প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৬ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১লা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৫শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

জটিল ভূরাজনৈতিক চাপে বাংলাদেশ

editor
প্রকাশিত জুলাই ২৮, ২০২৫, ১১:২৬ পূর্বাহ্ণ
জটিল ভূরাজনৈতিক চাপে বাংলাদেশ

Manual2 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কচাপ, ভারতের বৈরিতা, মালয়েশিয়ায় জঙ্গি আটক, ইউরোপের পর্যবেক্ষণ, একাধিক দেশের ভিসা জটিলতা, ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার অফিস খোলা-ইত্যাদি একাধিক ইস্যুতে বাংলাদেশ জটিল ভূরাজনৈতিক চাপ মোকাবিলা করছে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না। এ ছাড়া এখনও স্থিতিশীলতা ফেরেনি, যে কারণে চাপ বেশি হচ্ছে। আবার অন্তর্বর্তী সরকার অনির্বাচিত বলে বড় দেশগুলো চাপ প্রয়োগ করে দুর্বলতার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

 

Manual4 Ad Code

কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় চাপ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ইস্যু। এই ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রকে সন্তুষ্ট করতে বাংলাদেশ অনেক ছাড় দেওয়ার কথা ভাবছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন পণ্যের আমদানির চিন্তা করছে। যার মধ্যে গম ও জ্বালানি অন্যতম। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে বাণিজ্য ইস্যুতে বাংলাদেশ যদি বিশেষ ছাড় দেয় তবে অন্য যে দেশগুলোতে বাংলাদেশ পণ্য রফতানি করে সেসব দেশ কী ছাড় চাইবে না? এরই মধ্যে ইউরোপ বাণিজ্য ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ দরকষাকষির ওপর গভীর নজর রেখেছে। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে ইউরোপের দেশগুলো বাংলাদেশের জন্য প্রধান গন্তব্যস্থল। যুক্তরাষ্ট্রকে বাণিজ্যে বাংলাদেশ যদি বিশেষ সুবিধা বা ছাড় দেয় তবে অন্য দেশকেও তা দিতে হবে। আবার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গোপন চুক্তির কথা শোনা যাচ্ছে, যা ভয়ংকর।

Manual1 Ad Code

 

অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে, ‘বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কোনো পার্টনার (অন্য দেশ) কোনো দিন এনডিএ (নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট) ডকুমেন্ট দেয়নি। এর বদলে নন-পেপার ইস্যু করা যেত, যার অর্থ হলো এটি আমার অবস্থান, কিন্তু আমি নিজে স্বাক্ষর করব না। নন-পেপার হলে রেসপন্সিবিলিটি তৈরি হতো, কিন্তু এখন বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়ে গেছে। এখন যদি বাংলাদেশ কোনো লবিস্ট নিয়োগ করে, তার কাছেও এ তথ্য প্রকাশ করা যাবে না।’

 

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কচাপের পেছনে অন্য কারণ আছে। যার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে চীনকে প্রতিহত করা। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অস্ত্র বিত্রি করতে চায়। যা তারা বেশ কয়েক বছর আগে থেকেই চাপ দিচ্ছিল। চীন মিয়ানমারে কৌশলগতভাবে অবস্থান শক্তিশালী করায় যুক্তরাষ্ট্রও চাচ্ছে যে বঙ্গোপসাগরে তাদের অবস্থান দৃঢ় করতে, এখানেই বাংলাদেশের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ চাহিদা রয়েছে।

 

অন্যদিকে গত ৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশিদের জন্য এখনও ভারতের ভিসা স্বাভাবিক হয়নি। উল্টো প্রতিদিনই ভারত বাংলাদেশে পুশইন করছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ) সংস্থা জানিয়েছে, ভারতের সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর অনেক মুসলমান, যারা প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় নাগরিক তাদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী আখ্যা দিয়ে জোরপূর্বক বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এইচআরডব্লিউয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ৭ মে থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত ভারত দেড় হাজারেরও বেশি মুসলমান নারী, পুরুষ ও শিশুকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে।

Manual5 Ad Code

 

বিতাড়িতদের মধ্যে প্রায় ১০০ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীও আছে। এইচআরডব্লিউর এশিয়া বিভাগের পরিচালক ইলেইন পিয়ারসন এক বিবৃতিতে বলেছেন, বাংলাভাষী মুসলমানদের যথেচ্ছভাবে দেশ থেকে বের করে দিয়ে ভারতের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সরকার বৈষম্যের সংস্কৃতি তৈরি করছে। এতে করে বহু ভারতীয় নাগরিকও বিদেশি হিসেবে বিপাকে পড়ছেন।

 

Manual8 Ad Code

এ ছাড়া বাংলাদেশিদের এখনও অনেক দেশের ভিসা পেতে কষ্ট হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই মালয়েশিয়ার এয়ারপোর্ট থেকে বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। অনিয়মিত পথে বিদেশ পাড়ি দেওয়ায় ইতালি সরকার বাংলাদেশিদের ওপর বিরক্ত। যার রেশ ধরে ইতালির প্রধানমন্ত্রী আগস্টে ঢাকা আসছেন। ভিসা জটিলতার পেছনে মূলত বাংলাদেশিরাই দায়ী। বাংলাদেশ ভিসা নিবন্ধনে মিথ্যা তথ্য দেওয়াতেই এই জটিলতা বেড়েছে। আবার মালয়েশিয়ায় জঙ্গি অভিযোগে একাধিক বাংলাদেশির বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। শেষ পর্যন্ত এই ইস্যু কোনদিকে যাবে তা এখনও বলা যাচ্ছে না।

 

সাবেক রাষ্ট্রদূত মাহফুজুর রহমান বলেন, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো, এমন না। ওপরে ওপরে জনমানসে বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে সরে চীনের দিকে ঝুঁকছে মনে হচ্ছে। ভেতরের চিত্র ভিন্ন। চীনের সঙ্গে ভারতের না, বরং যুক্তরাষ্ট্রের টানাপড়েনে বাংলাদেশ বেকায়দায় আছে। বিশ্বায়নের যুগে সব দেশকেই সব দেশের দরকার। বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব সেভাবেই নিরুপিত। বাকিটা বাংলাদেশের সঙ্গে ভারত ও চীনের ভৌগোলিক নৈকট্য দ্বারা নির্ধারিত। বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে চীনের ক্রমবর্ধমান উত্থানের ফলে বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত মহাসাগরে চীনের অ্যাকসেস গুরুত্বপূর্ণ। এখানে মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের কার্যকর সম্পর্ক থাকায় চীন অনেকটা নির্ভার। চীন কেবল বাংলাদেশকে বৈরী অবস্থায় দেখতে চায় না। কিন্তু রোহিঙ্গা শরণার্থী ও আরাকান আর্মির উপস্থিতির কারণে বাংলাদেশ নিশ্চুপ থাকতে পারছে না। সেখানে বাংলাদেশের স্বাভাবিক অবস্থান চীনের জন্য নাজুক পরিস্থিতি তৈরি করছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ সঙ্গত কারণে পশ্চিমের দিকে ঝুঁকে আছে। এটি নিরসনে রোহিঙ্গা-আরাকান-মিয়ানমার নিয়ে আন্তর্জাতিক শীর্ষ সম্মেলন একটা সমাধান হতে পারত। সে সম্মেলন আহ্বানের সামর্থ্য বাংলাদেশের নেই। জাতিসংঘ, ওআইসি বা আসিয়ান এমন সম্মেলনে উদ্যোগ নিতে পারত। দুর্ভাগ্য এদের কারও সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক নেই। এ জন্য বাংলাদেশ এখন অনেক নাজুক ও বেকায়দা অবস্থায় আছে। যদি সরকার স্মার্ট ও ম্যাচিউর না হয়, আমরা আরও নাজুক অবস্থায় পড়ব।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, কয়েকটা বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ চাপের মধ্যে আছে। যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কচাপ অন্যতম। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের এই শুল্কচাপ শুধু বাংলাদেশের ওপরই না ওয়াশিংটন তাদের বন্ধু রাষ্ট্রের ওপরও এই চাপ দিচ্ছে। আমরা এখন বিশ্বায়নের যুগে আছি। দেখতে হবে যে আমাদের প্রতিযোগীদের ক্ষেত্রে কী পরিমাণ শুল্ক প্রয়োগ করা হচ্ছে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে সবাই স্থিতিশীলতা চায়। সবাই যেটি চায় সেটি হচ্ছে যে এখানে বিনিয়োগ করে উৎপাদনের পর পণ্য সময়মতো জাহাজে ওঠাতে পারবে কি না সবাই সেই নিশ্চয়তা চায়, যেখানে আমাদের দুর্বলতা আছে। এখন যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক ইস্যুতে আমাদের ছাড় দিলেও অন্য বিষয় চাপিয়ে দিতে পারে। এই ঝুঁকি রয়েছে। কারণ যেহেতু বাংলাদেশে এখন নির্বাচিত সরকার নেই, তাই যুক্তরাষ্ট্র সেই সুযোগটা নেওয়ার শতভাগ চেষ্টা অব্যাহত রাখবে। এর মধ্যে শোনা যাচ্ছে যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশ গোপন চুক্তিতে রাজি আছে। যার অর্থ হচ্ছে আমাদের যে দুর্বলতা আছে তা যুক্তরাষ্ট্র ধরে ফেলেছে। এখানে চিন্তা বা ঝুঁকির বিষয় আছে। আবার বাংলাদেশ যদি যুক্তরাষ্ট্রকে শুল্ক ইস্যুতে ছাড় দেয় তবে বাকিরা কী ছেড়ে দেবে? ইউরোপ, চীন ও জাপানসহ বাংলাদেশের যেসব রফতানি গন্তব্য রয়েছে তারাও তখন এই সুবিধা চাইবে। এসব ইস্যুতে দরকষাকষি করার জন্য যে রকম পেশাদারিত্বের অভিজ্ঞতার প্রয়োজন হয় সেখানে আমাদের দুর্বলতা আছে। দরকষাকষির পূর্ণ পেশাদারিত্ব হিসেবে আমরা এখনও নিজেদের প্রস্তুত করতে পারিনি। এ জন্যই আমরা সবার কাছে মার খাই। সবকিছু মিলিয়ে ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশ চাপে আছে। যার পেছনের মূল কারণ হচ্ছে আমাদের এখানে এখনও স্থিতিশীলতার অভাব রয়েছে। কয়েক দিন পরপরই বিভিন্ন ঘটনায় পরিবেশ অস্থিতিশীলতায় ডুবে যায়। তাই নির্বাচন যতবেশি দেরিতে হবে অস্থিতিশীলতা তত বাড়বে, সে সঙ্গে চাপও বাড়বে।

 

সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সী ফায়েজ বলেন, দৃশ্যমান পরিস্থিতি থেকেও জটিল ভূরাজনৈতিক চাপে আছে বাংলাদেশ। চীনের সঙ্গেও বাংলাদেশ ঝেড়ে কাঁশছে না। চীনকে ঠেকাতেই মূলত যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কচাপ। আমরা যতক্ষণ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের খপ্পর থেকে বেরিয়ে আসতে না পারব-ততক্ষণ কারোর সঙ্গেই সম্পর্ক ভালো হবে না। আবার বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে একেক সময় একেক রকম কথা বলছে। যেমন মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের কাজ চীনসহ অনেকেই চেয়েছিল কিন্তু কাজটা জাপানকে দেওয়া হলো। চীন পেল পায়রা বন্দর। এখন প্রধান উপদেষ্টা জাপান সফরে গিয়ে মাতারবাড়ীকে অনেক বড় করে দেখিয়ে পায়রা বন্দরকে খালের সঙ্গে তুলনা দিলেন। এখানে চীনকে খাটো করা হলো। এতে চীন কিন্তু খুশি হয়নি। মূলত বাংলাদেশ ঠিক করতে পারছে না যে কখন কী করতে হবে। একবার এদিকে যায় তো আরেকবার ওইদিকে যায়।

 

একজনকে দিয়ে আরেকজনকে খাটো করা, এগুলো পুরোনো আমলের কূটনৈতিক কৌশল। অন্তর্বর্তী সরকার এখনও প্রমাণ দিতে পারেনি যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ সবার সঙ্গে আছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজে অন্যরা হস্তক্ষেপ করছে। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি সঠিকভাবে চলছে না, লক্ষ্যহীনভাবে চলছে। একবার করিডর বলছে, আবার বলছে মানবিক চ্যানেল, সবকিছু লেজেগোবরে করে ফেলছে।

 

অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এবং সাবেক রাষ্ট্রদূত শহীদুল হক বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর শুল্ক, ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলসহ নানা ইস্যুতে বিশ্বের সব দেশই চাপে আছে। এর মধ্যে ভূ-কৌশলগত অবস্থানের দিক থেকে বাংলাদেশ একটা ফানেলের ভেতর আছে। শুল্ক ইস্যুতে ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে যে ছাড় পেয়েছে তা আমাদের জন্য ঝুঁকি। ভারতও যদি এমন ছাড় পায় তবে বাংলাদেশ আরও জটিল ঝুঁকিতে পড়বে। শুল্ক ইস্যুতে আলোচনায় সরকার কেন ব্যবসায়ীদের অন্তর্ভুক্ত করেনি তা বোধগম্য নয়। মালয়েশিয়ায় জঙ্গি ইস্যুতে বাংলাদেশ যে দুর্নামে জড়িয়েছে সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। আবার আমার মনে হয় যে চীন এখনও অনেক কিছু পর্যবেক্ষণ করছে।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual5 Ad Code