প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২০শে ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৫ই পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৯শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

ঢাকায় ছদ্ম-পেশায় সক্রিয় আওয়ামী লীগের লাখো নেতাকর্মী

editor
প্রকাশিত অক্টোবর ২২, ২০২৫, ১২:৩২ অপরাহ্ণ
ঢাকায় ছদ্ম-পেশায় সক্রিয় আওয়ামী লীগের লাখো নেতাকর্মী

Manual2 Ad Code

 

Manual8 Ad Code

প্রজন্ম ডেস্ক:

বিভিন্ন জেলা থেকে এসে ঢাকায় কর্মকাণ্ডে সক্রিয় হতে ভিন্ন ভিন্ন ছদ্ম-পেশা বেছে নিচ্ছেন কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। ব্যাটারি-চালিত অটোরিকশা কিংবা ভাড়ার মোটরসাইকেল চালকের বেশে তাদের অবস্থান বেড়েছে। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নিয়েছেন অনেকে; বিশেষ করে গার্মেন্ট সেক্টরে। সম্প্রতি বিভিন্ন তদন্তে এমন তথ্য উঠে এসেছে।

সর্বশেষ গতকাল ১১টি স্থানে ঝটিকা মিছিল শেষে সেসব জায়গায় ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় গ্রেপ্তার ১৩১ নেতাকর্মীর অন্তত ৮৬ জন ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলার নেতাকর্মী বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা ইউনিট ও ৮টি ক্রাইমজোনকে আরও নজরদারি বাড়ানোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

 

গত বছর গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর তাদের নেতাকর্মীরা নিজ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়। এরপর কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ার পর তারা আত্মগোপনে চলে যায়। সম্প্রতি ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ঝটিকা মিছিলে দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ছবি ভাইরাল হওয়ার পর তাদের পরিচয় প্রকাশ করে সাধারণ মানুষ। এরপর নড়েচড়ে বসেন গোয়েন্দারা। ধারাবাহিক অভিযানে গ্রেপ্তার হচ্ছেন অনেকে। যাদের বেশিরভাগই ঢাকার বাইরের নেতাকর্মী।

 

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি গ্রেপ্তার অনেকেই ঢাকার বাইরের নেতাকর্মী। তারা বিভিন্ন পেশার আড়ালে ঢাকায় অবস্থান করছেন। এরপর কোথাও মিছিল হলেই সেখানে যোগ দিয়ে নাশকতার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এমনকি তারা নামাজ আদায় করে ফেরার সময়ও সংঘবদ্ধ হয়ে মিছিল করে সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে গোয়েন্দা পুলিশের সব ইউনিটকে নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

দেশের বাইরে অবস্থান করা আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা এসব মিছিল অর্গানাইজ করছেন এবং সেখান থেকে অর্থায়নও করছেন বলে উল্লেখ করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, অনলাইনে বিভিন্ন গ্রুপে ঝটিকা মিছিলের সময় ও স্থান নির্ধারণ করে দেওয়া হচ্ছে। মিছিলের শুরুতে ৪-৫ জনের উপস্থিতি দেখা গেলেও মুহূর্তেই তা ২০-৩০ জনে রূপ নিচ্ছে। সম্প্রতি গ্রেপ্তার হওয়া অনেককে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও মহাগরের মাঝের সারির নেতাকর্মীদের অবস্থানের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। রাজধানী ছাড়াও সাভার, আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে তারা অবস্থান করছেন বলেও তদন্তে তথ্য পাওয়া গেছে।

Manual8 Ad Code

গত ১০ মে অন্তর্বর্তী সরকার গণঅভ্যুত্থানকালে হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় বিচার না হওয়া পর্যন্ত সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। এর আগে গত বছরের অক্টোবরে নিষিদ্ধ করা হয় আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে। এরপর থেকে থেমে থেমে ঝটিকা মিছিলের তথ্য পাওয়া গেলেও সম্প্রতি এর সংখ্যা বেড়ে গেছে। এর ধারাবাহিকতায় গতকাল রাজধানীর ১১টি স্থানে মিছিল বের করেন দলটির সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। ওই মিছিল থেকে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটে। এসব মিছিল থেকে পুলিশ ১৩১ জনকে গ্রেপ্তার করে।

পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের উত্তর গেট ও মতিঝিলের রাজউক ভবনের গলিতে জড়ো হওয়ার চেষ্টা করেন। পল্টন থানা পুলিশ বায়তুল মোকাররমের সামনে থেকে মো. ওয়াসিম ও মো. ফয়সাল নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করে। রাজউক ভবনের গলিতে মিছিলের প্রস্তুতিকালে মো. কায়েস হাসান নামের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

Manual2 Ad Code

পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি অপারেশনস) রেজাউল করিম বলেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ থাকা আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তারা যাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে না পারে, সেজন্য পুলিশ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। ৫ আগস্টের পর এখন পুলিশ অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী।

পুলিশের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঢাকার তেজগাঁও এলাকার সাতরাস্তা মোড়ে গতকাল দুপুর পৌনে ১২টার দিকে আওয়ামী লীগের ১২-১৫ জন নেতাকর্মী ৩০-৪০ সেকেন্ডের একটি ঝটিকা মিছিল করেছেন। এ সময় তারা ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’সহ বিভিন্ন স্লোগান দেন। বেলা ১১টার দিকে খিলক্ষেত থানার গলফ ক্লাবের সামনে ৩০ থেকে ৪০ জন ঝটিকা মিছিল করেন। মিছিল থেকে একটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এ সময় পুলিশ ধাওয়া দিয়ে চারজনকে গ্রেপ্তার করে। এছাড়া ধানমন্ডির স্টার কাবাব রেস্টুরেন্টের সামনে, নিউমার্কেটের বাটা সিগন্যাল, আসাদ গেটের আড়ংয়ের সামনে, যাত্রাবাড়ীর মাল্টিমিডিয়া সিএনজি স্টেশন, শেরেবাংলা নগরের আর্কাইভ ভবনের সামনে, গুলশান পুলিশ প্লাজার সামনে, উত্তরা ৩ নম্বর ও ৮ নম্বর সেক্টরের সামনে মিছিল ও মিছিল করার চেষ্টা করেছেন কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এর মধ্যে কয়েকটি মিছিল থেকেও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।

ঢাকা মহানগ গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গতকাল গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে কক্সবাজার জেলার ডুলহাজারা ইউনিয়নের ছাত্রলীগের সহসভাপতি এখলাস মিয়া, খাগড়াছড়ির মহালছড়ি থানার ছাত্রলীগের সভাপতি মো. জিয়াউর রহমান, আওয়ামী লীগের সক্রিয় কর্মী ও রাজধানীতে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মিছিল মিটিংয়ে অংশগ্রহণকারী সাইফুল ইসলাম, মাদারীপুরের সদর উপজেলার যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক জুয়েল আহাম্মেদ রনি, একই উপজেলার মো. রিয়াজ উদ্দিন ও বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য মো. আক্তার হোসেন রয়েছেন। বাকি সদস্যরা বিভিন্ন জেলা-উপজেলার নানা পদে রয়েছেন। সেগুলো যাচাই করা হচ্ছে।

সরকারের একটি বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে আসা নেতাকর্মীদের বেশিরভাগ বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে অবস্থান করছেন। এর সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাবে। এলাকা থেকে নানা অপকর্মের কারণে তারা বিতাড়িত হয়ে নাম-পরিচয় গোপন রেখে হোটেল ও মেসে অবস্থান করার তথ্য রয়েছে। এদের অনেকের নামে মামলাও রয়েছে। সেখানে বসে তারা নিজ এলাকার নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। তবে একটি হোটেলে তারা ৩ থেকে ৪ দিনের বেশি অবস্থান করেন না। রুম ভাড়া নিতে গিয়ে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা চিকিৎসা ও ব্যবসাসহ নানা প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। আগের মতো থানা পুলিশের নজরদারি না থাকায় হোটেলে অবস্থান করার ক্ষেত্রে তাদের কোনো বাধার মুখোমুখি হতে হয় না।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের জয়েন্ট কমিশনার মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম বলেন, ‘বিভিন্ন হোটেল ও মেসে অস্বাভাবিক গেস্ট অবস্থানের তথ্য আছে। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরাও রয়েছে। তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন হোটেলে অবস্থান করেন। সেখানে বসে সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন বলে তথ্য রয়েছে। যেসব হোটেলে তারা অবস্থান করছেন, তার একটা তালিকাও করা হয়েছে। সেগুলো আমরা যাচাই করে দ্রুতই অভিযান চালাব। পাশাপাশি আমাদের নিয়মিত কার্যক্রম চলমান রয়েছে।’

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে পুলিশের তালিকায় প্রায় ১২০০ হোটেল রয়েছে। এর মধ্যে বেশিরভাগ হোটেলের অবস্থান টার্মিনাল-কেন্দ্রিক। এছাড়া হাসপাতাল ও বিভিন্ন মার্কেট-কেন্দ্রিকও অনেক আবাসিক হোটেল রয়েছে। তবে এসব হোটেলের কোনো নিবন্ধন ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে নেই। এমনকি ওই প্রতিষ্ঠানগুলো আবাসিক হোটেল ও রোস্তারাঁ ব্যবসায়ী কোনো সংগঠনের সদস্যও না। ওইসব হোটেলে স্থানীয় থানা পুলিশের কোনো নজরদারিও নেই। এই সুযোগে হোটেলগুলোতে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীরা অবস্থান করছেন। সেখানে বসে তারা মোবাইলে মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মীদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। রাত হলেই ওইসব হোটেলে নেতাকর্মীদের নিয়ে আড্ডায়ও বসেন অনেকে। সেখান থেকে পরবর্তী দিনের কার্যক্রম বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়। বেরিভাগ হোটেলই থ্রিস্টার মানের।

গোয়েন্দা পুলিশের শীর্ষ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, হোটেলে বসে অনেক নেতা ‘পকেট ওয়াইফাই রাউডার’ ব্যবহার করেন। এ কারণে তাদের অবস্থান শনাক্ত করতে বেগ পেতে হচ্ছে। পাশাপাশি স্থানীয় থানা পুলিশের পর্যাপ্ত লোকবল ও যানবাহন না থাকায় হোটেলগুলোতে নজরদারি চালানো সম্ভব হচ্ছে না।

ওই কর্মকর্তা বলেন, সাধারণত ওইসব নেতাকর্মী ঢাকায় তাদের আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় এসে উঠলেও সেখানে অবস্থার বেগতিক দেখলে তারা আবাসিক হোটেলে থাকছেন। আবার অনেকে এক হোটেলে দুই দিনের বেশি অবস্থান করেন না। ঘুরেফিরে বিভিন্ন হোটেলে অবস্থান করছেন। ওইসব নেতা এলাকায় নানা ধরনের অপকর্মে যুক্ত ছিলেন। এখন ঢাকায় এসে আত্মগোপনে রয়েছেন।

Manual3 Ad Code

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual8 Ad Code