প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৪ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৯শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৩শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

বিদেশনির্ভর এনজিওতে অস্থিরতা

editor
প্রকাশিত ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২৫, ১১:৩৫ পূর্বাহ্ণ
বিদেশনির্ভর এনজিওতে অস্থিরতা

Manual5 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

বিগত বছরগুলোতে উন্নয়ন সংস্থাগুলোর বিদেশি সহায়তা ধারাবাহিকভাবেই কমেছে। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র ও সুইজারল্যান্ড অর্থ সহায়তা স্থগিত এবং বন্ধের ঘোষণায় প্রভাব পড়েছে বিদেশি সহায়তানির্ভর দেশের বিভিন্ন এনজিওতে। এনজিওগুলোর কার্যালয়ের কার্যক্রম স্থগিত, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তিন মাসের জন্য সব কর্মকাণ্ড বন্ধ ঘোষণা, বিদেশি সহায়তানির্ভর প্রকল্পের কর্মীদের গণহারে ছাঁটাইয়ের নোটিশে অস্থিরতা বিরাজ করছে সংস্থাগুলোয়। সেইসঙ্গে অর্থায়ন বন্ধের বাহানায় চাকরি হারানোর শঙ্কা কাজ করছে উন্নয়ন কর্মীদের মধ্যে।

শপথ গ্রহণের পরই গত ২০ জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক নির্বাহী আদেশের পর যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থায়নে রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা ছাড়া এজেন্সি ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্টের (ইউএসএআইডি) অর্থায়ন বন্ধ করে দিয়েছে। এতে বাংলাদেশের কয়েক হাজার এনজিও কর্মী অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছেন। এরই মধ্যে অনেক কর্মী চাকরি হারিয়েছেন। তারা নিয়ম অনুযায়ী তিন মাস বেতন পাবেন না বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

কয়েকটি এনজিওর নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলমান প্রকল্পগুলোর কিছু কিছু প্রকল্প চলতে পারে, কিছু কিছু বন্ধ হয়ে যাবে। তবে এনজিওগুলো বিকল্প অর্থায়ন ব্যবস্থা করতে পারলে প্রকল্প চালু থাকবে। তাৎক্ষণিক এ প্রকল্পের লোকবল ছাঁটাই করা হবে বলেও ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। ছাঁটাইয়ের শিকার কর্মীরা শ্রম আইন অনুযায়ী ও অফিসের নীতি অনুসারে ক্ষতিপূরণ পাবেন। তবে, অর্থায়ন বন্ধে বিভিন্ন এনজিও বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় প্রকল্প অফিস বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিকল্প উপায় খুঁজে বের করতে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে কর্তাব্যক্তিরা কর্মীদের অবগত করেছেন। তারা আরও বলছেন, মাঠ পর্যায়ে বিদেশি এনজিওগুলোর কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের অংশীদার দেশীয় এনজিওগুলোর অবস্থাও খুব খারাপ। বিনা নোটিশে, বিনা বেতনে এদেশীয় কর্মীদের চাকরি চলে গেছে। প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কার্যালয়ে ঝুলছে তালা, কর্মকর্তাদের বেতন রয়েছে বন্ধ।

সূত্র জানায়, বাংলাদেশে ইউএসএআইডির অর্থায়নে চলমান প্রকল্পের কাজ বন্ধ বা স্থগিত করায় খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, গণতন্ত্র ও সুশাসন, পরিবেশ, জ্বালানি এবং মানবিক সহায়তা কার্যক্রমও গতি হারিয়েছে। এমনকি বিদেশি অর্থ বন্ধের ঘোষণায় অনেক এনজিও খরচ কমানোর নীতি অনুসরণ করার জন্য কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। কয়েকটি এনজিও এরই মধ্য নীতিনির্ধারকদের এ বিষয়ে নীতি তৈরি করার পরামর্শ দিয়েছে।

এ বিষয়ে পল্লি কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সাবেক চেয়ারম্যান কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, ‘অর্থায়ন বন্ধের খারাপ দিক হলো স্বাস্থ্য-শিক্ষা খাতের জনবান্ধব কর্মকাণ্ডগুলো ধুঁকবে। অন্যদিকে ভালো দিক হলো, নিজেদের অর্থায়নে এনজিওগুলো কাজ করবে। সাহায্যনির্ভরতার যে মানসিকতা ও চিন্তাধারা, সেটাতে পরিবর্তন আসবে। এই সুযোগে কর্মী ছাঁটাই হবে, অস্থিরতা বিরাজ করবে। তবে এনজিওগুলো যদি এই খরচ কমানোর বাহানায় নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে কর্মী ছাঁটাই করে, তা হবে দুঃখজনক।’ ছাঁটাই চলমান থাকলে, অর্থায়ন সংকুচিত হলে দেশে বেকারত্ব নিশ্চিতভাবেই বৃদ্ধি পাবে, উন্নয়ন খাত ধাক্কা খাবে বলেও মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।

যুক্তরাষ্ট্রের নীতির কারণে সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি)। এরই মধ্য বিভিন্ন প্রকল্পে কর্মরত প্রায় দেড় হাজার কর্মীকে চাকরিচ্যুতির চিঠি দেওয়া হয়েছে। এসব কর্মকর্তা-কর্মচারী ইউএসএআইডির অর্থায়নে পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পে কাজ করতেন। সবচেয়ে বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারী ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন সংক্রামক রোগ বিভাগের যক্ষ্মাবিষয়ক কর্মসূচি থেকে।

Manual8 Ad Code

আইসিডিডিআর,বির কমিউনিকেশন্স বিভাগের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপক এ কে এম তারিফুল ইসলাম খান বলেন, আইসিডিডিআর,বির আমরা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্প ও গবেষণাগুলো পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত স্থগিত রেখেছি।আমাদের সেবাগ্রহীতা, বিভিন্ন অংশীদার ও সহকর্মীদের অসুবিধার জন্য সহানুভূতি ও দুঃখ প্রকাশ করছি। আমরা আশাবাদী, পুনরায় আমাদের কার্যক্রম শুরু করতে পারব।

সূত্রমতে, ইউএসএআইডির অর্থায়নে চলমান প্রকল্পগুলো স্থগিত করেছে কেয়ার বাংলাদেশ, হ্যান্ডিহ্যাপ, সেইভ দ্য চিলড্রেন, আইআরসি, ব্র্যাকের মতো দেশি-বিদেশি এনজিওগুলো। অনেকে চাকরি হারিয়েছেন। এসব বড় এনজিওগুলোর স্থানীয় অংশীজনের অবস্থা আরও শোচনীয়। কর্মীদের অনেককেই মেইলে বা চিঠির মাধ্যমে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হয়েছে।

এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ ছাঁটাই নীতির সর্বশেষ শিকার হচ্ছে আন্তর্জাতিক রেসকিউ কমিটি (আইআরসি)। বাংলাদেশে বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের জন্য কাজ করে এই প্রতিষ্ঠানটি। প্রতিষ্ঠানটির বৈশ্বিক কার্যালয়ে গত বৃহস্পতিবার এক বৈঠকে সারাবিশ্বে কর্মী ছাঁটাইয়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এর আলোকে যুক্তরাষ্ট্রের অধীন কর্মীরা ওইদিন থেকেই চাকরি হারিয়েছেন। তবে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে সে দেশের শ্রম আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। বাংলাদেশে কর্মরত ৬ শতাধিক কর্মীর মধ্য অন্তত ৪৫০ জন চাকরি হারাতে যাচ্ছেন। তবে এ নিয়ে বাংলাদেশ কার্যালয়ের কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি।

অন্যদিকে ইউএসএআইডিকে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের সঙ্গে একীভূত করতে চাচ্ছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন। এরই মধ্যে সংস্থাটির ২ হাজার ৭০০ কর্মীকে ছুটিতে পাঠিয়েছে সরকার। তবে মার্কিন আদালত ওই সিদ্ধান্তের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়েছে। আদালতের আদেশের মাধ্যমে ইতিমধ্যে ছাঁটাই হওয়া প্রায় ৫০০ কর্মী কাজে পুনর্বহাল হয়েছে। এ ছাড়াও সবেতন ছুটিতে পাঠানো ইউএসএআইডির ২ হাজার ২০০ কর্মী কাজে ফিরতে পারবেন। একই প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও। এখানে কর্মরত ৬০-৭০ জন ইউএসএআইডির কর্মকর্তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফেরত যেতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। ঢাকাস্থ ইউএসএআইডিতে কর্মরত ২৫০-৩০০ বাংলাদেশি কর্মকর্তা পড়েছেন অনিশ্চয়তায়। এমনকি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সংস্থাটির ওয়েবসাইটও।

রোহিঙ্গা অর্থায়ন অব্যাহত থাকার কথা বলা হলেও ইউএসএআইডি তহবিলের অর্থ বরাদ্দ না থাকার অজুহাতে কেয়ার, সেইভ দ্য চিলড্রেনের মতো প্রতিষ্ঠানের অনেক কর্মীর বেতন নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। স্থানীয় অংশীজন ইপসা, বন্ধু, পালসের মতো এনজিওগুলো তাদের কর্মকাণ্ড স্থগিতের নোটিশ দিয়েছে কর্মীদের। অনেকের চাকরি চলে গেছে।

Manual5 Ad Code

বিশেষজ্ঞদের মতে, সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতা কার্যক্রম বন্ধের ঘোষণায় অনিশ্চতায় গণতন্ত্র ও সুশাসন, শিক্ষা, খাদ্য নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য কর্মসূচির মতো কর্মকাণ্ড। অর্থ-সহায়তা ৯০ দিনের জন্য স্থগিতাদেশ শেষে মূল্যায়নে যদি বাংলাদেশে অর্থায়নে মার্কিনিদের সুনজর না থাকে, তবে তা অশনিসংকেত হয়ে দেখা দেবে। যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর কোনো দেশ থেকে অর্থ সহায়তা প্রত্যাহার করে নিলে উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোও সেই পথ অনুসরণ করে। সেই ধারাবাহিকতায় সুইজারল্যান্ডও অর্থ সহায়তা বন্ধ করেছে। মূল্যায়নের সময় সমাপ্ত হওয়ার আগেই বাংলাদেশে উন্নয়ন সংস্থাগুলো এসব পদক্ষেপ নিয়েছে।

Manual1 Ad Code

যদিও ইউএসএআইডির ওয়েবসাইট বন্ধ, তবু কালবেলার কাছে সংরক্ষিত তথ্য অনুযায়ী প্রতিবছর আন্তর্জাতিক সাহায্য খাতে যুক্তরাষ্ট্র সারা বিশ্বে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেয়। যুক্তরাষ্ট্র আন্তর্জাতিক সাহায্যের জন্য ২০২০ সালে ৫২ বিলিয়ন, ২০২১ সালে ৫৩ বিলিয়ন, ২০২২ সালে ৭৬ বিলিয়ন, ২০২৩ সালে ৬৮ বিলিয়ন, ২০২৪ সালে ৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ২০২৩ ও ২০২৪ সালে ৪৪৯ মিলিয়ন ডলার, ২০২২ সালে ৪৬৯ মিলিয়ন ডলার, ২০২১ সালে ৫০০ মিলিয়ন ডলার, ২০২০ সালে ৫৭৩ মিলিয়ন ডলার সাহায্য পায়। ২০১৭ সাল পর্যন্ত মার্কিন যে সাহায্য পাওয়া যেত, তা জোরপূর্বক বাস্তচ্যুত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশের পর থেকে ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে।

Manual6 Ad Code

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code