প্রজন্ম ডেস্ক:
নির্বাচনের ‘হাওয়া বুঝে’ রাজনৈতিক দল গঠনের হিড়িক পুরোনো চিত্র। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছরে যেভাবে ‘নতুন দল’ গজিয়ে উঠেছে, তা চোখে পড়ার মতো। নামসর্বস্ব এসব দলকে ‘কিংস পার্টি’ বলে আখ্যায়িত করছেন দেশের নির্বাচন বিশ্লেষকরা। নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধনের আবেদনের জোয়ার বয়ে গেছে। দেশে তৈরি হয়েছে ৩০টির বেশি নতুন দল, যাদের অনেকেরই অস্তিত্ব বাস্তবে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সাইনবোর্ড-সর্বস্ব এসব দলের ঠিকানায় গিয়ে দেখা যায় চশমার দোকান, মাদ্রাসা, ঠিকাদারের অফিস, থাকার ঘর, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান।
ইসি সূত্র জানায়, নির্বাচন সামনে রেখে ইতোমধ্যে ১৪৫টি দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। এর মধ্যে ৬৫টি দল ছিটকে গেছে প্রাথমিক যাচাই-বাছাইয়ে। বাকি ৮০টি দলের নথিপত্র পর্যালোচনা করছে কমিশন। এসব দলের একটি বড় অংশই অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেওয়ার পর গত এক বছরে আত্মপ্রকাশ করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন এলেই নতুন রাজনৈতিক দল গঠন, দল বদল বা জোট গঠনের চেষ্টা বেশ পুরোনো।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘কিংস পার্টি’ গঠন করা হয়েছে। এ বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে (গত ৪ আগস্ট এক সংবাদ সম্মেলন) টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান এনসিপিকে কিংস পার্টি হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি বলেন, এর সঙ্গে সহযোদ্ধা বা সহযাত্রী হিসেবে যারা আছেন, তাদের মধ্যে দুজন এখনো সরকারে আছেন। সে হিসাবে কিংস পার্টি।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. মো. আবদুল আলীম বলেন, যে দলগুলো হয়েছে সেগুলো নিবন্ধনই পাবে না। কারণ ইসির শর্ত পূরণ করতে পারবে না। ইসি সময় বাড়িয়ে দিলেও ওই সব দল শর্ত অনুযায়ী তথ্য দিতে পারেনি। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে রাজনৈতিক দল মানে ব্যবসা। একবার কোনোভাবে এমপি হলে সে সেখানকার জমিদার। বড় দলের সঙ্গে জোট বেঁধে একবার এমপি হলে ব্যবসা-টেন্ডার-চাঁদার ভাগ অটো পাওয়া যায়। এসব লক্ষ্য থেকে দল গঠন করেন তারা।’
বছরখানেকের মধ্যে গঠন হওয়া এসব দলের মধ্যে রয়েছে- জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), বাংলাদেশ বেকার মুক্তি পরিষদ, বাংলাদেশ বেকার সমাজ (বাবেস), বাংলাদেশ বেস্ট পলিটিক্যাল পার্টি, নাকফুল বাংলাদেশ, ইসলামী গণতান্ত্রিক পার্টি (আইজিপি), বাংলাদেশ নাগরিক কমান্ড, বাংলাদেশ জনগণের দল, বাংলাদেশ একাত্তর পার্টি, বাংলাদেশ দেশপ্রেমিক প্রজন্ম, বাংলাদেশ ছাত্রজনতা পার্টি, বাংলাদেশ সল্যুশন পার্টি, বাংলাদেশ সংগ্রামী ভোটার পার্টি ও বাংলাদেশ প্রবাসী কল্যাণময় পার্টি, নিউক্লিয়াস পার্টি অব বাংলাদেশ (এনপিবি), জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক পার্টি, ওয়ার্ল্ড মুসলিম কমিউনিটি, সমতা পার্টি, বাংলাদেশ জনপ্রিয় পার্টি (বিপিপি), সার্বভৌমত্ব আন্দোলন, বাংলাদেশ জাগ্রত পার্টি, বাংলাদেশি জনগণের পার্টি, বাংলাদেশ সর্ব-স্বেচ্ছা উন্নয়ন দল, বাংলাদেশ আম জনগণ পার্টি, বাংলাদেশ রিপাবলিক পার্টি (বিআরপি) ইত্যাদি।
সর্বশেষ গত বুধবার বিএনপির ১২-দলীয় জোটে থাকার ঘোষণা দিয়ে ‘ইউনাইটেড লিবারেল পার্টি’ (ইউএলপি) নামে নতুন দলের আত্মপ্রকাশ হয়। দলের চেয়ারম্যান মো. আমিনুল ইসলাম, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব হিসেবে কামরুজ্জামান খান দায়িত্ব পেয়েছেন। দলের বিষয়ে চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম বলেন, তিনি দীর্ঘদিন ধরে ১২-দলীয় জোটের সঙ্গে আছেন। আগামী দিনে যা-ই হোক, তার দ্বারা অনৈতিক কিছু হবে না। জোটের সিদ্ধান্তের বাইরে তিনি যাবেন না। ১২-দলীয় জোটের মতো তিনিও বিএনপির সঙ্গে থাকবেন।
ইসিতে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে ‘বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক পার্টি’। নথিতে দেওয়া আছে দলটির সভাপতি মো. জাহাঙ্গীর হাওলাদার। দলের সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন সভাপতির স্ত্রী মাহমুদা সুলতানা। আবেদনে দলটির কার্যালয়ের ঠিকানা দেওয়া আছে ৬৩৯/বি, পেয়ারাবাগ, মগবাজার, ঢাকা। ওই ঠিকানায় গিয়ে দেখা যায়, টিনের ছাউনি ও ক্ষয়ে যাওয়া দেয়ালের একটি কক্ষ, যা তাদের থাকার ঘর। সেটি আবার বাংলাদেশ ডেমোক্রেটিক পার্টির কার্যালয়ের ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
দলের বিষয়ে জাহাঙ্গীর বলেন, ঢাকার ভেতরে ও বাইরে দলের ৭৫ সদস্যের কমিটি রয়েছে। তালিকা দেখাতে না পারলেও দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে স্ত্রী মাহমুদা সুলতানার কথা জানান তিনি।
নিবন্ধনের জন্য গত ২৯ মে নির্বাচন কমিশনে আবেদন করে বাংলাদেশ বেকার সমাজ (বাবেস)। দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ঠিকানায় দেওয়া হয়েছে ধানমন্ডির ক্রিসেন্ট রোডের একটি বাড়ি। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মো. হাসানের ছেলে এই বাড়িতে থাকেন। বাড়ির তৃতীয় তলায় ছেলের বাসার ড্রয়িংরুম দলীয় কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। দলের সভাপতি মো. হাসান বলেন, বড় দল ছাড়া বাকিদের সেভাবে কার্যালয় নেই। তাই আপতত বাসাটি অস্থায়ী কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। গত ৪০ বছর বেকার সমাজ রাজনীতি করে আসছে।
বিগত নির্বাচনে নিবন্ধনের আবেদন: ড. এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন ২০০৮ সালে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিবন্ধনের আওতায় আনার উদ্যোগ নেয়। নবম সংসদ নির্বাচনের আগে নিবন্ধনের জন্য ১১৭টি দল আবেদন করেছিল।
দশম সংসদ নির্বাচনের আগে ৪৩টি দল নিবন্ধন পেতে আবেদন করেছিল। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নিবন্ধন পেতে আবেদন করেছিল ৭৬টি দল। ২০২৪ সালে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে নিবন্ধন পেতে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) ৯৩টি আবেদন করা হয়েছিল।
Sharing is caring!