অথবা রাষ্ট্র ও সমাজের জন্য ভালো হবে নাকি ক্ষতি হবে, সেটা পর্যালোচনা করা দরকার। সে পর্যালোচনার মাধ্যমে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া গেলে ভালো হবে।”

প্রতিবেদনে বলা হয়, গুমের শিকার হওয়ার পর যারা ছাড়া পেতেন, তারা যেন ঘটনাস্থল শনাক্ত বা তার সঠিক বর্ণনা দিতে না পারেন, সে জন্য একই রকমের গোপন বন্দিশালা (আয়নাঘর) বানানো হয়েছে। এর মধ্যে নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও মোহাম্মদপুরের বন্দিশালা ছিল একই রকম। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে এসব বন্দিশালা তৈরি করা হয়েছে।

সব অপহরণের ঘটনা ঘটত রাতে। ‘হায়েস’ মাইক্রোবাসে সাদাপোশাকে প্রশাসনের লোক পরিচয়ে টার্গেট ব্যক্তিকে তুলে নেওয়া হতো। গাড়িতে তোলার পরপরই ভিকটিমদের চোখ বাঁধা এবং হাতকড়া পরানো হতো। অপহরণের পুরো ঘটনাটি এতই দ্রুত করা হতো যে আশপাশের মানুষও বুঝতে পারত না যে কাউকে অপহরণ করা হয়েছে। অপহৃতের পরিবার-স্বজনরা পুলিশের কাছে গেলে তারা ডিবির কাছে যেতে বলত, আবার ডিবি অন্য কোনো সংস্থাকে দেখিয়ে দিত। ভুক্তভোগীর পরিবার এভাবে দিনের পর দিন হয়রানির শিকার হয়েছে।

Manual4 Ad Code

গুমের ঘটনায় সংস্থা হিসেবে র‌্যাব, পুলিশের ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি) এবং সিটিটিসি (কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম) ইউনিটগুলো প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) এবং ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফোর্সেস ইন্টেলিজেন্সের (ডিজিএফআই) নামও উঠে এসেছে। তবে এসব সংস্থার নিম্নপদস্থ নিরাপত্তাকর্মীদের অনেকেই দাবি করেন, তারা জানতেন না যে কাকে আটক করা হয়েছে বা কেন করা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে এসব ঘটনা ঘটেছে।

প্রযুক্তির সাহায্যে নজরদারি

গুমের ক্ষেত্রে ভিকটিমদের অবস্থান চিহ্নিত করতে মোবাইল প্রযুক্তির সহায়তা নেওয়া হতো। ডিজিএফআইয়ের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ন্যাশনাল মনিটরিং সেন্টার (এনএমসি) এবং পরবর্তী সময়ে ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) মোবাইলের মাধ্যমে নজরদারি পরিচালনা করত। এরপর টার্গেট করা ব্যক্তিকে অপহরণ করা হতো।

আটক ও নির্যাতন

আটক ব্যক্তিকে সাধারণত গোপন অন্ধকার কক্ষে রাখা হতো এবং সেখানেই নির্মম নির্যাতন চালানো হতো। আটক রেখে কখনো ৪৮ ঘণ্টা, কখনো কয়েক সপ্তাহ, এমনকি কয়েক মাস পর্যন্ত চলত নির্যাতন। সাধারণত র‌্যাব ও ডিজিএফআইয়ের বিভিন্ন স্থাপনায় এসব নির্যাতনের সব বন্দোবস্ত ছিল। বিশেষ করে সেনাবাহিনী পরিচালিত বন্দিশালাগুলোয় নির্যাতনের জন্য বিশেষ যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হতো, যার মধ্যে ছিল সাউন্ডপ্রুফ কক্ষ এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের জন্য ডিজাইন করা বিভিন্ন যন্ত্র।

কেউ কেউ বন্দি থাকতে পারেন ভারতেও

Manual4 Ad Code

গুমের ঘটনা শুধু বাংলাদেশের নয়, আন্তর্জাতিক চক্রান্তের অংশ। বিশেষ করে ভারতীয়দের জড়িত থাকার প্রমাণ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে গুমের শিকার কিছু বাংলাদেশি এখনো ভারতের কারাগারে বন্দি থাকতে পারে। তাদের খুঁজে বের করা কমিশনের এখতিয়ারের বাইরে। তাই যেসব বাংলাদেশি নাগরিক এখনো ভারতের কারাগারে থাকতে পারেন বলে ধারণা করা হচ্ছে, তাদের শনাক্তে সর্বোচ্চ চেষ্টা করতে পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতি সুপারিশ করা হয়েছে।

সুখরঞ্জন বালি এবং বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদকে গুমের পর ভারতে স্থানান্তরের ঘটনা এখানে উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে। এ ছাড়া বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির প্রয়াত সদস্য সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হাম্মাম কাদের চৌধুরী তার বন্দিশালায় হিন্দি ভাষাভাষী লোকদের কথা শুনেছেন। এ ছাড়া সিলেট সীমান্তে একাধিক ব্যক্তিকে ভারতে থেকে এনে হত্যা করা হয়েছে। আবার বাংলাদেশ থেকে ধরে ভারতে পাঠানো হয়েছে।

Manual8 Ad Code

পরিসংখ্যান

Manual7 Ad Code

২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সাড়ে ১৫ বছরের ১ হাজার ৬৭৬টি জোরপূর্বক গুমের ঘটনার অভিযোগ আনা হয়েছে। এদের মধ্যে কমিশন পর্যালোচনা করেছে ৭৫৮টির অভিযোগ। ২০১৬ সালে সর্বোচ্চ ১৩০টি এবং ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত ২১টি ঘটনা ঘটেছে। গুমের শিকারদের মধ্যে ৭৩ শতাংশ জীবিত ফিরেছেন, এখনো নিখোঁজ ২৭ শতাংশ। ফিরে আসা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস প্রতিরোধ, অস্ত্র আইন, বিশেষ ক্ষমতা আইন বা ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের মামলা দেওয়া হয়েছিল।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual5 Ad Code