প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৮ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৩রা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৭শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

গুম কমিশন: ইলেকট্রিক শক দিলে পোড়া মাংসের গন্ধ পেতেন

editor
প্রকাশিত জুলাই ৮, ২০২৫, ০৯:১৮ পূর্বাহ্ণ
গুম কমিশন: ইলেকট্রিক শক দিলে পোড়া মাংসের গন্ধ পেতেন

Manual1 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

২৫ বছরের এক তরুণীর দুই হাত দুদিকে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। সরানো হয় গায়ের ওড়নাটাও। সামনে দিয়ে পুরুষরা যাওয়া-আসা করছে আর যা-তা বলছে। এত বেশি নির্যাতন করা হয় যে, নির্ধারিত সময়ের আগেই মাসিক শুরু হয়। নির্যাতনকারীদের কাছে প্যাড চাইলে এটা নিয়ে অনেক হাসাহাসি করতেন। মেয়েটি বলেছিলেন তিনি পর্দা করেন তবুও তার ওড়না কেড়ে নেওয়া হয়।

এটি কোনো সিনেমা কিংবা কাল্পনিক কাহিনি নয়। নয় কোনো ভিনদেশি ঘটনা। ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের আমলের বাস্তব চিত্র। ২০১৮ সালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ওই নারীকে গুম করে এমন পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়েছে। অসহায় ওই নারীর মতো এমন বহু মানুষ গুম হয়ে দিনের পর দিন চরম শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

 

মধ্যযুগীয় বর্বরতাকে হার মানানো অন্তত ১০ ধরনের নির্যাতন করা হতো গুম হওয়া অসহায় মানুষদের ওপর। যার মধ্যে রয়েছে চেয়ারে বসিয়ে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া, নখ উপড়ে ফেলা, শব্দনিরোধক কক্ষে নিয়ে চোখে গামছা বেঁধে কখনো যমটুপি পরিয়ে হাত ওপরে বেঁধে বেধড়ক পেটানো, উল্টো করে বেঁধে নির্যাতন, মুখের ওপর গামছা দিয়ে ওপর থেকে পানি ছাড়া, প্রস্রাবের সময় বৈদ্যুতিক শক দেওয়া, নির্মমভাবে মারধর, নখের নিচে সুচ ঢোকানো, বাঁশডলা ও যৌনভিত্তিক নির্যাতন ইত্যাদি।

 

নির্যাতনের এমন ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে গুম-সংক্রান্ত কমিশনের প্রতিবেদনে। সম্প্রতি গুম-সংক্রান্ত কমিশন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুম ও নির্যাতনের প্রাতিষ্ঠানিক দিক উন্মোচন করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। রাষ্ট্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীর বিশেষায়িত একটি ইউনিটের সহযোগিতায় এ নির্যাতন চালানো হতো বলে জানানো হয়েছে প্রতিবেদনে।

 

ওড়না কেড়ে অহরহ পুরুষের হাসাহাসি

প্রতিবেদনে গুমের শিকার ২৫ বছর বয়সী ওই নারীর কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৮ সালে পুলিশ তাকে অপহরণ করে ২৪ দিন গুম করে রাখে। ভুক্তভোগী ওই নারী কমিশনকে বলেন, অনেকটা ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার মতো করে হাত দুদিকে বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হতো। তারা আমার ওড়না কেড়ে নিয়ে হাসহাসি করতেন। যেহেতু জানালার দিকে মুখ করা ছিল, তাই আমাকে এভাবে দেখার জন্য অহরহ পুরুষ মানুষ যে কতজন এসেছে তা বলা কঠিন। তারা হাসাহাসি করতেন। বলাবলি করছিলেন যে, এতদিন এমন পর্দাই করছ যে- এখন সব পর্দা ছুটে গেছে।

 

Manual6 Ad Code

ওই নারী কমিশনকে আরও বলেন, আমার পিরিয়ড হওয়ার ডেট ছিল অনেক দেরিতে। কিন্তু আমার ওপর তারা এমনভাবে টর্চার করে যে তাতে আমি এত পরিমাণ অসুস্থ হয়ে যাই, সঙ্গে সঙ্গে আমার পিরিয়ড শুরু হয়ে যায়। তারপর তাদের বলি যে, আমার তো প্যাড লাগবে-তখন এটা নিয়ে অনেক হাসাহাসি করতেন বাহিনীর সদস্যরা।

 

ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে নির্যাতনের কথা জানালেও তা উপেক্ষা

Manual3 Ad Code

প্রতিবেদনের তথ্যমতে, গুম হওয়াদের রাখা হতো শব্দনিরোধক স্থানে। ফলে নির্যাতনের সময় ভুক্তভোগীদের চিৎকার বাইরের কেউ শুনতে পেতেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীদের গুম করার কোনো আনুষ্ঠানিক রেকর্ড থাকত না। ফলে নিরাপত্তা বাহিনী দায়মুক্তভাবে নির্যাতন চালাতে পারত। বর্বর নির্যাতনের জেরে গুম হওয়াদের শরীরে ফুটে ওঠা ক্ষত মুছতে তাদের ক্ষতস্থানে দেওয়া হতো ওষুধ বা মলম। জনসমক্ষে আনার পর ক্ষত বা নির্যাতনের চিহ্ন যেন না দেখা যায় তার জন্যই এমনটি করা হতো। অনেক ক্ষেত্রে নির্যাতনের চিহ্ন মুছে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেই তাদের মুক্তি দেওয়া হতো। তবে অনেক ভুক্তভোগী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির হয়ে স্পষ্ট নির্যাতনের চিহ্ন দেখালেও সেসব অভিযোগ উপেক্ষা করা হয়।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আওয়ামী আমলে কথিত সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানতে টার্গেট করা ব্যক্তিদের গুম করার পর বিশেষ সেলে রাখা হতো। সেখানে তাদের ওপর চলতো ভয়াবহ নির্যাতন। শিফটিং সিস্টেমে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিভিন্ন পদ্ধতিতে নির্যাতন চালানো হতো। কখনো ঝুলিয়ে পেটানো হতো, আবার কখনো আঙুলের নখ উপড়ে ফেলা হতো; এমনকি কখনো বৈদ্যুতিক শক দেওয়া হতো। এতে অনেকে অজ্ঞান হয়ে যেতেন, বমি করে দিতেন, আবার কেউ কেউ চোখ বাঁধা অবস্থায় নিজের শরীরের মাংস পোড়ার গন্ধ পেতেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভয়াবহ নির্যাতনের প্রমাণ ধ্বংসের চেষ্টা সত্ত্বেও কমিশন এমন কিছু উপাদান সংগ্রহ করেছে, যা ভুক্তভোগীদের সাক্ষ্যের সঙ্গে মিলে যায়। বিশেষ করে র‌্যাব-২ এবং কমান্ড অ্যান্ড প্লাটুন কোম্পানি (সিপিসি)-৩ এ ব্যবহৃত ঘূর্ণায়মান চেয়ার, টিএফআই সেলে মানুষকে ঝুলিয়ে রাখার জন্য ব্যবহৃত পুলি-সিস্টেম এবং একাধিক স্থানে শব্দনিরোধক ব্যবস্থা।

Manual8 Ad Code

 

ঘুমাতে দিতেন না নিরাপত্তা প্রহরীরা

৩৯১ দিন গুম থাকা ৪৬ বছর বয়সী এক ব্যক্তি কমিশনকে জানিয়েছেন, পুরুষ ভুক্তভোগীদের রাখার সেলগুলো ছিল ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ। সেলে টয়লেট ব্যবহারের জন্য নিচু বিল্ট-ইন প্যান বসানো ছিল। মাঝে কোনো দেওয়াল না থাকায়, ভুক্তভোগীরা যখন শুয়ে থাকতেন, তখন তাদের শরীর প্রায়শই ওই প্যানের ওপরেই পড়ে থাকত। ফলে তাদের ময়লা, প্রস্রাব ও মলের অস্বাস্থ্যকর অবস্থার মধ্যে থাকতে হতো।

এছাড়া এসব সেলে সিসি ক্যামেরা দিয়ে প্রতিটি কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করা হতো। ফলে ভুক্তভোগীদের সবচেয়ে ব্যক্তিগত মুহূর্তেও, যেমন প্রাকৃতিক কাজের জন্য টয়লেট প্যান ব্যবহারের সময়ও চরম অপমান ও লজ্জার মধ্যে থাকতে হতো। ঠিকমতো ঘুমাতেও দিত না নিরাপত্তা প্রহরীরা।

 

২০২৩ সালে সিটিটিসিতে ১৬ দিন গুম ছিলেন ৪৭ বছর বয়সী এক ব্যক্তি। তিনি বলেন, চোখ কখনো গামছা দিয়ে, কখনো জম টুপি দিয়ে বাঁধা থাকত। হাত কখনো সামনে, কখনো পেছনে। আর যখন বেশি মারবে, তখন এই হাত পেছনে দিয়ে রাখত আর আমার এই কনুইগুলো, দুই হাঁটু এগুলোতে খুব জোরে জোরে মারত মোটা লাঠি দিয়ে। আমি মনে করতাম যে, আমার হাড়গুলো বুঝি ভেঙে যাবে, কিন্তু পরে দেখলাম যে ফুলে অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে, কিন্তু হাড় ভাঙছে এ রকম বুঝি নেই। এক পর্যায়ে আমাকে বলল যে, তোর হাড় থেকে মাংস আলাদা করে ফেলব।

 

মাথা নিচের দিকে, পা ওপর দিকে দিয়ে টর্চার

র‌্যাব-১১ এ গুম হওয়া এক যুবক বলেন, তার পা বেঁধে ওপর দিকে ঝুলিয়েছে। মাথা নিচের দিকে, পা ওপর দিকে দিয়ে। শরীরে কোনো পোশাক রাখে নাই তখন। তারপর এলোপাতাড়ি আমাকে দুজনে একসঙ্গে পেটাতে থাকে। খুব সম্ভব বেতের লাঠি দিয়ে। পরে আমাকে অসংখ্যবার টর্চার করেছে এবং মারতে মারতে আমার এমন হয়েছে, চোখের কাপড় খুলে গেছে। নাকে-মুখে চড়ানো, থাপড়ানো। শুধু পিছে মারছে। ওই সময় চামড়া ছিঁড়ে, মানে চামড়া ফেটে রক্ত ঝরেছে।

 

Manual5 Ad Code

এই ভুক্তভোগীকে সিটিটিসিতে টানা প্রায় ২৪ ঘণ্টা ধরে নির্যাতন করা হয়েছিল, নির্যাতনকারীরা পালাক্রমে চার ঘণ্টার শিফটে তাকে মারধর করত। তার শরীরজুড়ে এখনো স্থায়ী আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এই নির্যাতনের ঘটনা একজন সহবন্দি নিশ্চিত করেন, যিনি সেই সময় তার কষ্ট স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিলেন।

 

র‌্যাব-১১ এ ৪২ দিন গুম থাকা আরেক ব্যক্তি বলেন, ‘হাত সম্ভবত গামছা বা কাপড় দিয়া বেঁধেছে। বেঁধে, আমার এই হাঁটুর ভেতরে দিয়া হাত ঢুকাইয়া এই দুই হাঁটুর মাঝখান দিয়া লাঠি ঢুকাইয়া একটা উঁচু কোনো স্ট্যান্ডের মধ্যে রাখছে। যেটার কারণে আমার পাগুলো ওপরে ছিল। আর মাথা নিচু হয়ে গেছে। পায়ের তালুর মধ্যে এবার বাড়ি শুরু করেছে। চিকন একটা লাঠি হবে সম্ভবত। আবার ওই প্রথম থেকে একই প্রশ্ন, নামগুলা বল, তোমার সঙ্গে কে কে আছে।’

৫৬ বছর বয়সী এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, নির্যাতনের এক পর্যায়ে আঙুলের নখ উপড়ে ফেলা হয়।

আঙুলে সুচ ঢোকানো হতো

র‌্যাব-১০ এ গুমের শিকার এক ব্যক্তি জানিয়েছেন, গ্রিলের মধ্যে হ্যান্ডকাফ দিয়ে আমাকে দাঁড় করিয়ে রাখত। আমি যেন বসতে না পারি। পা খুব ফুলে গিয়েছিল আমার। হাতে দাগ পড়ছে। এই যে দাগগুলো… ওয়াশরুমে যেতে চাইলে, ওয়াশরুমে যেতে দিত না। এই অত্যাচার শুরু হয়ে গেলো। এর মধ্যে একদিন এসে আঙুলটাকে এভাবে প্লাস দিয়ে ধরছে। ধরার পরে টেবিলের ওপর হাত রেখে, প্লাস ধরে, আরেকজন সুচ ঢুকিয়েছে। এই যে সুঁইয়ের দাগ। কয়, তুই আবদুল মুমিন না? স্যার, আমি আবদুল মুমিন না, আমার নাম হলো হাবিব।

 

কাপড় খুলে গোপনাঙ্গে নির্যাতন

২০১০ সালে র‌্যাবে ৪৬ দিন গুম থাকা এক যুবক জানিয়েছেন, পায়ে দুইটা ক্লিপ লাগিয়ে দিলো, প্রথম শক খাওয়ার অভিজ্ঞতা। মনে হচ্ছে যখন শক দেয়, টোটাল শরীরটা আমার ফুটবলের মতো গোল হয়ে যায়। এরকম আট-দশবার আমাকে শক দিয়েছে। শকটা হয়তো তিন-চার সেকেন্ড সর্বোচ্চ থাকে। তাৎক্ষণিক শরীরটা গোল হয়ে যায়, রগগুলো চেপে ধরে তো ওই প্রশ্নগুলো করে আর শক দেয়, প্রশ্নগুলো করে আর শক দেয়। খুবই বেপরোয়াভাবে চার-পাঁচজন পেটানো শুরু করে, দুই হাত ধরে ওই হুকের ওপর লাগায় দিয়ে। মনে হচ্ছে হয়তো কিছুতে সুইচ টিপছে, অটোমেটিক আমার শরীরটা ওপরে উঠে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে আমার কাপড় খুলে, আবার ওই একই ক্লিপ লাগায় দেয় আমার গোপন দুইটা অঙ্গে এবং একই জিজ্ঞাসাবাদ চলতে থাকে। যখনই সুইচ দেয়, আমার মনে হয়েছে যে, আমার সে অঙ্গগুলো পুড়ে যাচ্ছে এবং মাঝে মাঝে আমি গোশত পুড়লে যে রকম একটা গন্ধ লাগে, সেই গন্ধটা পেতাম।

এছাড়া একাধিক ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, মুখের ভেতর গামছা দিয়ে পানি দেওয়া, ঘূর্ণায়মান চেয়ারে বসিয়ে নির্যাতন, প্রস্রাবের সময় বৈদ্যুতিক শক, গোপনাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক দেওয়া ছিল নিত্যদিনের ঘটনা।

 

যৌনাঙ্গে বৈদ্যুতিক শক

যৌনাঙ্গকে নির্যাতনের লক্ষ্যবস্তু করার বর্ণনা তুলে ধরে ৩৯ দিন গুম থাকা একজন বলেন, ক্লিপ দিয়ে কারেন্ট শক দেওয়া শুরু হয়ে গেছে। গাড়ির মধ্যে খুব চেঁচাচ্ছি …. দুই পা সামনের সিটে লাফানোর কারণে আমার প্রায় এক ফুট করে দুই পা ছিলে যায়। কিন্তু ওইটার ব্যথা কিছু মনে হয়নি। কারেন্ট শকের ব্যথা এতটা ভয়ংকর।

 

কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মুক্তির পরও নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরা দীর্ঘমেয়াদি মানসিক ট্রমার স্পষ্ট লক্ষণ বহন করেন। তাদের চলমান চিকিৎসা ও মনোস্বাস্থ্য সহায়তার প্রয়োজন হয় এবং অনেকের শিক্ষা ও কর্মজীবন ব্যাহত হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় নিরাপত্তা বাহিনীর দায়ের করা ভুয়া মামলাগুলোর আইনি লড়াইয়ের ব্যয়। প্রতিটি মামলার জন্য একজন ভুক্তভোগীর গড়ে প্রায় ৭ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। অনেকের পারিবারিক জীবন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পরিবারগুলো এই চাপ সহ্য করতে পারে না, ফলে ভুক্তভোগীরা এক অনিশ্চয়তা ও প্রান্তিকতার জীবনে আটকে পড়েছেন।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual2 Ad Code