প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৫ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৩০শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৪শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

শেখ হাসিনার পতনের ৬ মাস পূর্ণ হলো আজ

editor
প্রকাশিত ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৫, ০৭:০০ পূর্বাহ্ণ
শেখ হাসিনার পতনের ৬ মাস পূর্ণ হলো আজ

Manual4 Ad Code

বাসস ডেস্ক:
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের ছয় মাস হল পূর্ণ হলো আজ। হাজারো প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশে দীর্ঘ প্রায় দেড় দশকের স্বৈরাচারী-ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসান হয় ২০২৪ এর ৫ আগস্ট। ওইদিন প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ঐতিহাসিক এ পট পরিবর্তনের দগদগে স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশের মানুষকে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলি এবং আওয়ামী লীগের দলীয় সন্ত্রাসীদের হামলা ও গুলিতে শহিদ হয়েছেন আবু সাঈদ মুগ্ধ ওয়াসিমসহ বহু শিক্ষার্থী এবং নানা পেশার ১ হাজারেরও বেশি মানুষ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের তান্ডবে চোখের আলো নিভে গেছে ৪০০ জনের। মারাত্মক জখম ও আহত হয়েছেন ২৩ সহস্রাধিক মানুষ। পুঙ্গুত্ববরণ করতে হয়েছে অনেককে। এখনো শরীরে বুলেটের ক্ষত নিয়ে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাচ্ছেন হাজারো মানুষ।

Manual4 Ad Code

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত জুলাইয়ের গোড়ায় শুরু হওয়া শিক্ষার্থীদের আন্দোলন মধ্য জুলাইতে এসে তৎকালীন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের হামলায় রূপ নেয় গণবিস্ফোরণে। হাসিনা সরকারের অত্যাচার-নিপীড়নের সঙ্গে যোগ হয় স্বৈরাচারের আজ্ঞাবহ কিছু অতি উৎসাহী পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তার মানবাধিকার বিরোধী নৃশংসতা। এই নির্বিচার গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ নিশ্চিত করে শেখ হাসিনা সরকারের পতন।

আওয়ামী লীগ সরকারের দমনপীড়নের সামনে রাজপথে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়ুয়া শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। তরুণ, যুবা, গৃহিণী, অভিভাবক সবাই স্বৈরাচরের রাহুমুক্ত হতে একজোট হয়েছিলেন রাজপথে। দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে উঠে আসে শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের এক দফা। এ গণদাবি সরকারের ভিত নাড়িয়ে দেয়। সরকারের পুলিশ ও দলীয় সন্ত্রাসীদের গুলি, হত্যার বীভৎসতায় ছাত্র-জনতার আন্দোলন রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে।

প্রবল জনরোষের মুখে ৫ আগস্ট পদত্যাগ করেন শেখ হাসিনা। ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে তিনি ওই দিন দুপুরে সামরিক বাহিনীর হেলিকপ্টারে করে দেশ ছেড়ে ভারতের নয়াদিল্লিতে গিয়ে আশ্রয় নেন।

Manual7 Ad Code

এরপর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন সরকার রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে সংস্কারের উদ্যোগসহ বিভিন্ন কার্যক্রম সফলভাবে এগিয়ে নিচ্ছেন।

বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে যুগোপযোগী করতে চলছে বিভিন্ন পদক্ষেপ। দেশের সর্বোচ্চ আদালত, নির্বাচন কমিশন নতুন নিয়োগের মধ্য দিয়ে জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হয়েছে। ইতোমধ্যে বিচারক নিয়োগ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনকে যুগোপযোগী করাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে।

Manual6 Ad Code

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলন নির্মূলে পরিচালিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কার্যক্রম শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।

Manual4 Ad Code

কোটা সংস্কার থেকে পরবর্তীতে সরকার পতনে ছাত্র জনতার একদফা আন্দোলন তা নির্মূলে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলি ও আওয়ামী লীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হামলায় একের এক প্রাণহানির কারণে গণ-বিস্ফোরণে রূপ নেয়। অভিনব সব কর্মসূচি দিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সরকার হটানোর আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন শিক্ষার্থীরা। কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার থেকে ঘোষণা করা হয় সরকার পতনের এক দফা দাবি। শুরু হয় ছাত্র-জনতার সর্বাত্মক অসহযোগ।

ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে গিয়ে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে মানুষ হত্যার দায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার মন্ত্রিসভার সদস্য ও উপদেষ্টা, আওয়ামী লীগের অনেক এমপির বিরুদ্ধে নিহতদের পরিবার হত্যা মামলা দায়ের করছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে প্রায় দুই শতাধিক হত্যা মামলা হয়েছে। শেখ হাসিনার পরিবারের অনেক সদস্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান চলছে। এর মধ্যেই স্বৈরাচারী সরকারের মন্ত্রী, এমপিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গ্রেফতার হয়েছেন। রিমান্ডে বেরিয়ে আসছে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ক্ষমতাধর এসব ব্যক্তিদের দমন, পীড়ন, লুটপাট, দুর্নীতির চাঞ্চল্যকর তথ্য।

এদিকে বিচারের আওতা থেকে বাঁচতে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আগেই আওয়ামী লীগের অনেক মন্ত্রী, এমপি বিদেশে পালিয়ে গেছেন। দেশে থাকা মন্ত্রী, এমপিরাও রয়েছেন আত্মগোপনে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে গ্রেফতার হচ্ছেন তারা। এরই মধ্যে শেখ হাসিনার কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিল করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এখন আর শেখ হাসিনার কোনো পাসপোর্ট নেই।

শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনামলজুড়ে ভোটাধিকার ও বাকস্বাধীনতা হরণ, বিরোধী দল ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও পুলিশি নিপীড়ন, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ঋণের নামে ব্যাংক লুণ্ঠন, সরকার ঘনিষ্ঠদের ব্যাপক দুর্নীতি ও অর্থপাচার, সচিবালয় থেকে বিচার বিভাগ পর্যন্ত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ব্যাপক দলীয়করণ, দ্রব্যমূল্যের ব্যাপক ঊর্ধ্বগতি, ভারতের সঙ্গে নতজানু পররাষ্ট্রনীতি ইত্যাদি কারণে ছিল তীব্র গণঅসন্তোষ। গণমাধ্যমের ওপর একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বানোয়াট পরিসংখ্যান আর বিভিন্ন দৃশ্যমান অবকাঠামো উন্নয়নকেন্দ্রিক প্রচারণার মাধ্যমে দুঃশাসনকে আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে।

শেখ হাসিনার শাসনামলে রীতিমতো আইন করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা হয়। এসব কারণে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ বারুদের বিশাল স্তূপের মতো জমা হচ্ছিল।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধী দলের আন্দোলন ও ভিন্নমত দমনের জন্য গুমের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত ছিল। গত দেড় দশকে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে বাসা, অফিস কিংবা রাস্তা থেকে মানুষকে তুলে নিয়ে পরবর্তীতে অস্বীকার করা হয়। তাদের অনেকে ফিরে আসেন, কারো লাশ পাওয়া যায়, আবার অনেকে দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ। স্বজনরা দিনের পর দিন বিভিন্ন বাহিনীর দ্বারে দ্বারে ঘুরেও তাদের কোনো খোঁজ পাননি।

২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ। ওই আমলে কৌশলে তত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংকটকে ঘনীভূত করেন শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালে বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণ ছাড়াই একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ১৫৩টি আসন লাভ করে সরকার গঠনে করে। এরপর ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিরোধী দলগুলো অংশ নিলেও সরকারি প্রশাসন ও দলীয় কর্মীদের ব্যবহার করে আগের রাতেই ব্যালটে সিল মেরে নির্বাচনে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। আর ২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও বিরোধী দল ছাড়া নিজ দলীয় নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী করে ‘ডামি’ প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে নির্বাচনে জয় লাভ করে তারা। এভাবে বাংলাদেশে পাঁচ বছর পরপর নিয়মিত নির্বাচন হলেও জনগণের কাছে কোনো ধরণের জবাবদিহিতা করতে হয়নি হাসিনা সরকারকে। জবাবদিহিতাহীন এই একচেটিয়া শাসনের ফলেই দেশে মানবাধিকার ও আইনের শাসনের মারাত্মক অবনতি ঘটে এবং অর্থনৈতিক সংকটে জনজীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে।

দীর্ঘ স্বৈরশাসনে এমন এক পুঁজিবাদী ব্যবস্থা বিকশিত হয়েছিল, যেখানে সরকারি কর্মকর্তা, রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও মাস্তানদের সমন্বয়ে এক মাফিয়া রাজত্ব কায়েম হয়। এই মাফিয়ারা ক্ষমতাসীন পরিবারের আশীর্বাদে রীতিমতো দায়মুক্তি নিয়ে দখল, দুর্নীতি, লুণ্ঠন ও অর্থপাচারে লিপ্ত হয়।

যেসব ক্ষেত্রে বিচার করলে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক সুবিধা হয়, সেসব মামলার বিচার দ্রুত সম্পন্ন হলেও যেসব ঘটনায় ক্ষমতাসীন দল বা দলের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি-গোষ্ঠী ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেসব ক্ষেত্রে ঘটনার তদন্ত ও বিচার দিনের পর দিন ঝুলে ছিল। সামান্য কটূক্তি বা মানহানির মামলার অনেকের দ্রুত সাজা হয়ে গেলেও আগুন পুড়ে বা ভবন ধসে শ্রমিক হত্যার জন্য কোনো কারখানা মালিকেরই সাজা হওয়ার নজির নেই। অথচ ২০২৪ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে বিভিন্ন নাশকতার মামলায় বিএনপি নেতাকর্মীদের বিচার ত্বরান্বিত করার জন্য রাতের বেলাতেও সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। অন্যদিকে বিচার হয়নি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি বা ঋণের নামে ব্যাংক লুণ্ঠনের অনেক বড় বড় কেলেঙ্কারির। বিচার হয়নি সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি, কুমিল্লার কলেজ ছাত্রী সোহাগী জাহান তনু কিংবা নারায়ণগঞ্জের কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকাণ্ডের।

শেখ হাসিনা সরকারের আমলে ব্যয়বহুল অবকাঠামো নির্ভর এমন এক অর্থনীতির বিকাশ ঘটেছে, যেখানে কাগজে-কলমে প্রবৃদ্ধি হয়েছে কিন্তু তাতে দেশে তরুণদের কর্মসংস্থান হয়নি।

শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার দাবিকে কেন্দ্র করে ২০২৪ এর জুলাইয়ে ‘টানা ৩৬ দিনের আন্দোলন দমনে শত শত তরুণকে সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গুলি করে নির্বিচারে হত্যা করলে ঘটনা ও দীর্ঘ সময়ের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ বারুদের এই স্তূপে স্ফুলিঙ্গের মতো কাজ করেছে। যা শেষ পর্যন্ত শেখ হাসিনার দীর্ঘ স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়েছে।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual4 Ad Code