ফুজেল আহমদ, টরেন্টো কানাডা :
সাতই সেপ্টেম্বর কানাডার টরেন্টো শহরের বাংলা টাউন খ্যাত ড্যানফোর্থ এরিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়ে গেল বিয়ানীবাজার সমিতির ত্রিবার্ষিক নির্বাচন।
বাংলা কমিউনিটিতে ৩০ বছরে পদার্পণ করতে যাওয়া বিয়ানীবাজার সমিতির এই নির্বাচন কে ঘিরে যে পরিমাণ উৎসাহ; উদ্দীপনা ,আনন্দ- উল্লাস এবং ভোটার সমাগম হয়েছে সেটা চমকে দিয়েছে এই কমিউনিটির সকল শ্রেণী পেশার মানুষকেই।
সকাল ১০ টা থেকে বিরতিহীন ভাবে সন্ধ্যা ০৮ টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয়েছে বিরামহীন ভোট গ্রহন। বিয়ানীবাজার সমিতির এই নির্বাচনে অরিজিন বিয়ানীবাজার এমন নাগরিকরাই ভোটার হবার যোগ্য ছিলেন। তবে সমিতির এক্টিভ মেম্বার হতে সেজন্য প্রত্যেক ভোটারকে দশ ডলার করে জমা দিয়ে মেম্বার হতে হয়েছে।
তন্মধ্যে ভোটার হওয়ার শেষ দিন পর্যন্ত নিবন্ধিত ভোটার হয়েছিলেন ১৪১৫ জন।
কার্যকরী কমিটির ২১ টি পদের এই নির্বাচনে সভাপতি- সাধারণ সম্পাদক এবং সাংগঠনিক সম্পাদক এই তিনটি পদে দুজন করে মোট ছয় জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
অন্য সম্পাদকীয় পদগুলোতে যারা নমিনেশন দিয়েছিলেন প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় তারা অটোমেটিক্যালি নির্বাচিত হয়ে যান।
ভোট উৎসবের এই দিনে ৬ প্রার্থীর পিপল কানেকশন এবং তাদের সমর্থকরা যেভাবে ভোটারদের ইনফ্লুয়েন্স করেছেন তাহা ছিলো বাংলাদেশের অতীতের নির্বাচনকালীন উৎসবের ন্যায় এক মহামিলন।
টরেন্টো এমন একটি শহর যেখানে বলা হয় “নো হানিমুন টাইম” ।
সেই ব্যস্ত টরেন্টো শহরে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ক্লান্তিহীনভাবে প্রার্থীরা ভোটারদের নক করে গিয়েছেন এবং ভোটাররা ও রেসপন্স করেছেন অভাবনীয় ভাবে।
যার ফলাফল প্রায় ৮৫% পার্সেন্ট অর্থাৎ ১১৪৫ টি ভোট কাস্ট হয়।
একই ব্যালেট থাকার কারণে; নির্ভুল ভোট গণনার সুবিধার্থে নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট পরিমাণ সময় এবং পরিশ্রম করে নির্ভুল ফলাফল ঘোষণা করতে করতে রাত দুপুর গড়িয়ে “সুবহে সাদেক” চলে আসছিল।
আশ্চর্যের ব্যাপার ছিল প্রার্থীদের শুভাকাঙ্ক্ষী ছাড়াও এই কমিউনিটির অন্যান্য বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক এবং উপজেলা- জেলা পর্যায়ের কমিউনিটি নেতারা রাত দুইটা- তিনটা পর্যন্ত সেই নির্বাচন ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত ওয়াচ টাওয়ারের মতো অপেক্ষায় ছিলেন নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের সামনে।
রাত দুইটার সময় যখন নির্বাচন কমিশন ভোটের ফলাফল ঘোষণা করেন তখন ও সমর্থকদের আনন্দ উল্লাস আর বাধঁভাঙ্গা হর্ষ ধ্বনি রাতের গভীরতাকে ভেদ করে বিদ্যুৎ চমকের মত চমকে দিয়েছিল পুরো এরিয়াকে।
সভাপতি হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী সরফুল ইসলাম ৬৬৪টি ভোট পেয়ে আগামী তিন বছরের জন্য বিয়ানীবাজার সমিতির সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হন।
তাহার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আবদুল হামিদ ভোট পেয়েছেন ৪৬৬ টি।
সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মেহেদী হাসান শরীফ ৫৭২ টি ভোট পেয়ে নির্বাচিত হন।
তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বাবুল খান। তিনি পেয়েছেন ৫৩৩ ভোট।

সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে দুই তরুনের লড়াইয়ে বিয়ানীবাজার স্পোর্টস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য সাইদুল ইসলাম ম্যাজিক দেখান। তিনি কাস্টিং ভোটের প্রায় ৭৫% ভোট পান।
তাহার ৭৯১ টি ভোটের বিপরীতে নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সুলতান আহমদ এর প্রাপ্ত ভোট ছিলো ২৮৯।
এই নির্বাচন নিয়ে প্রবাসীদের মধ্যে যে আবেগ -অনুভূতি এবং উচ্ছ্বাস পরিলক্ষিত হয়েছে তা দেখে চমকে গিয়েছেন কানাডার মূলধারার রাজনীতির পরিচিত মুখ স্কার্বোরো এরিয়ার বিগত জাতীয় নির্বাচনের এমপি ক্যান্ডিডেট ডাক্তার নুরুল্লাহ তুরন। তিনি নির্বাচন পরিদর্শিন করতে এসে বলেন -“নিজের পয়সা খরচ করে ভোটার হয়ে এবং এত ব্যস্ত নগরীতে ভোট দিতে এসে সারাদিন যেভাবে বাংলাদেশী আমেজে একটি উৎসবময় নির্বাচন উপহার দিয়েছেন প্রার্থী এবং তার সমর্থকরা সেটি অবিস্মরণীয়।
বাংলা নাটকের জনপ্রিয় অভিনেতা কামাল হোসেন বাবর বলেন- আমি কানাডাতে এত সুন্দর সুশৃংখল এবং দিনব্যাপী নির্বাচন এবং নির্বাচনী উত্তাপ দেখে অভিভূত।
ইউনাউটেড জালালাবাদ ফাউন্ডেশনের সভাপতি খসরুজ্জামান চৌধুরী দুলু বলেন -বিয়ানীবাজার সমিতি এই কমিউনিটির অন্যতম প্রাচীন সংগঠন এবং তাদের যে সুদূরপ্রসারী যে পরিকল্পনার ছাপ এবং ম্যানেজমেন্ট তার একটি নজির হয়ে থাকবে এই নির্বাচন।
রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং সংগঠক এমরুল ইসলাম জানান- আমরা অন্যান্য অঞ্চলে যারা সংগঠন করতেছি বা করার উদ্যোগ নিতেছি তাদের জন্য বিয়ানীবাজার সমিতি নির্বাচন একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।
অসোয়া থেকে নির্বাচন দেখতে আসা একাউন্টেন্ট মাহিন বলেন – অনুকরণীয় একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বিয়ানীবাজারের এত চমৎকার আয়োজন এবং সেটি সম্পূর্ণ করার লোকবল সহ সকল ধরনের ব্যবস্থাপনা।
নির্বাচন কমিশনের ভোট কাউন্টিংয়ে সবচাইতে বেশি উচ্চারিত নাম ছিল সাইদুল ইসলাম।
সেই সাইদুল ইসলামের নির্বাচনী প্রধান এজেন্ট সাইদুর রহমান সায়েম জানান -আমাদের প্রত্যাশা ছিল এমনই ;যেমনটি হয়েছে। স্পোর্টস এর লোক সাইদুল নির্বাচনে এসেও প্রমাণ করলেন সংগঠক হিসেবেও তিনি লিওনেল মেসির মতো ম্যাজিক দেখালেন।মেসির মতো ডিফেন্স ভাঙ্গার এই অধম্য স্পৃহা বিয়ানীবাজারের আগামীর সম্ভাবনার গোল মূখ উম্মুক্ত করে দিলো।
নির্বাচিত সাধারন সম্পাদক মেহেদী হাসান শরীফ জানান ভোটারদের ভোটের প্রতিদান দিতে আমি বদ্ধপরিকর।
চমৎকার এই নির্বাচনে নির্বাচিত হওয়া সভাপতি সরফুল ইসলাম জানান -আমার এই বিজয় বিয়ানীবাজারবাসীর বিজয়। এত সুন্দর- সুশৃংখল এবং পরিমার্জিতভাবে যেভাবে দিনব্যাপী উৎসবমুখর এই নির্বাচন হয়েছে সেটা বিয়ানীবাজারবাসীর ঐতিহ্য এবং ঐক্যের প্রতিফলন।
সরফুল ইসলামের প্রধান নির্বাচনী এজেন্ট সারোয়ার হোসেন সুমন বলেন -যে কোন পরিস্থিতিতে দেশে কিংবা বিদেশে আমরা বিয়ানীবাজারবাসী একত্রিত হলে যে কোন অসম্ভবকেই যে সম্ভব করা যায় সেটা কমিউনিটির অন্যান্য জায়গায় ও নজির স্থাপন দিয়ে করে দিয়ে গেলো এই নির্বাচন।
নির্বাচন কমিশনার তানভীর আহমদ চৌধুরী বলেন- এত সুন্দর নির্বাচন এবং আয়োজন সম্ভব হয়েছে সমর্থক ভোটার এবং বিয়ানীবাজারের সংগঠকদের ঐকান্তিক পরিশ্রমের কারণে। তিনি বিজয়ী এবং বিজিত সবাইকেই অভিনন্দিত করেন।
নির্বাচন কমিশনার সুহেল আহমদ বলেন- বাংলাদেশের অনেক নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করেছি কিন্তু প্রবাসে এসেও এত দীর্ঘ সময় বিরামহীন ভাবে নির্বাচন করা করা যেতে পারে সেটি আজ না করলে নিজেরই বিশ্বাস হতো না।
নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ জগলুল হক জানান বিয়ানীবাজারের সকল শ্রেণীর মানুষের এই ঐক্যবদ্ধ যাত্রা যেন অব্যাহত থাকে। আমরা এই নির্বাচন কে বিয়ানীবাজার বাসীর ফ্যামেলী রিইউনিয়িন হিসাবে আখ্যায়িত করতে পারি নির্ধিদ্বায়।
ঢাকার জালালাবাদ এসোসিয়েশনের অর্থসম্পাদক আব্দুল হান্নান জানান – বাংলাদেশের রাজনীতি করেছি; সামাজিক সংগঠন করেছি কিন্তু কানাডাতে এসে দেখলাম বাংলাদেশের যেভাবে ডোর টু ডোর ভোটারদের নক করা হয় এখানে ও তেমনটি হয়েছে এবং ভোটাররা ও সাড়া দিয়েছেন। বাস্তবে না দেখলে বিশ্বাসই হতো না । এতো ব্যস্ততার মধ্যেও মানুষকে তাহার শেকড় ভুলে যায়নি তারই নজির হয়ে রইল টরেন্টোর বিয়ানীবাজার সমিতির নির্বাচন।
Sharing is caring!