প্রজন্ম ডেস্ক:
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিনিয়ত অনেক মানুষের প্রাণহানির পরও দেশের সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্পে গতি দেখা যাচ্ছে না। স্থানীয় অর্থায়ন ও বিশ্বব্যাংকের ঋণে দুই বছর আগে এক উচ্চাভিলাষী প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও সেই উদ্যোগে অগ্রগতি মাত্র দশমিক ১৯ শতাংশ। কাজে ধীরগতির জন্য গত অর্থবছরে এই প্রকল্পের বরাদ্দ থেকে ১৮০০ কোটি টাকার ঋণ ফেরত নিয়ে গেছে বিশ্বব্যাংক। এখন কর্তিত বাজেটেই বাংলাদেশ সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ নতুন করে শুরু হয়েছে।
এই প্রকল্পে বিশ্বব্যাংক প্রাথমিকভাবে ঋণ বরাদ্দ দেয় ৩ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা। টাকা ফেরত নেওয়ার পর এই প্রকল্পে এখন বিশ্বব্যাংকের তহবিল ১ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা। প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকারের বরাদ্দ আছে ১ হাজার ২২৪ কোটি টাকা। এখন ৩১৮৩ কোটি টাকার বাজেটেই প্রকল্পটি এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। প্রকল্পটি আগামী ২০২৮ সালের ১২ জুনের মধ্যে শেষ করার কথা রয়েছে।
চলতি বছরের ডিসেম্বর অথবা আগামী বছরের জানুয়ারির মধ্যে দুটি প্যাকেজে এই প্রকল্পের অধীনে সড়ক অবকাঠামো সংস্কারের কাজ শুরু হবে। প্রকল্প বাস্তবায়নে কেনাকাটাও গতি পেয়েছে। সবমিলিয়ে প্রথম ধাপে ব্যয় হবে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এ প্রকল্পটি চলমান রয়েছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে অংশগ্রহণ করছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ), বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ), হাইওয়ে পুলিশ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
সিসিজিপিতে গরিমসি, ফেরত গেছে ১৮০০ কোটি টাকা
২০২৩ সালের ১ মে থেকে শুরু হওয়া সড়ক নিরাপত্তা খাতের এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকা। প্রাথমিকভাবে গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে এলেঙ্গা (এনএইচ ৪) এবং নাটোর থেকে রাজশাহী (এনএইচ-৬) এই দুটি মহাসড়ককে পাইলট রোড হিসেবে নিয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে।
সওজের পক্ষ থেকে এ প্রকল্প দেখভাল করছেন প্রকল্প পরিচালক মো. সাব্বির হাসান এবং অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক মো. শাহীন সরকার। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রকল্প কার্যালয় থেকে সড়ক অবকাঠামো মেরামত করতে ৫৫টি প্যাকেজে কেনাকাটা, পরামর্শক, ঠিকাদার নিয়োগের জন্য উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু তৎকালীন সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে (সিজিজিপি) গিয়ে ডিপিপি অনুমোদন পেত না। এ কারণে বিশ্বব্যাংকের ঋণের টাকা ব্যয় করা সম্ভব হয়নি। সরকারের অর্থায়নে কেবল প্রকল্প কর্মকর্তাদের বেতন ভাতা দেওয়া হয়েছে। এনএইচ-৪ এবং এনএইচ-৬-এর কোথাও কোনো উন্নয়ন কাজ দৃশ্যমান হয়নি। এরই মধ্যে প্রকল্প পরিচালককেও বদলি করা হয় রংপুরে। এমন স্থবিরতায় বিশ্বব্যাংক প্রকল্পটি থেকে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন (১ হাজার ৮০০ কোটি টাকা) ফেরত নিয়ে গেছে। এখন প্রকল্প কর্মকর্তাদের ফান্ডে ১ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা রয়েছে।
প্রকল্প কর্মকর্তারা বলছেন, দুই বছরে সবমিলিয়ে শূন্য দশমিক ১৯ শতাংশ অগ্রগতি হয়েছে এ প্রকল্পের। তারা বলছেন, এখন নতুন ডিপিপি প্রণয়ন করা হয়েছে। এই ডিপিপিতে প্যাকেজ-১, প্যাকেজ-৩ বাস্তবায়ন করা হবে। সবমিলিয়ে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় করা হবে।
যেভাবে গতি পাচ্ছে কাজ
প্যাকেজ-১-এর আওতায় জয়দেবপুর-এলেঙ্গা (এনএইচ ৪) এবং নাটোর-রাজশাহী দুটি মহাসড়কের ১৪০ কিলোমিটার অংশের ২ হাজার স্পট মেরামত করা হবে। প্রকল্প কর্মকর্তারা জানান, এই সব অংশে সড়কের বাঁক মেরামত, দিকনির্দেশনা ও দুর্ঘটনা সতর্কীকরণ সাইনবোর্ডগুলো মেরামত করা হবে। প্যাকেজ-৩-এর আওতায় ঢাকার আবদুল্লাহপুর থেকে টাঙ্গাইল পর্যন্ত ৭৭ কিলোমিটার মহাসড়কের নানা প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করা হবে। সড়কের পাশে থাকা নানা স্থাপনা অপসারণ করা হবে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত দোকানদার তথা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন করার শর্ত আরোপ করেছে বিশ্বব্যাংক।
এই দুই প্রকল্পের ডিপিপি ইতোমধ্যে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ অনুমোদন দিয়েছে। সিসিজিপি থেকেও ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাবে বলে আভাস পেয়েছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা।
তারা জানান, প্যাকেজ-২-এর আওতায় নাটোর-রাজশাহীর ২১৬ কিলোমিটার মহাসড়কের ৫০০টি স্পট মেরামত করা হবে। পাইলট করিডরে সফলতা পেলে প্যাকেজ-৪-এর আওতায় খুলনা বিভাগের সড়ক অবকাঠামোও উন্নত করা হবে।
প্রকল্পের আওতায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ব্যয়ে শুধু সড়ক অবকাঠামো উন্নত করা হবে না; একই সঙ্গে প্রকল্পের সহযোগী প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও হাইওয়ে পুলিশের জন্য মোটরসাইকেল ও ৮০টি অ্যাম্বুলেন্স কেনা হবে।
বাংলাদেশ সড়ক নিরাপত্তা প্রকল্পের আওতায় হাইওয়ে পুলিশের জন্য একটি আলাদা প্রশিক্ষণকেন্দ্র নির্মাণ করার কথা রয়েছে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এই প্রকল্পের আওতায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ সংস্কার করবে। দুর্ঘটনায় গুরুতর আহতদের (লাইফ সাপোর্টে) চিকিৎসার জন্য নার্সদের আধুনিক প্রশিক্ষণ ও একটি জরুরি কল সেন্টার স্থাপন করবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এসব কার্যক্রম কবে নাগাদ গতি পাবে, তা বলতে পারছেন না প্রকল্প কর্মকর্তারা।
নিরাপদ সড়ক প্রকল্প বাস্তবায়নে ১২ জন পরামর্শক দরকার হবে। ২০২৪-২৫ অর্থ বছর পর্যন্ত ৫ জন পরামর্শক নিয়োগ করা হয়েছে। সওজের অধীনে ৫ বিভাগের সড়কের নির্মাণ জটিলতা দূরীকরণ ও অবকাঠামো উন্নয়ন শনাক্তকরণে কাজ করছে একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। তাদের জরিপ শেষ হলে সেটি নিয়ে আলাদাভাবে ডিজাইন করবে আরেকটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। এই পরামর্শকদের নিয়োগ আটকে আছে এক বছর ধরে।
অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক মো. শাহীন সরকার বলেন, সড়ক মন্ত্রণালয় দ্রুত পরামর্শক নিয়োগের বিষয়ে সায় দিয়েছে। আশা করি, স্থবিরতা কেটে যাবে এক মাসের মধ্যে।
সড়ক ব্যবস্থাপনা ঠিক না করলে প্রকল্প অর্থহীন: ড. হাদিউজ্জামান
বাংলাদেশে সড়ক ব্যবস্থাপনা ঠিক না করে একের পর এক বৃহৎ প্রকল্প গ্রহণ করার বিপক্ষে যোগাযোগ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান। তিনি বলেন, ২০১০ সালে সরকার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল, সড়ক দুর্ঘটনার হার ২৫ শতাংশে কমিয়ে আনবে। সে কাজে কোনো গতি নাই। এখন বলা হচ্ছে ২০৩০ সালের মধ্যে দুর্ঘটনার হার ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে। কিন্তু এমন উচ্ছৃঙ্খল সড়ক ব্যবস্থার মধ্যে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব না।
তিনি বলেন, ‘সরকার ভাবছে, সড়ক-মহাসড়কে কেবল লেন বাড়ালেই দুর্ঘটনার হার কমে যাবে। কিছু অবকাঠামো নির্মাণ করলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব। কিন্তু সড়কের ‘ইকোসিস্টেমই’ কোনো সরকার ঠিক করতে পারল না। একের পর নীতি নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এগুলো দূরদর্শী না। আমরা সবাই মিলে কোনো পরিকল্পনা করি, কিন্তু সরকার কোনো একটা মহলের চাপে পড়ে পিছু হটে। সড়ক খাত যেন কালোটাকা সাদা করার একটা মাধ্যম হয়ে গেছে। এসব জায়গা ঠিক করতে না পারলে যত বড় প্রকল্প নেওয়া হোক না কেন, তা কোনো দিন সুফল বয়ে আনবে না। ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও একে একে তাদের অর্থ বিনিয়োগ বন্ধ করে দেবে।’
Sharing is caring!