প্রজন্ম ডেস্ক:
নির্বাচনে জোটের প্রতীকে ভোট করতে না পারার সিদ্ধান্তে হতাশ ও ক্ষুব্ধ বিএনপির শরিকরা। বিশেষ করে ৫ আগস্টের পর নিবন্ধন পাওয়া দলগুলোর মধ্যে উদ্বেগ বেশি কাজ করছে। কারণ তাদের দলীয় প্রতীক ভোটারদের কাছে অপরিচিত।
দলগুলোর নেতারা বলছেন, নির্বাচনের আগ মুহূর্তে সরকারের এমন সিদ্ধান্তে তারা ভোটের মাঠে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন। জোটের প্রতীকে ভোট করতে পারলে তাদের জয় অনেকটা সহজ ছিল। নিজস্ব প্রতীকে তা বেশ কঠিন হবে। জোটের প্রার্থীর নির্বাচনি প্রচারেও জোটের শীর্ষ দলের নেতাকর্মীদের অনীহা দেখা দেবে। আরপিও সংশোধনের পর আসন ছাড় পেলেও নতুন করে ভাবতে হচ্ছে জোটের প্রার্থীদের। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শরিকরা জোটপ্রধানের সঙ্গে পরামর্শ করে নতুন সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে যেসব শরিক দলের নিবন্ধন অর্থাৎ নিজস্ব প্রতীক নেই, তাদের ধানের শীষেই ভোট করতে বাধা নেই। তারা অনেকটা স্বস্তিতেই আছেন।
সংসদ নির্বাচনে জোট হলেও প্রার্থীদের নিজ দলের প্রতীকে ভোট করতে হবে। এমন বিধান যুক্ত করে বৃহস্পতিবার নির্বাচন-সংক্রান্ত আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের খসড়া অনুমোদন করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ।
গত ১১ আগস্ট গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও, সংশোধন) জোটগতভাবে নির্বাচন করলেও প্রার্থীকে নিজ দলের প্রতীকে ভোট করার বিধান যুক্ত করে নির্বাচন কমিশন (ইসি), যা চূড়ান্ত করতে ২ সেপ্টেম্বর আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠায় ইসি। গতকাল নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কার কমিশনের একজন সদস্য সময়ের আলোকে বলেন, আমরা সরকারকে এমন কোনো প্রস্তাব দিইনি। সরকার নিজেই প্রতীকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ভোট কোন প্রতীকে করবে তা নিজের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। এটা যার যার স্বাধীনতা। বিএনপিও এর বিরোধিতা করেছিল। জোটের নেতৃত্ব দেওয়া দলের প্রতীক না পেলে অনেকেই ফেল করবে। কারণ অন্যরা নতুন নিবন্ধিত দল। তাদের প্রতীক জনগণের কাছে অপরিচিত।
শরিকদের পাশাপাশি আরপিও নিয়ে আপত্তি রয়েছে বিএনপিরও। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, এ খসড়ায় পরিবর্তন আনতে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে তারা চিঠি দেবে। শুক্রবার বিকালে রাজধানীর গুলশানে নিজ বাসভবনে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান তিনি। সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনায় নির্বাচনি ব্যবস্থা সংস্কার-সংক্রান্ত বিষয়গুলোর অনেকগুলোতে আমরা সবাই সম্মত হয়েছিলাম। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নির্বাচনি আচরণবিধি ও আরপিওর যে খসড়াটা উত্থাপন করা হয়েছে, এটাতে যে পরিবর্তন আনা হয়েছে, তাতে বিএনপির কোনো সম্মতি ছিল না।
নির্বাচনে জয়ের শতভাগ নিশ্চয়তা চান বিএনপির মিত্ররা। আসন ছাড়া পাওয়ার পরও তারা বিএনপির প্রতীক ধানের শীষে নির্বাচন করতে আগ্রহী। তাদের ধারণা, এর ফলে ভোটের মাঠ ও জয়ের ক্ষেত্রে ঝুঁকিমুক্ত থাকা যাবে। নিজেদের প্রতীকের চেয়ে ধানের শীষ প্রতীকের গ্রহণযোগ্যতা অনেকগুণ বেশি। মার্কা হিসেবে ধানের শীষ থাকলে বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সহজে সমর্থন ও সহযোগিতা পাওয়া সম্ভব। এলাকায় কাজ করতে গিয়ে ধানের শীষের বিকল্প দেখছেন না জোটের সম্ভাব্য অনেক প্রার্থী। যদিও সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) নতুন বিধিমালা নেতিবাচক ভাবনায় ফেলেছে মিত্রদের।
ববি হাজ্জাজের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম। এই দলের প্রতীক সিংহ। ববি হাজ্জাজকে বিএনপি নেতাকর্মীরা ইতিমধ্যে ঢাকা-১৩ আসনে জোটের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। জোটের প্রতীকে ভোট করতে না পারার সিদ্ধান্তে অনেকটা মাথায় হাত তার।
উদ্বেগ প্রকাশ করে ববি হাজ্জাজ বলেন, এটা অবশ্যই বড় চিন্তার বিষয়। হুটহাট করে কেন সরকার এমন সিদ্ধান্ত নিল, আমার বুঝে আসছে না। রাজনীতিবিদদের কোনো পরামর্শ কিংবা দলগুলোর মতামত না নিয়ে সরকার আরপিও অনুমোদন দিয়েছে। আমাদের কোনো কথা তারা শুনল না। প্রায় প্রত্যেকটি দল নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রতীক ইস্যুতে আপত্তি জানিয়েছি। এমনকি নির্বাচন সংস্কার কমিশনকেও বিষয়টি বলেছি। এ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নষ্ট করেছে। তিনি বলেন, নির্বাচন একটি স্ট্রাজিটিক্যাল বিষয়। এখন আমরা জোটের সঙ্গে আলোচনা করে প্রতীকের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। আমি জোটের প্রতীক ধানের শীষে নির্বাচন করতে চাই। ইতিমধ্যে আমি জোটের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনি এলাকায় গণসংযোগ শুরু করেছি।
সম্প্রতি নিবন্ধন পেয়েছে বাংলাদেশ লেবার পার্টি। দলটির প্রতীক আম। নিজস্ব প্রতীক থাকা সত্ত্বেও ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করতে চান দলের চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান। নতুন নিয়মে এখন তা পারছেন না। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তিনি বলেন, সরকারের এ সিদ্ধান্ত আমাদের হতাশ করেছে। জোটের প্রতীকে ভোট করতে না পারলে অনেক ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। প্রথমত, মাঠ পর্যায়ে জোটের শীর্ষ দলের নেতাকর্মীরা কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করবেন। ধানের শীষ থাকলে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে মাঠে নামতেন। আমার দল নতুন নিবন্ধন পেয়েছে। প্রতীক আম। শুরুতেই এ প্রতীককে ভোটের মাঠে পরিচয় করানোটা কঠিন হবে।
সরকার আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। তারা রাজনৈতিক অংশীজনের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই সিদ্ধান্ত নিল। এ নিয়ে আমরা নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা করব। ইরান বলেন, আমি এলাকায় কাজ করতে গিয়ে বুঝেছি ধানের শীষের বিকল্প নেই। ধানের শীষ হলে আমার কাজ করতে সুবিধা হবে। এ জন্য প্রথমে আমি বিএনপির কাছ থেকে আসন ছাড় চাই। এরপর ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করতে চাই। ২০১৮ সালে আমি পিরোজপুর-২ আসন থেকে ধানের শীষ প্রতীকে ভোট করি। তবে এবার আমি ঝালকাঠি-১ (রাজাপুর-কাঁঠালিয়া) আসনে ভোট করতে চাই। সেখানে বিএনপির হেভিওয়েট ক্যান্ডিডেট নেই। ওই এলাকায় কয়েক বছর ধরে আমি কাজ করছি। ধানের শীষ নিয়ে ভোট করলে আমি পাস করব।
২০১৮ সালে ঢাকা-১৭ আসনে বিএনপির প্রতীক ধানের শীষে নির্বাচন করেছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ। এর আগে ২০০৮ সালের নির্বাচনে ভোলা-১ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হন তিনি। পার্থ বলেন, আমি দলীয় প্রতীক গরুর গাড়ি নিয়ে নির্বাচন করব। তবে কমিশনের নিয়মে যদি সুযোগ থাকে তা হলে জোটের প্রতীক ধানের শীষে নির্বাচন করব। তবে আমার কোনো সমস্যা হবে না। কারণ আমি জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাস করি। এ আদর্শের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা আমাকে সেভাবেই সমর্থন দেবেন।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, প্রতীকের বিষয়টি নির্ভর করছে আরপিও সংশোধনের ওপর। সরকার তো নতুন একটি সিদ্ধান্ত নিল। ২০১৮ সালে ধানের শীষ নিয়ে ভোট করেছিলাম। এবারও চাই ধানের শীষে করতে। তবে নিয়মের বেড়াজালে একেবারেই সম্ভব না হলে আমাদের নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করব। দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক সাকিব আনোয়ার জানান, জোটের প্রতীক ছাড়া মাঠ পর্যায়ে ভোটের প্রচার চ্যালেঞ্জের হবে। মানুষের কাছে ভিন্ন বার্তা যেতে পারে। জোটের একটি প্রতীক থাকলে মানুষকে সহজে রিড করা যেত। নির্বাচনে কিছু কৌশলগত বিষয় থাকে। জোটে সবাই এক মার্কায় ভোট করাও কৌশলের অংশ। এখন সরকারের নতুন সিদ্ধান্তে ভোটের মাঠে একটু জটিলতা তৈরি হলো।
নির্বাচনে জয়ের শতভাগ নিশ্চয়তা চান বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান ও ১২ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতা সৈয়দ এহসানুল হুদা। তিনি বলেন, আমার দলের নিবন্ধন নেই। জয়ের শতভাগ নিশ্চয়তা চাই বলেই কিশোরগঞ্জ-৫ আসন থেকে ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করব। এর বিকল্প নেই। আর আমরা এত বড় দল হয়ে উঠিনি যে, জোটের শীর্ষ দলের প্রতীক ছাড়া ভোট করব। তিনি বলেন, এবার আরপিও সংশোধনে যেসব প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে, তাতে অনেক আপত্তি আছে। জটিল নিয়ম হলো জোটপ্রধানের প্রতীকে শরিকরা নির্বাচন করতে পারবে না।
লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ ২০১৮ সালে ধানের শীষে নির্বাচন করেছেন। তিনি কুমিল্লা-৬ আসন থেকে নির্বাচিত সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রাক্তন প্রতিমন্ত্রী। রেদোয়ান বলেন, আমি ছাতা প্রতীক নিয়ে প্রচার চালাচ্ছি। নির্বাচন কমিশনের বিধিমালায় যদি জোটের প্রতীকে নির্বাচন করা সম্ভব হয় তা হলে ধানের শীষে করব। আমি তারেক রহমানকেও একই কথা বলেছি।
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান ফরিদুজ্জামান ফরহাদ নড়াইল-২ আসন থেকে নির্বাচন করতে চান। ২০১৮ সালেও তিনি এ আসন থেকে ভোট করেন ধানের শীষ প্রতীকে। বিএনপির যুগপৎ আন্দোলনের শরিক হিসেবে এবারও ফরিদুজ্জামান ফরহাদ ধানের শীষে নির্বাচন করবেন। তিনি বলেন, এনপিপির প্রতীক নিয়ে মামলা চলছে। এটি শেখ ছালাউদ্দিন ছালু (এনপিপির এক অংশের আহ্বায়ক) দখল করে রেখেছেন। আমার ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করতে সমস্যা নেই। ধানের শীষেই আমি ও আমরা নির্বাচনি এলাকার জনগণের আস্থা রাখতে পারি। কারণ দীর্ঘদিন ধরে আমি নানাভাবে ধানের শীষের সঙ্গে জড়িত।
১২-দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিমও ধানের শীষে নির্বাচন করবেন। তিনি ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনেও লক্ষ্মীপুর-১ (রামগঞ্জ) আসনে ধানের শীষে ভোট করেন। এবার তার দলের নিবন্ধন না থাকায় সরাসরি ধানের শীষে নির্বাচন করতে কোনো বাধা নেই।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন বলেন, গতবার ধানের শীষে নির্বাচন করেছি। এবার আমরা এখনও সিদ্ধান্ত নিইনি। দলের তারা প্রতীক নিয়েই নির্বাচনি প্রচার চালাচ্ছি। বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব। তবে ধানের শীষে ভোট করতে পারলে মাঠে কার্যক্রম পরিচালনা সহজ হবে।
সম্প্রতি ভাসানী অনুসারী পরিষদ রাজনৈতিক দল হিসেবে ‘ভাসানী জনশক্তি পার্টি’ নামে আত্মপ্রকাশ করেছে। দলটির চেয়ারম্যান শেখ রফিকুল ইসলাম বাবুল বলেন, আমরা ধানের শীষে নির্বাচন করব এটা ফাইনাল। কারণ আমাদের নিবন্ধন নেই। গণতন্ত্র মঞ্চ প্রতীকের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। যার যার সুবিধামতো প্রতীকে নির্বাচন করবে সবাই।
Sharing is caring!